X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

পুরুষের চোখে নারী

রাশেদা রওনক খান
২৪ আগস্ট ২০১৬, ১৬:৩১আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০১৬, ১৭:২৩

রাশেদা রওনকআমাদের সমাজে তথাকথিত পুরুষের চোখে 'নারী' আসলে কী? কোনও ভূমিকা না দিয়ে চলে যেতে চাই আলোচনায়:
১. আমরা সারাক্ষণ নাটক-সিনেমার নায়িকা কিংবা মডেলদের বাস্তবে, স্বপ্নে কিংবা টিভি-সিনেমার পর্দায়ই দেখতে ভালোবাসি! কিন্তু তাদের নিয়ে যখন আলোচনা শুরু হয়, তখন তাদের নিয়ে কী ধরনের আলোচনা হতে পারে, তার বহিঃপ্রকাশ আমরা বিভিন্ন নায়িকা কিংবা মডেলের ফেসবুক থেকেই অনুধাবন করতে পারি। বাংলাদেশের সম্ভবত এমন কোনও নায়িকা কিংবা মডেল নেই, যিনি ফেসবুকে বাজে এবং অশ্লীল মন্তব্য পাননি? কিন্তু কেন? যখন তাদের রূপালি পর্দায় বা টিভিতে দেখছে, তখন থেকেই তাদের প্রতি ওই বিকৃত মন-মানসিকতার পুরুষগুলোর বিকৃত জৈবিক তাড়না তৈরি হয়। যেহেতু সেই তাড়না মেটাতে পারে না, তখনই তার ভেতরে একধরনের খেদ, না পাওয়ার হতাশা পেয়ে বসে। এই হতাশা, খেদ, না পাওয়ার যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এসব অশ্লীল মন্তব্য। ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আমাদের সহজেই এটা বুঝতে সাহায্য করে।
ফ্রয়েড বলছেন, সব ইচ্ছারই একটা করে বিপরীত ইচ্ছে আছে। যেমন-ভালোবাসা-ঘৃণা অর্থাৎ কাউকে যদি ব্যক্তির ভালো লাগে, কিন্তু তাকে যখন না পায়, তখন সে ব্যক্তি তার ভালোলাগার মানুষটির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকে মনের ভেতরে। মনের অজান্তে কিছু মানুষ বাসনার তৃপ্তির জন্য বাস্তবতা বা সমাজকে অবজ্ঞা করে। সেক্ষেত্রে কেউ এসিড ছোড়ে, কেউ কেউ এই ডিজিটাল বাংলাদেশে তাদের চেতন কিংবা অবচেতনে সেই নারীর প্রতি যৌনতা এবং যৌন আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ধরনের অশ্লীল মন্তব্য করার মধ্য দিয়ে!

প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তথাকথিত ভদ্র শ্রেণির যারা এই মন্তব্যগুলো দেখে থাকি, কতজন এর প্রতিবাদে কিংবা সেই বিকৃত রুচির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পাল্টা মন্তব্য দেই? কেন দেই না—এর উত্তরও সম্ভবত ফ্রয়েডীয় ধারণা হতে পেতে পারি, যেখানে তিনি বলছেন, পালিয়ে বাঁচার কথা। নিজের মনের ইচ্ছে বা কথাকে সাপ্রেস করে রাখা, কোনও একটা কাজ করা বা বলার প্রয়োজন মনে না করা। ফলে এখানে চারটি দল আমরা দেখতে পাই।  একপক্ষ, যারা সরাসরি নোংরা মন্তব্য লিখছে, আরেক পক্ষ আছে, যারা এসব মন্তব্য নিজে না করলেও পড়ে আত্মতুষ্টি লাভ করে, আরেক পক্ষ যারা মন্তব্য পড়ছে কিন্তু প্রতিবাদ করছে না, আর শেষ পক্ষ যারা একেবারেই সংখ্যায় নগন্য, যারা প্রতিবাদ করছে! আসুন সবাই আজ এই দিনে শপথ নেই শেষ পক্ষে যোগ দেওয়ার!
২. এবার একটু ভাষা প্রসঙ্গে আসি! নিত্যদিনের ভাষা কতটা সরাসরি সহিংস শব্দাবলি কিংবা হয়রানিমূলক—তা একজন নারী তার কৈশোর কাল থেকেই জেনে যায়! একজন কিশোরীর চোখ এড়ায় না বাবা-মায়ের হাত ধরে কোথাও যাওয়ার পথে রাস্তার দেয়ালে আঁকা বিভিন্ন চিহ্ন, যেখানে নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে দেখানো হয়। সেই কিশোরী তার পুরো জীবনে নানান সময়ে নানাভাবে নানা পর্যায়ে এই ধরনের যৌনভাষা নিয়েই বেড়ে ওঠে। উদাহরণ টেনেই বলছি—কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন যে, আজও বিদ্যাশিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাসরুমে, টয়লেটের প্রবেশপথে, নববর্ষের খেতাবে কিংবা নারী ক্লাসমেটদের পুরুষ সহপাঠীদের নামকরণে, ব্ল্যাকবোর্ডে, ক্লাস রুমের দেয়ালে, কাঠের টেবিলে নারীকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল বাক্য, ছবি, কার্টুন, চিহ্ন সংবলিত অশ্লীলতা চোখে পড়ে না? কেউ কি সাহস করে দাবি করতে পারবেন যে, এই ধরনের সহিংস, যৌন বিকৃত লেখা, ছবি, মন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তে আসা তরুণেরা করেনি?  নাকি এক শ্রেণির ‘ভদ্র উচ্চশিক্ষিত পুরুষ’ ফেসবুকের মন্তব্যের মতো দোষ ছুড়ে দেবে যে,  'নিন্মশ্রেণির', 'অভদ্র', 'মূর্খ', পিওন-দারোয়ানরা এসব করেছে, আমরা নই! বরং সৎ সাহস নিয়ে পুরুষদের বলার সময় এসেছে, ‘হ্যাঁ আমরাই করেছি! এই আমরাই এখন বিসিএস ক্যাডার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সাংবাদিক তথা জাতির বিবেক! এই আমরাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণীদের বাবা, যারা তোমাদের জন্য এই পবিত্র জায়গা নষ্ট করে দিয়ে এসেছি, এবং এখনও সেভাবেই চলছে...আমাদের ক্ষমা করে দাও!’  মনে রাখতে হবে, ‘ভাষা’ হলো চৈতন্যের প্রকাশিত একটা চেহারা বা রূপ! তাই ভাষার মাধ্যমে যেমন অপরাধ করা যায়, তেমনি সেই ভাষা দিয়েই ক্ষমা চাওয়া যায় আর কারও কাছে না হোক, অন্তত নিজের কাছে! 

৩. এবার আসি, রাস্তাঘাটের চলা ফেরায় আমাদের নারীর প্রতি কেবল বৈষম্যমূলক আচরণের ধরন  প্রসঙ্গে! একজন নারীর সেই কিশোরীকাল থেকে নিত্যদিনের পথ চলায় কী পরিমাণ তির্যক মন্তব্য শুনতে হয়, তা কেবল একজন নারীই জানেন। পুরুষরা জানেন না, তা নয়! নিপীড়কশক্তি ঠিকই জানে তার নিপীড়নের মাত্রা কতটা ভয়াবহ। তাই সহজেই নিজের স্ত্রী কিংবা মেয়েকে হিজাবি বানিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী। ধারণাটা খুব ভুল! হিজাব যারা পরেন, এমন অনেক নারীর অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমি চমকে উঠেছি রীতিমতো! বিকৃত মানসিকতার কাপুরুষেরা ঠিক ঠিক তাদের তির্যক মন্তব্য, বিশেষ অঙ্গভঙ্গি, প্রতীকী শব্দ উচ্চারণ, এমনকি শরীরে স্পর্শ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। অনেকে ভাবতে পারে, উচ্চবিত্তের মেয়েদের গাড়িতে চড়ে বলে এই সমস্যা নেই। কিন্তু বিত্ত যে এক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে পারে না, তার উদাহরণ শাজনীন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। তাহলে ঘরের ভেতরেই আমাদের দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী প্রথম আলোর প্রকাশক লতিফুর রহমানের মেয়ে শাজনীন ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হতেন না। তাই যেসব উচ্চবিত্ত উচ্চশিক্ষিত পুরুষ নিজেদের স্ত্রী-মেয়ে সন্তানকে বিত্তের ভেতরে রেখে নিরাপদ ভাবছেন, আসলে বিষয়টি অতটা সহজ-সরল নয়। তাই এখনই সময় প্রত্যেকের সচেতনতার। যারা শুনছেন কোনও 'পথচারী নারী'কে উদ্দেশ্য করে কেউ বাজে মন্তব্য করছে কিংবা অঙ্গভঙ্গি করছে, তার প্রতিবাদ না করে নিপাট ভদ্রলোকের মতো শুনে যাওয়াটা আসল মানুষ হিসেবে আপনার ‘পরাজয়’ ছাড়া কিছু নয়। কেন না, আজ আপনি-আমি এর প্রতিবাদ না করলে কে জানে কাল আমার-আপনার মেয়েকেও 'গাড়ি' থেকে নামার পর একই রকমভাবে বাজে মন্তব্য শুনতে হতে পারে। সমাজে হাতে গোনা গুটিকতক মানুষ ছাড়া বিশেষ করে আমরা যারা শহরে উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সুবিধাভোগী শ্রেণি তারা খুব সহজেই বিপদ-অপদকে পাশ কাটিয়ে নিজের স্বার্থকেই বড় করে দেখি। কিন্তু তাতে যে নিজের স্বার্থ সিদ্ধিতো হয়ই না, বরং নিজের ওপরই এসে বিপদ পড়ে, এমন হাজারো প্রমাণ আছে।

৪.  এবার নারীর প্রতি সরাসরি সহিংসতা কিংবা নির্যাতন প্রসঙ্গে আসি। আমাদের সামাজিক দৃষ্টি কি আসলে নারী নিয়ে, তা আমরা গণমাধ্যমের কল্যাণে বুঝতে পারি। এই সমস্যা তা কেবল আমাদের দেশের সমস্যা তা কিন্তু নয়, পাশ্চাত্যেও এটা প্রবলভাবেই আছে। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দিনাজপুরে কয়েকজন পুলিশ কর্তৃক কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে, এই ঘটনা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। সেদিন অনেক গণমাধ্যমেই ইয়াসমিনকে 'পতিতা' বানিয়ে ফেলেছিল!

কতটা নির্লজ্জ অমানবিক অসভ্যতা স্থান পায় সেইসব সংবাদ প্রকাশে। এই এরাই হয়তো শিরোনাম করবে ‘আজ ২৪ আগস্ট পালিত হচ্ছে: জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ’ দিবস। ‘তনুর ঘটনা তা খুব বেশিদিন আগের নয়। আমি একটা নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের মায়েদের আলাপ শুনছিলাম তনুকে ঘিরে! একজন বলছিলেন, ‘মেয়েটা তো ভালো ছিল না, নাটক করত, থিয়েটার করত, রাত করে বাড়ি ফিরত। এইজন্যই এমন হয়েছে।’ আরেকজন বলছে, ‘মেয়েদের এত স্বাধীনতা দিতে নেই, বাবা-মা তনুকে যা ইচ্ছে তাই করতে দিয়েছে, তাই আজ এই পরিণতি’।  আরেকজন বলছে, ‘হিজাব পরলে কী হবে, তার নাকি সব ছেলে বন্ধু, যারা মেরেছে তারা তো সব তার বন্ধুই। এভাবে অবাধে একসঙ্গে মিশলে একসময় তো বন্ধুদের মনে খারাপ ইচ্ছে জাগবেই, তনু দিতে চায়নি, জোরাজোরি করছে, তাই নাকি মেরে ফেলল!’ এবার যেন আমার ধৈয্যের বাঁধ ভেঙে গেল।

আমার অবাক প্রশ্ন, এগুলো কোথায় শুনলেন আপনারা? উত্তরে একজন বলল, ‘আমার স্বামী বলল, ও অফিসে শুনে এসেছে।’, একজন বলল, ‘কেন পত্রিকায় তো দিচ্ছে এসব। আপনি পড়েন নি?’ আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, এই নারী জগৎ তাই জানে, যা তার পুরুষ কিংবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম যন্ত্র গণমাধ্যম জানায়। পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে টিএসসিতে কোনও এক নববর্ষের রাতে ‘বাঁধন’ নামের এক মেয়েকে হেনস্তা করার কথা! কেন উৎসব হবে লৈঙ্গিক বৈষম্যের, কেন রাষ্ট্র নারীকে উৎসব পালনে বাধা দেবে?, কেন আমরা এমন একটা সমাজ তৈরি করতে পারিনি?, শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির উৎকৃষ্ট স্থান টিএসসিতে পর্যন্ত কেন একজন নারী উৎসব করতে পারে না? সেই প্রশ্ন না ছুড়ে বরং মেয়েটি কেন এত রাতে বের হলো, কেন এমন পোশাকে ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে উৎসবে—ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক শব্দমালা দিয়ে কল্প-কাহিনি-গল্পে ভরে গেলো আমাদের গণমাধ্যমের পাতাগুলো! আফসানার মৃত্যু নিয়েই একই ধরনের বক্তব্য আমরা প্রায়শই গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি! কিভাবে মারা গেলো, কেন মারা গেলো, কে মেরে ফেলল, তার বিচার চাওয়ার চেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে, মেয়েটার কাপড়-চোপড়, চেহারা-চাল-চলন- বৈবাহিক স্ট্যাটাস, প্রেম, ইত্যাদি বিষয়ে নানাভাবে অশ্লীলতার গন্ধ খুঁজে পাওয়া।  যারা বুঝে-শুনে-জেনে নিপীড়ক-হত্যাকারীকে বাঁচাতে চাচ্ছে তারা এইধরনের ডিসকোর্স তৈরি করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তাদের উচিত নিজেকে প্রশ্ন করা!  আর ফেসবুকে কেউ কেউ বুঝে কিংবা না বুঝে এসবের পুনরুৎপাদনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছি এবং অপশক্তিকে বাঁচিয়ে দেওয়ার পক্ষে পরোক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছি, তাদের সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। তাই দ্বিতীয় দলের প্রতি অনুরোধ, গণমাধ্যমের রাজনৈতিক ফাঁদে পা দেওয়াটা ভয়ঙ্কর বিপদের। প্রত্যেকটি সংবাদ মাধ্যমেরই নিজস্ব কিছু এজেন্ডা থাকে, আমরা সাধারণ পাঠক তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের ‘হাতিয়ার’ না হয়ে যাই, সেদিকটা আমাদেরই নজর দিতে হবে! যেমন সেদিন ইয়াসমিনকে 'পতিতা' বলে আখ্যায়িত করতে পারলে পুলিশ এর কিছু পাষাণ্ড ধর্ষক বেঁচে যায়! কোনও কোনও গণমাধ্যমের সহায়তায় তার ‘পতিতা’ পরিচিতি আমাদের অনেকেরই মগজে আটকে গেলো এবং আমরা ছোটবেলা থেকেই ‘বাইনারি-অপজিশন’ ধারণা দ্বারা এতটাই আপ্লুত যে, ভালো মেয়ের বিপরীতে ‘খারাপ মেয়ে’ বলতে ‘পতিতা’কেই  বুঝি! পতিতাবৃত্তি একটা পেশা এবং এই সেবা গ্রহণ করে আমাদের সমাজেরই পুরুষেরা, তা যেন আমাদের মগজ কিংবা ডিসকোর্সই নেই! যদিও ইয়াসমিন কোনোভাবেই এই পেশায় যুক্ত ছিল না। তবু যদি এই পেশার নাম বিক্রি করে নিপীড়ক দলকে বাঁচিয়ে দেওয়া যায়, সেই প্রত্যাশায় এই অপপ্রচার! এইসব অপপ্রচারে তলিয়ে যায় আসল ‘সত্য’। সত্যটা এই যে, ও আসলে ধানমণ্ডির এক বাসায় কাজ করত এবং একরাতে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। কিন্তু বাস থেকে নামার পর দশমাইলের মধ্যে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইয়াসমিন পুলিশ সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষক পুলিশের দল পরে ইয়াসমিনের লাশ দিনাজপুর শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ব্র্যাক অফিসের পাশে রাস্তায় ফেলে রেখে যায়।

শেষ করছি, মার্গারিটার সাফল্যগাথা গল্পকে যেভাবে আমরা গ্রহণ করছি, তা দিয়ে! আমাদের সমাজে কেউ কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে  মার্গারিটার সাফল্যকে নিজেদের রক্তের বলার জন্য,তিনি বাঙালি, তা প্রমাণের সর্বোচ্চ চেষ্টায় রত এখন তারা। কেবল যে কিছু পত্রিকা করছে তা নয়, কিছুদিনের মাঝেই শুরু হবে সব সভা-সেমিনারে, প্রতিষ্ঠানে তাকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা, বাঙালিয়ানার উচ্ছ্বাস প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠবেন তিনি,  রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবার অভিনন্দনের বন্যায় ভাসবেন তিনি। এটাই তার প্রাপ্য সম্মান। তিনি যা দেখিয়েছেন, যা করেছেন, তা বাঙালি হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জন্যই গর্বের এবং এর উপযুক্ত সম্মান অবশ্যই তার প্রাপ্য। কিন্তু এই ‘আমরা’, যারা এখন তাকে ‘আমাদের’ বলে দাবি করতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী, তারা কি এই দেশ টাকে মার্গারিটার জন্য উপযুক্ত করতে পেরেছি? আমরা কি পারতাম এমন একটা পরিবেশ দিতে যেখানে মার্গারিটা এই জিমনাস্টিকসের ড্রেস পরিধান করে দিনের পর দিন অনুশীলন করতে পারেন? স্টেডিয়ামে দায়িত্বরত ঝাড়ুদার হতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—কার না চোখ আটকে থাকতো মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন বাঁকের দিকে? উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মাঝে বিবাহিত সুখী সংসারের সফল স্বামী নামধারী কোনও একজন পুরুষ হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়ত তার ওপর 'অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সুযোগ' দেওয়ার বিনিময়ে! এই তো আমাদের সমাজ! মনে আছে মাহফুজা খাতুন শিলার কথা? ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক এ সোনা জিতে বাংলাদেশের সাঁতারে ইতিহাস গড়ার সাথে সাথে ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে এসএ গেমসের রেকর্ড গড়ে দেশের জন্য সোনা জিতে এনেছেন! অথচ এই গেমস এ অংশ নেওয়ার টিকেট পেতে হয়েছিল অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে আমরা সবাই জানি, ফেডারেশন তার সঙ্গে কি বৈষম্যমূলক আচরণই না করা হয়েছে! গণমাধ্যম এতটুকু বলেই তাদের দায়িত্ব সেরে ফেলেছেন! পত্রিকা কিংবা আমরা কেউ খুঁজে দেখি না, কেন সীমান্ত-শিলাদের  মতো প্রতিভাবান মেয়েরা এভাবে বৈষম্যের স্বীকার হয়, কিসের জন্য আমাদের দেশে প্রতিভার অবমূল্যায়ন হয়? কারা সেই ভদ্রবেশী শয়তান? তাদের মুখোশ উন্মোচন করে ফেলতে পারি না আমরা? 

মার্গারিটাকে নিয়ে আজ যেই অহঙ্কারী উচ্চারণ শুনি, সেই স্বর কেন শুনি না, যখন দেখি কোনও নারী এথলেটকে কর্মকর্তাদের ‘কথা মতো না চললে’ বা ‘বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব না মেনে নিলে’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়? কোথায় থাকে তখন আমাদের বাঙালিয়ানার গর্ব আর অহঙ্কার? নিজের জন্মভূমিতে একজন মার্গারিটা তৈরির জন্য আমরা প্রস্তুত কিনা, সেটা ভেবে দেখতে হবে সবাইকে। সীমান্ত-শিলার স্বর্ণজয়ের পর কিছুদিন তাদের নিয়ে হৈ-চৈ, তারপর হারিয়ে যায় এই সোনাজয়ী মেয়েরা। সমাজের বিত্তবান কিছু মানুষ কি এগিয়ে আসতে পারতো না তাদের আরও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করার জন্য? পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক চাপের কারণে তারা হারিয়ে যায় একসময় ‘বিয়ে’ নামক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। বিয়ের পর স্বামী কিংবা স্বামীর পরিবার আর এথলেট বউ চায় না, চায় একজন নম্র-ভদ্র ঘরণী, যার সাত চড়েও রা নেই! আমরা প্রতিবানদের যত্ন নিতে জানি না,কেবল কিছু দিন তাদের নিজস্ব চেষ্টায় প্রাপ্ত অর্জন নিয়ে লোক দেখানো আনন্দ-উল্লাস-সভা-সেমিনার করতে জানি। কিন্তু জানি না কিভাবে প্রতিভার যত্ন করতে হয়, রক্ষা করতে হয়!  এভাবে অন্যায়-অবিচার-সহিংসতা-নির্যাতন-বৈষম্যের কথা পদদলিত করে, আমরা যারা কেবল ‘অন্যে’র প্রাপ্তিকে ‘নিজের’ বলে আর্তনাদ করে শান্তি খুঁজে বেড়াই, নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে নামকওয়াস্তে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ দিবস’ কিংবা ‘জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ পালন করি, পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শকেই আদর্শ মনে করি, সেই ভূমিতে আর যাই হোক, মার্গারিটা তৈরি হবে না। তার জন্য রাশিয়াতেই যেতে হবে! 

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

আরও খবর: উন্নয়ন কাজ সম্পর্কে কিছুই জানে না রাজধানীবাসী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ