X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাশরাফির আলিঙ্গন

হারুন উর রশীদ
০২ অক্টোবর ২০১৬, ২১:৪২আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:২৩

হারুন উর রশীদ বাংলাদেশ-আফগাস্তিানের শনিবার তৃতীয় দিনের ম্যাচটি ঘটনাবহুল। আফগানিস্তানকে হারিয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শততম ম্যাচ জয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ২১তম সিরিজও জয় করে। আর তামিমের সপ্তম সেঞ্চুরিও এই ম্যাচে।
কিন্তু এসব এখন আর হিসাব করছেন না ক্রিকেট ভক্তরা। তাদের কাছে সবার ওপরে মাশরাফির আলিঙ্গন। হঠাৎ মাঠে ঢুকে পড়া এক ক্রিকেট পাগল ভক্তকে মাশরাফি বুকে জড়িয়ে আবারও প্রমাণ করলেন ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। আর তিনি আসলেই একজন বীর-অধিনায়ক। জীবনের চেয়ে ভালোবাসার দাম তার কাছে বেশি। ভালোবাসাকেই তাই তিনি বুকেই নিলেন।
যারা মাঠে খেলা দেখেছেন তারা তো বটেই, টেলিভিশনে যারা লাইভ দেখেছেন তারাও ওই টান-টান উত্তেজনায় রুদ্ধশ্বাস কয়েক মুহূর্তের দৃশ্য উপভোগ করেছেন। সব ভুলে তারা একজন মাশরাফিকে দেখেছেন। দেখেছেন এক মহৎ হৃদয়ের ভদ্রলোককে। দেখেছেন আমাদের বীর ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। আর আলিঙ্গন দৃশ্যে একাত্ম হয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েছেন। দিয়েছেন জয়ধ্বনি। ভালোবাসাকে সমস্বরে জানিয়েছেন স্বাগতম। তাদের কাছে তখন নিরাপত্তা, আশঙ্কা আর ক্রিকেট নয়, তাদের কাছে তখন মাশরাফি একজন মহৎ মানুষ। বীর-অধিনায়ক, গ্রেট হিরো।
শনিবার রাত ন'টা বাজতে আরও কয়েক মিনিট বাকি। তাসকিন আহমেদ ২৯ ওভারের দ্বিতীয় বলটি শেষ করেছেন। তৃতীয় বলটি করার জন্য ছুটে যাচ্ছেন। বল ছোড়ার আগের মুহূর্তেই অন্য প্রান্ত থেকে আফগান ব্যাটসম্যান রশিদ খান হাত তুলে তাকে থামালেন। টেলিভিশন ক্যামেরা ঘুরে গেল পিচ থেকে। আলো পড়লো এক তরুণের দিকে। তিনি কোনও খেলোয়াড় নন, ছুটে আসছেন মাশরাফির দিকে। মাশরাফি কী ক্ষণিকের জন্য কিছু ভেবেছিলেন! হয়তো ভেবেছিলেন। ওই তরুণ মাশরাফির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, করমর্দন করলেন মাশরাফি। মাশরাফি সব দ্বিধা কাটিয়ে দু’হাতে তাকে বুকে টেনে নেন, জড়িয়ে ধরেন। ক্যামেরার সব চোখ, মাঠের সব মনোযোগ এবং টিভি সেটের সামনে সব দর্শক তখন ওই দৃশ্যে নিমগ্ন-অভিভূত-আপ্লুত।
এখানেই শেষ নয়, তরুণের পেছনে ছুটে আসছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা, মাশরাফি হাতের ইশারায় তাদের নিবৃত হতে বলেন। যখন নিরপত্তারক্ষীরা মাশরাফিসহ ওই তরুণকে ঘিরে ধরেন, মাশরাফি তখনও তাকে বুকে আগলে রাখেন। নিজে ওই তরুণের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে যান। যেন তারা তরুণের কিছু না করেন। তাদের বারবার হাত দিয়ে সরিয়ে দেন। আর তরুণকে নিয়ে মাশরাফি যখন সামনের দিকে এগিয়ে যান, তখনও তিনি একহাতে তাকে আগলে রেখেছিলেন। টেলিভিশনে ধারা ভাষ্যকারের কণ্ঠেও বাড়তি চাপ। তিনি বলেন, ‘মাশরাফি মুর্তজা জাস্ট টেলিং এভরিবডি, ইটস অল রাইট, ইটস অল রাইট’। শেষ পর্যন্ত আশ্বস্ত হয়েই হয়তো মাশরাফি ওই তরুণকে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে যেতে দেন।

এরপর খেলা শেষে মাশরাফি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি ছেলেটার দিকে খেয়াল রাখতে বলেছি, ওর যেন কিছু না হয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা অনেক ভালো। হয়তো কোনও কারণে ফ্যান ঢুকে গেছে। এটা বড় কোনও সমস্যা নয়।’
ওই মাশরাফি ভক্তের নাম মেহেদী হাসান। তার বাড়ি সাভারে। সে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। তারা সাভারের চার বন্ধু একসঙ্গে খেলা দেখতে এসছিল। বাকি তিনজন আবীর, তানভীর ও আয়মানকেও পুলিশ আটক করেছে। রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা পুলিশি হেফাজতে ছিল। পুলিশ আসলে বুঝতে চাইছিল তারা আসলেই ভক্ত, না অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল তাদের।
এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে ক্রিকেট ভক্তরা মাশরাফি বন্দনায় মেতে ওঠেন। মুশফিকুর রহমান আশিক নামে একজন ফেসবুকে লেখেন, ‘এ জন্যই মাশারাফি মহান।’ সানজিদ আহমেদ লিখেছেন, ‘এজন্যই মাশরাফি সবার শ্রদ্ধার পাত্র।’ মল্লিকা আকতার লেখেন, ‘মাশরাফিকে ধন্যবাদ।’ পলি ফারাহানা লিখেছেন, ‘এ রকম দেখে আমি আরও ম্যাশভক্ত হয়ে গেলাম।’ লাবিবা সালাত লিখেছেন, ‘এ জন্যই মাশরাফি সবার ওপরে।’ তাসনিয়া আজিম লেখেন, ‘অন্তর ভরে গেছে।’
কিন্তু এর বিপরীত মন্তব্য আছে। ক্রীড়া সাংবাদিক দেবব্রত মুখার্জি তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, "আমি অন্তত এই কাণ্ড করা লোকটিকে ‘মাশরাফি ভক্ত’ বলতে রাজি না। মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরার সাতশ’ নিরাপদ সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। সে সব বাদ দিয়ে এভাবে দেশের ক্রিকেটকে হুমকিতে ফেলে দিয়ে জড়িয়ে ধরাটা একেবারেই নির্বুদ্ধিতা। সবাইকে অনুরোধ, এমন কিছু করবেন না, যাদের দেশের ক্রিকেটের ক্ষতি হয়। অতি আবেগ দেখিয়ে এই ধরনের কাণ্ডকে উৎসাহিত করবেন না। এটা আমার-আপনার শখের ব্যাপার নয়; একটা জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্ন।’’
এর জবাবে আজিজুল মিসবাহ নামে একজন লিখেছেন, ‘রোনালদো, মেসি, নেইমারের কাছে যখন ফ্যান আসে, তখন সেটা নিরাপত্তা ইস্যু হয় না কেন? ডলা ওই গোলাপি শার্টওয়ালাকে না দিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব যারা নিয়েছেন, তাদের দেওয়া উচিত! তারা কী নিরাপত্তা দিচ্ছে যে, একজন লোক মাঠে ঢুকে যায়?’
আর এইচ এম অর্কের মন্তব্যটি বেশ মজার। তিনি বলেছেন, ‘‘তবে আমাদের 'ক্যাপ্টেন ম্যাশ' ওই লোককে যেভাবে সিকিউরিটি ম্যানদের থেকে প্রটেক্ট করলো, দেখার মতো ছিল।’’
ধারাভাষ্যকাররাও বলছিলেন, আন্তর্জাতিক কিক্রেটে এ ধরনের আচরণ বেআইনি। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তাই পুলিশ স্বাভাবিক কারণেই ওই তরুণকে আটক করছে।
ফুটবলে তো আছেই, ক্রিকেট মাঠেও এভাবে ভক্তদের ঢুকে পড়া নতুন কোনও ঘটনা নয়। এটাকে সাধারণভাবে বলা হয় পিচ ইনভেশন। আর যিনি বা যারা ঢোকেন, তাদের বলা হয় পিচ ইনভেডর। ২০০১ যুক্তরাজ্যে ইংল্যান্ড-পাকিস্তান ম্যাচ চলাকালে, ১৯৯৩ সালে গায়ানায় পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের সময়, ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে পিচ ইনভেশন-এ এমন ঘটনা ঘটে। কিন্তু তা কোনও ভক্তের ভালোবাসার ইনভেশন ছিল না। ছিল অপরাধমূলক। আর পিস ইনভেশন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে আমরা ওইসব ঘটনার সঙ্গে মিরপুর স্টেডিয়ামে শনিবারের ঘটনার তুলনা করতে পারি না। কারণ এটা ওই অর্থে কোনও পিচ ইনভেশন নয় বলে আমার ব্যক্তিগত মত।
এর বাইরেও ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে নিরীহ ভক্তের প্রবেশের উদাহরণ আছে। আছে নারীর অনুপ্রবেশের ঘটনা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ যখন জয় লাভ করে, গ্যালারি থেকে আকরাম-নান্নুদের স্পর্শ করতে মাঠে দৌড়ে আসে ইংল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। পিচ ইনভেশন-এর যে রেকর্ড আছে, তাতে এই ঘটনাটি রেকর্ডভুক্ত নয়। আর রেকর্ডে আসবেই বা কেন। এটাও ছিল ভালোবাসার-আনন্দের।
তবে আমিও মনে করি এ ধরনের ঘটনাকে নিরুৎসাহিত করা উচিত। ভালোবাসা-ভালোলাগা কী এত হিসাব-নিকাশ করে হয়! পাগল-ভক্তের প্রেমের কি কোনও গণিত আছে! সেটা আমাদের হিরো মাশরাফিও জানেন। তাইতো প্রেমকে-ভালোবাসাকে তিনি অবহেলা করেননি। ওই তরুণকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পরও তার যেন কিছু না হয়, সেজন্য অনুরোধ করেছেন তিনি।
মাশরাফি ভালোবাসার চোখ বুঝতে পারেন। কারণ তিনি তো বাঙালি ক্রিকেটার। ওই তরুণ কী কারণে ছুটে আসছেন, তা তার বুঝতে সময় লাগেনি। কিন্তু আমার প্রশ্ন পুলিশ কেন দেখলো না? পুলিশ কেন আগেই আটকাতে পারলো না ক্রিকেট-পাগল মেহেদী হাসানকে। না তারাও নিরাপত্তার দায়িত্ব বাদ দিয়ে অন্যকিছুর প্রেমে বিভোর ছিলেন! তাহলে তো চলবে না। এ রকম হলে ক্রিকেট মাঠে খেলোয়াড়দের চেয়ে ভক্তদের ভিড় বেশি হবে। আর ভক্তদের আড়ালে তখন কিন্তু সাপও ঢুকে যেতে পারে।

পুনশ্চ: রবিবার রাত পৌনে ৯টায় আটক ৪ মাশরাফি ভক্তকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
লেখক: সাংবাদিক
ইমেইল:[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ