X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কবে হিন্দু কাঁদবে মুসলমানের জন্য, মুসলমান হিন্দুর জন্য!

রোকেয়া লিটা
০৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ২০:১৪আপডেট : ২১ মার্চ ২০১৭, ১৩:২৮

রোকেয়া লিটা ফেসবুক বর্তমানে সবচে বড় কসমোপলিটন নগরী। বিশ্বের কোথাও কিছু ঘটে গেলে সঙ্গে-সঙ্গে এই নগরীর বাসিন্দারা প্রতিক্রিয়া জানান। তবে ফেসবুকে সবাই কিন্তু সক্রিয় নন। কেউ কেউ শুধু শেয়ার করেন, কেউ কেউ ছবি পোস্ট করেন। আবার অনেকেই কোনও কিছু পোস্ট করেন না, শুধু অন্যদের ছবি বা লেখায় লাইক অথবা কমেন্ট করে বেড়ান। ফেসবুকে নিয়মিত লেখালেখি করেন, এমন মানুষের সংখ্যা আসলে খুব বেশি নয়, বেশিভাগই অন্যের লেখায় সক্রিয়তা দেখান। আত্মীয়, বন্ধু মিলিয়ে এমন অনেকেই আছেন আমার ফেসবুকের বন্ধু তালিকায়।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার যে আত্মীয়াটি কখনও ফেসবুকে কিছু লেখে না, সে হঠাৎ বিশাল একটি লেখা পোস্ট করেছে ফেসবুকে। তার লেখার বিষয় হলো—মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা। মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে ভীষণ রকমের ঘৃণার প্রকাশ ঘটেছে তার লেখায়। গত কয়েকদিনে এমন অনেককেই দেখলাম, যারা কখনও কিছু লেখেন না কিন্তু মিয়ানমার প্রসঙ্গে কিছু না লিখে বা পোস্ট করে বসে থাকতে পারেননি। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের বিষয়টি তাদের প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। অথচ এই মানুষগুলোই আবার বাংলাদেশে সাঁওতালদের ওপর, হিন্দুদের ওপর নির্যাতন হওয়ার পর চুপ করে বসে ছিল। তার মানে হিন্দু ও সাঁওতালদের ওপর নির্যাতন তাদের মনে কোনও দাগ কাটেনি একটুও!
আরও অনেক ভিন্ন চিত্র দেখলাম। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হলে, যারা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার থাকেন, তারা আবার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে একেবারেই চুপ। এমনকি আমার ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় যেসব অমুসলিম বন্ধু আছেন, তাদের মধ্যে হাতে গোনা দু-একজনকে দেখেছি রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে সরব হতে। তাদের বেশিভাগই রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে নীরব। তার মানে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের মনে দাগ কাটছে না! এরাই আবার যখন হিন্দু নির্যাতন, সাঁওতাল নির্যাতন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মানবতার বুলি আওড়াবেন। কেমন বেমানান লাগে না বিষয়টা?

আমাদের বন্ধনগুলো ভীষণ সাম্প্রদায়িক। আমরা সবাই এখনও নিজেদের সমানভাবে একই দেশের নাগরিক ভাবতে পারি না, কারণ আমরা একই ধর্মের অনুসারী হয়ে বসে আছি। আমরা মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি, অথচ আমরা দিব্যি ধার্মিক হয়ে বসে আছি। তাহলে কী দাঁড়ালো? হিন্দুর ওপর নির্যাতন হলে শুধু হিন্দুরাই প্রতিবাদ করবে আর মুসলমানের ওপর নির্যাতন হলে শুধু মুসলমানরাই প্রতিবাদ করবে। এর ফল কিন্তু ভয়াবহ। নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন আর রোহিঙ্গাদের গণহত্যাই হলো, আমাদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ভয়াবহ চিত্র। আমরা অনেকেই হয়তো সশরীরে গিয়ে নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িতে আগুন লাগাইনি, কিন্তু আমাদের নীরবতা, প্রতিবাদ না করার প্রবণতাও কিন্তু হামলাকারীদের শামিল।
আমি জানি, আমার সঙ্গে তর্ক করার জন্য লোকের অভাব হবে না। অনেকেই বলবেন, নাসিরনগরের ঘটনা আর রোহিঙ্গাদের ঘটনা এক নয়। অনেকে বলবেন, রসরাজ নামের ওই যুবক মক্কা শরীফের ছবি বিকৃত করে ফেসবুকে ছাড়লো কেন? জ্বী জনাব, আপনাকেই বলছি, রসরাজের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তাতে কিন্তু প্রমাণিত হয়নি যে, ওই কাজটি রসরাজই করেছে। হতে পারে, রসরাজের ফেসবুকে আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে অন্য কেউ এই কাজটি করেছে। আর ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়া তো খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়, হরহামেশাই মানুষের ফেসবুক আইডি হ্যাক হচ্ছে। এছাড়া রসরাজ যদি কোনও অপরাধ করেই থাকে, তাকে তো পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, তার শাস্তি কেন রসরাজের পরিবার বা পাড়া-পড়শীকে ভোগ করতে হবে? বাংলাদেশে মুসলমান বেশি, তাই অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে এই অমানবিক নির্যাতন। পত্রিকাগুলো বলছে, ওই ঘটনার পরপরই নাসিরনগরের হিন্দু পরিবারগুলো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরিস্থিতি সাভাবিক হলে, আবারও তারা ফিরে আসে। কিন্তু রসরাজের পরিবার নাকি এখনও ফিরে আসেনি। আমাদের মধ্যেই যারা রোহিঙ্গাদের জন্য কাঁদেন, তারা কি নিজেদের দেশেই হিন্দু আর সাঁওতালদের কথা ভাবছেন?

ওদিকে দেখুন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেও কিন্তু অভিযোগ আছে। অক্টোবরে মিয়ানমারের মংডুতে যখন বিজিপির ছাউনীতে দুষ্কৃতকারীদের হামলায় ১৪ জন নিহত হলেন, তখন কিন্তু এই হামলার দায় গিয়ে পড়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)-এর ওপর। আর তারপরই কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন, গণহত্যা বাড়তে থাকে। অর্থাৎ সেদেশেও একই চর্চা চলছে। শুধু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তারা মুসলমানদের জাতিগতভাবে নিধন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু মিয়ানমারে বৌদ্ধদের সংখ্যা বেশি, তাই তারাও তাদের সংখ্যাগুরুত্বের মহড়া দিয়ে যাচ্ছে।
এই তো হচ্ছে দেশে দেশে। মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবী থেকে জাতিগত বৈচিত্র্যের ব্যাপারটা কি উঠেই যাচ্ছে? এভাবে চলতে থাকলে তো, সংখ্যাগুরু মুসলমানের দেশে শুধু মুসলমানরাই থাকবে, সংখ্যাগুরু হিন্দুদের দেশে শুধু হিন্দুই থাকবে আর সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের দেশে শুধু বৌদ্ধরাই থাকবে। আমরা কি আর কখনও মানুষ হয়ে উঠব না? নাকি যুগের পর যুগ ধরে বয়ে চলা ধর্মীয় হানাহানি টেনে নিয়েই চলব?

মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি এমন একটা সকাল আসতো, ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পেতাম, হিন্দু ও সাঁওতালদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে আন্দোলন করছে বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলো। আর ওদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধন করছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ! পৃথিবীটা বদলে যেতে সময় লাগতো না একটুও। পরিবর্তনটা শুরু হোক না বাংলাদেশ থেকেই, ক্ষতি কী? যার যার ধর্ম তার তার সঙ্গেই তো থাকছে।

লেখক: সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ