X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইমরানের সঙ্গে আলাপচারিতা

হারুন উর রশীদ
১১ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:৫৭আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০১৬, ১৯:২৭

হারুন উর রশীদ ইমরান ২০১৫ সালে এইচএসসি পাস করেছে। দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তির সুযোগও পেয়েছিল। কিন্তু পছন্দের বিষয় পায়নি বলে আর ভর্তি হয়নি।  এবারও চেষ্টা করছে। তার পছন্দের বিষয়ের মধ্যে আছে ট্রিপল ই, সিএসই প্রভৃতি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার পছন্দের তালিকায়, আগামী মাসে ভর্তি পরীক্ষা আছে। সে তখন ঢাকায় আসবে। আমার সঙ্গে দেখা হবে।
ইমরানকে আমিই বলেছি দেখা করার কথা। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে। ফেসবুকেও আলাপচারিতা হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে আমি বার বার ইমরানের মানসিক গঠন বোঝার চেষ্টা করেছি। তবে সেই বোঝার চেষ্টা এখনও শেষ হয়নি। আমি আরও বুঝতে চাই। জানতে চাই ইমরানকে। বই পড়ার মতো ইমরানকেও আমি পড়তে চাই। কারণ আমি জানতে চাই কিভাবে এই তরুণের মানসিক গঠন এরকম হলো। এ থেকে আমরা কোনও উপসংহারে পৌঁছতে পারি কিনা।
ইমরান এখন সিলেটের টিলাগড় এলাকার একটি মেসে থাকে। আর ১০টি সাধারণ তরুণের মতো আড্ডা দেয়। সেলফি তোলে। বিকেলে হাঁটতে বের হয়। তার ফেসবুক পেজ পর্যবেক্ষণ করে আমি দেখেছি সাধারণ তরুণরা যা করে ইমরানও তাই।
প্রশ্ন হলো তাহলে ইমরানের মধ্যে অসাধারণ হওয়ার বিষয়টি কোথায়? ৩ অক্টোবর সিলেটে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে আর সবার মতো ইমরান ভয়ে পিছিয়ে না থেকে বা ভিডিও না করে কেন সরাসরি খাদিজা বেগম নার্গিসকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেল! আমি যতবার ইমরানের সঙ্গে কথা বলেছি খুটিয়ে খুটিয়ে পুরো ঘটনা এবং আশপাশের পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেছি। এর মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি ইমরান কি পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে এই সাহসী মানবিক কাজে এগিয়ে গেছে? না বিপদ হতে পারে জেনেই একজন মানুষকে রক্ষায় এগিয়ে গেছে?
এই প্রশ্নের জবাবে ইমরান সব সময়ই একই কথা বলেছেন, ‘আমার কাছে ভাবার সময় ছিল না। আমি দেখলাম একটু দূরে চারপাশে অনেক লোক দাঁড়িয়ে, আর রাস্তার ওপর রক্তাক্ত একটি মানুষ পড়ে আছে। মনে হলো তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিত। আমি এগিয়ে গেলাম। সবাইকে ডাক দিলাম- আসুন।  এলেন মাত্র আমার মতো আর দু’জন তরুণ। আমরা একটি সিএনজি অটোরিকশা ডেকে আপুকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। আর কেউ আসলো কী আসলো না সেটা ভাবারও সময় ছিল না’।

এটা স্পষ্ট যে ইমরানের কাছে তখন একজন আহত মানুষকে হাসপাতালে নেওয়াই সবচেয়ে জরুরি মনে হয়েছে। তার কাছে মনে হয়েছে এখন এটাই মানুষ হিসেবে তার প্রথম কাজ। সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরও ইমরান নার্গিসের চিকিৎসার জন্য পাঁচ ঘণ্টা হাসপাতালে ছিল। তার জন্য প্রথম ব্যাগ রক্ত ইমরানই দেয়। সে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজনীয় ওষুধও কিনে আনে। তারপর আরও অনেকে রক্ত দেন। চলে আসে নার্গিসের পরিবারের সদস্যরা। পরে নার্গিসকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে পাঠানো হয়।

নার্গিসকে কোপানোর শুরুতে ইমরান সেখানে ছিল না। প্রতিদিনের মতো সে তার টিলাগড়ের মেস থেকে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিল। তার মেস থেকে এমসি কলেজের মসজিদের ওই রাস্তা খুব বেশি দূরে নয়। আমি জানতে চাইলাম সে দূর থেকে কী দেখলো?

‘আমি দেখলাম চার/পাঁচশো মানুষের ভিড়, চিৎকার চেঁচামেচি শুনলাম। দ্রুত আরেকটু কাছে গিয়ে পেছন থেকে দেখলাম কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন। ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখলাম আপু রক্তাক্ত অবস্থায় পরে আছে। আমি যখন তাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাই তখনও কেউ কেউ ভিডিও করা বা ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন।’

ইমরান

ইমরানের আক্ষেপ আছে। আর সেই আক্ষেপ হলো সে যদি আরেকটু আগে আসতো! আগেই আসার কথা ছিল। তারা তিন বন্ধু মিলে বিকেলে একসঙ্গে ঘুরতে বের হয়। ওই দিন দুই বন্ধু অন্য মেস থেকে আসতে দেরি করে। তাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে শেষ পর্যন্ত সে একাই দেরি করে বের হয়। ইমরানের আক্ষেপ, ‘ওরা যদি আসতো তাহলে আমরা তিন বন্ধু আগেই সেখানে যেতাম। তাহলে শুরুতেই হয়তো আমরা প্রতিরোধে এগিয়ে যেতে পারতাম’।

কেউ প্রতিরোধে এগিয়ে যায়নি বিষয়টি নিয়ে ইমরানের তেমন সমালোচনা নেই। তার কথা, ‘হয়তো বদরুলকে তারা চেনেন। তাই ভয়ে যাননি’। বদরুল চলে যাওয়ার পরও কেন উদ্ধার করতে কেউ গেলেন না? ইমরানের জবাব, ‘তারা হয়তো ভেবেছেন, বদরুল আবার ফিরে আসতে পারে আক্রমণ করতে। তবে কেউ চাইলে বদরুলকে প্রতিরোধ করতে পারতো। এতগুলো মানুষ চারপাশে আর বদরুল ছিল একা!’

অন্যদের আচরণ নিয়ে ইমরানের সমালোচনা না থাকলেও তার আক্ষেপের শেষ নেই। সে নিজেই যেন অপরাধবোধে ভুগছে। যতবারই ফোনে তার সঙ্গে কথা বলেছি ততবারই সে একটি কথাই বলেছে, ‘সেদিন যদি বন্ধুরা আসতো, আমি যদি সময় মতো যেতাম। কেন এরকম হলো। কেন আমি সেদিন ঠিক সময়ে গেলাম না’।

ইমরানের ফেসবুকে অনেক পোস্ট। আর অনেক ছবি এখন। এরমধ্যে কয়েকটি ছবি আছে রক্তে ভেজা কাপড়ে ইমরান। নার্গিসের রক্তে ইমরানের টিশার্টও ভেসে যায়। কিন্তু এর একটি ছবিও ইমরানের পোস্ট করা নয়। ইমরানের তোলা নয়। অন্যদের তোলা ছবি ইমরানের ওয়ালে পোস্ট করা। তারমধ্যে কয়েকটি ছবি এরইমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। 

ইমরানকে ‘বীর তরুণ’ অভিহিত করে এরইমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে অনেক টেলিভিশন চ্যানেল, বিদেশি সংবাদ মাধ্যম। কিন্তু তাতে তার মধ্যে কোনও ভাবান্তর নেই। সে যেমন ছিল তেমনই আছে। 

ইমরানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম হাসপাতালে নেওয়ার পর তার ছবি তুলতে বা সেলফি করতে ইচ্ছে হয়নি কেন? তার জবাব, ‘তখনতো তাকে বাঁচানো ছাড়া আমার মাথায় অন্যকোনও চিন্তা ছিল না। আর ছবি বা সেলফি তোলার ওটা কি সময়! মানুষের জীবন যায় আর আমি সেলফি তুলবো, সেলফি করবো। কী ভাবেন আপনি?’ 

ইমরান এখন নার্গিসকে সুস্থ দেখতে চায়। সে এখনও ঢাকা আসেনি। তবে ভর্তি পরীক্ষা যখন দিতে আসবে সে তখন তার নার্গিস আপু’র সঙ্গে দেখা করতে পারবে বলে তার আশা।  কিন্ত সেই আশাতেই সে বসে নেই। দু’দিন আগে সে আমাকে ফেসবুকে ইনবক্স করে, ‘ভাইয়া গতকাল আমি নার্গিস আপুর বাবা-মায়ে’র সঙ্গে দেখা করে আসলাম’।

পরে ইমরানকে ফোন করলে সে জানায় আপুর এখনকার অবস্থা জানতেই সিলেটে তাদের বাসায় গিয়ে তার বাবা-মা’র সঙ্গে কথা বলি। আমার এখন একটিই ধ্যান-জ্ঞান আপুর সুস্থতা।

একজন ইমরান কবিরের এই ধ্যান-জ্ঞান হয়তো আমাদের অনেকের কাছে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো মনে হতে পারে। অথবা আমরা কেউ বলতে পারি আবেগী ছেলে। বাস্তবতা বোঝে না। কিন্তু ইমরানরা এরকমই। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধায় ইমরানদের বহু আগেই চিনেছিলেন। 

যারা বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলার পাঠক তারা নিশ্চয়ই নবকুমারের কথা ভেলেন নাই। যে তার সহযাত্রীদের জন্য বাঘের ভয় উপেক্ষা করে বনে ‘কাষ্ঠ আহরণ’ করতে গিয়ে আর ফেরেন নাই। সহযাত্রীরা তাকে ‘ব্যাঘ্রে’ খেয়েছে মনে করে ভয়ে তাকে রেখেই চলে গিয়েছিলেন।  

আর বঙ্কিম তখন বলেন, ‘ইহা শুনিয়া যদি কেহ প্রতিজ্ঞা করেন, কখনও পরের উপবাস নিবারণর্থ কাষ্ঠাহরণে যাইবেন না, তবে তিনি উপহাসাস্পদ। আত্মোপকারীকে বনবাসে বিসর্জন করা তাহাদিগের প্রকৃতি, তাহারা চিরকাল আত্মোপকারীকে বনবাস দিবে, কিন্তু যত বার বনবাসিত করুক না কেন, পরের কাষ্ঠাহরণ করা যাহার স্বভাব, সে পুনর্বার পরের কাষ্ঠাহরণে যাইবে।’

ইমরান আমাদের এযুগের নবকুমার তার বিপদ জেনেও অন্যের উপকারে এগিয়ে যাবেন। তারা নিজের জীবন উপেক্ষা করেও অন্যের জীবন বাঁচাবেন। এরকম ইমরানরা আমাদের সমাজে আছেন বলেই আমরা সভ্য সমাজে বসবাস করি। তারা বনের মোষ তাড়ায় বলেই মোষরা লোকালয়ে আসতে পারে না। 

এই ইমরান এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পছন্দের সাবজেক্ট পড়তে চায়।  জানি মেধার ভিত্তিতেই ভর্তি করাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এটাইতো স্বাভাবিক নিয়ম। ইমরান বলেনি আমাকে। আমি নিজ থেকে বলছি। ইমরানের মতো নবকুমাররা যাতে পছন্দের উচ্চশিক্ষা নিতে পারে সেজন্য তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো একটু উদারতা দেখাতে পারে। ইমরানরাতো আমাদের সভ্যতার আলো দেখিয়েছে। মানবিকতার পাঠ শিখিয়েছে। আমরা কেন পারবো না?

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ