X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াত পাঠ

হারুন উর রশীদ
১৮ অক্টোবর ২০১৬, ১৯:০৩আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৬, ২১:১০

হারুন উর রশীদ মকবুল আহমাদ জামায়াতের নতুন আমির হিসেবে শপথ নিয়েছেন সোমবার রাতে। আর শপথ নেওয়ার পরই তিনি তার লিখিত বক্তব্যের একটি কপি পাঠিয়েছেন সংবাদমাধ্যমে। মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হওয়ার পর অনেকেই বিচারকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটা রাজনৈতিক নাটক মনে করেছিলেন। এমনকি জামায়াত নিজেও ভাবতে পারেনি যে তাদের শীর্ষ নেতাদের এইভাবে একের পর এক ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তাই হয়েছে। একারণেই সবদিক দিয়ে কোণঠাসা জামায়াত শেষ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব রক্ষায় কোনদিকে যায় তা দেখতে আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশ আগ্রহী ছিলাম। সোমবার জামায়াতের নতুন আমির মকবুল আহমাদের লিখিত বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমি সেটা কিছুটা হলেও তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
আমার ধারণা কেউ কেউ এরইমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তার দীর্ঘ লিখিত বক্তব্যের চুম্বক অংশ পড়েছেন। আমি তার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি না করে মূল ভাব তুলে ধরার চেষ্টা করছি-
১. বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আত্মত্যাগকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা।
২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে স্বীকার করা।
৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মাওলানা ভাসানী, এম এ জি ওসমানীসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা।
৪.  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া পাঁচ জামায়াত নেতা শাহাদাৎ বরণ করেছেন। তারা জুলুমের শিকার হয়েছেন।
৫. দেশের সংকট থেকে উত্তরণে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংলাপের আহ্বান।

৬. ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

৭. নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিহার করে ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান। দলের মধ্যে গঠনমূলক সমালোচনার পরিবেশ তৈরি করা।

৮. ইসলামের নামে চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি।

আমি যা বুঝতে পারি-

জামায়াত ইসলামী যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ এবং মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসলেও মকবুল আহমাদের লিখিত বক্তব্যে তা অনুপস্থিত। এমনকি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কারাগারে আটক জামায়াত নেতাদের বিচার বন্ধ বা মুক্তির দাবি করেননি তিনি। করেননি বিচারের সমালোচনা। শুধু বলেছেন তারা জুলুমের শিকার হয়েছেন। সেই জুলুম কিভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় তা স্পষ্ট করেননি জামায়াতের নতুন এই কাণ্ডারি।

তার বক্তব্যে দলের মধ্যে মতভেদের বা মতপার্থক্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে তা কী ধরনের তা তিনি স্পষ্ট করেননি। একই সঙ্গে দলের মধ্যে যে সমালোচনা তেমন গ্রহণ করা হতো না তাও স্পষ্ট।

মকবুল আহমাদ মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের ‘শহীদ’ বা তারা শাহাদাৎ বরণ করেছেন বলে উল্লেখ করেননি। বলেছেন তাদের আত্মত্যাগ। বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যে পাঁচজন জামায়াত নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে তাদের শাহাদাৎবরণকারী বলে উল্লেখ করেছেন। আর মুক্তিযুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে তাদের ব্যাপারে তিনি নীরব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বলে উল্লেখ করলেও তাঁর নামের আগে ‘জাতির জনক’ শব্দটি ব্যবহার করেননি তিনি।

ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেননি মকবুল আহমাদ। বলেছেন ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা। একই সঙ্গে ইসলামের নামে চরমপন্থা বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার দলের জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানান।

তাহলে যা দেখা যাচ্ছে মকবুল আহমাদ যা বলেছেন তাতে জামায়াত তার পুরনো নীতি থেকে সরছে না। তবে কৌশলে কয়েকটি বিষয় সামনে এনে সরকারের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর নীতি থেকে না সরলেও পুরানো নেতৃত্ব আকড়ে ধরে থাকতে চাইছেন না তিনি। তিনি চাইছেন না যারা গেছেন তাদের নিয়ে আর তেমন ভাবতে। চান না আরও যারা যাবেন তাদের জন্য আর সময় নষ্ট করতে। তাদের জন্য যেটুকু না বললেই নয় তাদের জন্য সেটুকুই বলেছেন তিনি।

যে কারণে কৌশল:

এর কারণও আছে আমার কাছে মনে হয়। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের তাদের আগের লাইনের পুরোপরি ব্যর্থতা তাকে নতুন উপলব্ধি দিয়েছে অথবা ব্যর্থতাকে ভেতরে রেখে জামায়াত রক্ষায় কৌশলী হয়েছেন তিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালে তাদের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সব কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে তারা আড়াই কোটি ডলার ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট ফার্ম কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটকে নিয়োগ করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফল আসেনি। তাদের প্রধান মিত্র সৌদি আরব কেন সহায়তা করেনি। তুরস্ক শেষ পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিয়েছে। তাদের একমাত্র মিত্র হিসেবে আছে শুধু পাকিস্তান জামায়াত ও পাকিস্তান। আর শুরুতে ‘স্বচ্ছতার’ কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে একধরনের অবস্থান নিলেও পরে তারা অবস্থান বদলায়।

যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের জন্য জামায়াত দেশের অভ্যন্তরেও ব্যাপক সক্রিয় ছিল। বিশেষ করে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করার পর দেশের অন্তত ৩৪টি জেলায় জামায়াত ব্যাপক নাশকতা চালায়। আর শুরু থেকে হরতাল ও নাশকতা তো ছিলই। কিন্তু এই নাশকতা জামায়াতের বিরুদ্ধেই গেছে। জামায়াত ‘সন্ত্রাসী’ দল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আর এখন বলছে ইসলামের নামে সন্ত্রাস সহিংসতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা।

ইতিহাস কী বলে

১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট এই উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর যাত্রা শুরু হয় ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ নামে। দলটির প্রতিষ্ঠা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক। এই দলটির ইতিহাস সব সময়ই গণবিরোধী ভূমিকা নেওয়ার। আর সময় বুঝে খোলস পরিবর্তন করার।

১৯৪৭ সালে জামায়াতে ইসলামী দেশ বিভাগের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তারা তখন মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র চায়নি। পরে সুযোগ বুঝে মওদুদী পাকিস্তানে হিযরত করেন। প্রতিষ্ঠা করেন জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। বাংলাদেশ অংশের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী। যার প্রধান ছিলেন গোলাম আযম।  ১৯৬৪ সালে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়। আর দাঙ্গা বাধানোর অভিযোগে মওদুদীর ফাঁসির আদেশও হয়েছিল পাকিস্তানে। পরে যাবজ্জীবন এবং আরও পরে তিনি ছাড়া পান।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আবারও গণবিরোধী ভূমিকা নেয় জামায়াত। তারা শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই করেনি; গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আছে দলটির বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়।

বাংলাদেশ পর্ব

তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সুযোগ করে দিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে জামায়াত কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই পালিয়ে যাওয়া গোলাম আযম ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে ফিরে এলে  জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে কাজ শুরু হয়। পরে তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করে, সংসদে যায় মন্ত্রী হয়- যা সবার জানা।

তবে এখন আর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নয়। নির্বাচন কমিশন ২০১৩ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের পর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় নিবন্ধন বাতিল করা হয়। যদিও জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ-এর পরিবর্তে এখন তারা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নাম ধারণ করেছে।

আর মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাধিক রায়ে জামায়াতকে দল হিসেবে সন্ত্রাসী এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিহিত করেছে। এই ধরনের দলের বিচারে আইনও হয়েছে।

তাই দল হিসেবে জামায়াত যে চরম কোণঠাসা অবস্থায় তা আর ব্যখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। এমনটি তার প্রধান মিত্র বিএনপিও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতাদের ফাঁসির পর ছিল নিশ্চুপ।

আবারও খোলস পরিবর্তন!

জামায়াতে ইসলামী বাংলা ট্রিবিউনকে পাঠানো এবং প্রতিবাদ লিপিতে মকবুল আহমাদকে ‘ক্লিন ইমেজ’-এর অধিকারী একজন নেতা বলে দাবি করেছে। তবে বাংলা ট্রিবিউন তার প্রতিবেদনে বলছে, ‘মকবুল আহমাদ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফেনীর দাগনভুঁঞা এলাকার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। আর তার নির্দেশে দাগনভুঁঞা উপজেলার জয়লস্কর ইউনিয়নের লালপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় আগুন দিয়ে ১০ জনকে হত্যা করা হয়।’

আমার কাছে মনে হয়েছে ‘ক্লিন ইমেজে’র এই দাবি একই সঙ্গে জামায়াতে ‘ডার্টি ইমেজে’র নেতা আছে বা ছিল’র কথা মনে করিয়ে দেয়। যে প্রেক্ষাপটে ক্লিন ইমেজের দাবি সেই প্রেক্ষাপটটা হলো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, যুদ্ধাপরাধ।

আগেই বলেছি জামায়াত বরাবরই একটি গণবিরোধী দল- ১৯৪৭, ১৯৭১ এবং ২০১৩ সালে তারা তার প্রমাণ রেখেছে। গণবিরোধী ভূমিকার পর প্রতিবারই তারা খোলস পাল্টে মাঠে নেমেছে সুযোগ বুঝে। এবং সময়মত তারা তাদের গণবিরোধেী চরিত্র প্রকাশ করেছে। এবারও তারা খোলস পরিবর্তন করছে বলেই আমার মনে হয়। কারণ জামায়াতের নতুন আমির মকবুল আহমাদ গত ছয় বছর ধরে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন। মুখে যাই বলুন না কেন, তিনি তো জামায়াতেরই আমির। তাই সময় আসলে আবারও এই দলটির গণবিরোধী ভূমিকা দেখা যাবে বলেই আমার ধারণা। আর তা না হলেতো ইতিহাসের ধারাই বদলে যাবে। আমরা তাই সেই অবস্থা দেখার অপেক্ষায় থাকবো, না জামায়াতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব?

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: ঝরে গেলো আরেকটি প্রাণ
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: ঝরে গেলো আরেকটি প্রাণ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ