X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাঁওতাল পোড়ে পুলিশের আগুনে!

হারুন উর রশীদ
১২ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৩৯আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৯:৩১

 

হারুন উর রশীদ একটি ভিডিও ফুটেজ এখন অনেক কিছুই স্পষ্ট করে দিয়েছে। বিতর্ক ছিল গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীতে কে আগুন দিয়েছে? এতদিন যে ছবি ও ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে, তাতে স্পষ্ট ছিল পুলিশের উপস্থিতেই দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। কিন্তু না, বাংলা ট্রিবিউন সর্বশেষ সোমবার (১২ ডিসেম্বর) যে সাড়ে তিন মিনিটের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে, তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই আগুন দেওয়া শুরু করেন। এরপর পুড়তে থাকে সাঁওতাল, সাঁওতালদের ঘরবাড়ি, গ্রাম, মানবতা। সেই ‘মহান সাঁওতাল’ পোড়ানোর দৃশ্যে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত পুলিশ যে ভূমিকা নিয়েছে, তা ভাবতেও আমার লজ্জা আর ঘৃণা হচ্ছে!
গত ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জে সাঁওতালদের জমিতে চিনিকলের আখ কাটাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পর সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনার পর একমাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে স্থানীয় এমপি, ইউপি চেয়ারম্যানসহ আরও অনেককে দায়ী করা হয়েছে। সাঁওতালদের দায়ের করা মামলায়ও ওইসব ব্যক্তিসহ ৩৩ জন আসামি। কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। না তদন্ত কমিটির, না সাঁওতালদের।
সাঁওতালদের বিষয়টি বোঝা যায়। আগেই পুলিশের হামলা-মামলায় বিপন্ন সাঁওতালরা কোন সাহসে মামলা করবে পুলিশের বিরুদ্ধে? তাহলে তদন্ত কমিটি কী করলো? তারা কেন পুলিশকে বাঁচালো? দেশের সর্বোচ্চ আদালত গাইবান্ধার ডিসি-এসপিকে তলব করেছে। তবে তা সাঁওতালদের ঘরবাড়ি পোড়ানো নিয়ে নয়। তদন্ত প্রতিবেদনে একটি শব্দ নিয়ে। শব্দটি হলো—‘বাঙালি দুস্কৃতকারী’।
এবার আমি সর্বশেষ প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজটি সংক্ষেপে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

দৃশ্য-১:

২৫/৩০ জন সশস্ত্র পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য টর্গেট করে গুলি করতে করতে সাঁওতালদের একটি বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে সাদা পোশাকেও কয়েকজন আছেন।

দৃশ্য-২:

সাঁওতালদের একটি ঘরের সামনে গিয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে ৩/৪ জন পুলিশ সদস্য দরজা ও আশপাশে লাথি মারছেন। বাকিরা পেছনে। তখন পুলিশের মধ্যে থাকা গোলাপি পোশাক পরা এক তরুণ দৌড়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যান।

দৃশ্য-৩:

এক পুলিশ সদস্য ঘরে আগুন দেন। তার সঙ্গে যোগ দেন গোলাপি পোশাকপরা ওই তরুণ।

দৃশ্য-৪:

ওই পুলিশ সদস্য আরও কয়েক জায়গায় আগুন দিয়ে বিস্তৃত করে দেন। তার সহায়তায় সাদা পোশাকপরা আরও এক তরুণ এগিয়ে আসেন। পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশ-র‌্যাবের বাকি সদস্যরা।

দৃশ্য-৫:

পুলিশের দেওয়া আগুন থেকে আগুন নিয়ে সাদাপোশাকের তরুণরা তা আরও ছড়িয়ে দেন।

দৃশ্য-৬:

বাড়িটি পুড়ে ছাই না হওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা  বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন।

দৃশ্য-৭:

পরের বারিটির দিকে এগিয়ে যায় পুলিশ র‌্যাব।  একের পর এক বাড়িতে আগুন জ্বলে। নির্ভার পুলিশ বাড়ির চারপাশে ঘোরে, দেখে। আগুন নেভানোর কোনও তৎপরতা নেই।

দৃশ্য-৮:

সব বাড়ি পুড়ে কয়লা হওয়ার পর নিশ্চিন্তে চলে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। 

এই দৃশ্য আরও ভালো করে বোঝার জন্য এই কলামের সঙ্গে দেওয়া ভিডিও ফুজেটি চাইলে আপনারা একবার দেখে নিতে পারেন। আমি ভিডিও ফুটেজে যা দেখেছি, তার সংক্ষিপ্ত একটি ভাষাচিত্র উপস্থাপন করলাম। এবার এই পরিস্থিতির একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছি। ভিডিও ফুটেজটি এখানে সংযুক্ত করা হলো- 

 

এক. সাঁওতালদের বাড়ি-ঘরে পুলিশ সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে আগুন দিয়েছেন। আর তারাই এই আগুন দেওয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাদা পোশাকে যারা ছিলেন, তারা পুলিশের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন।

দুই. সাঁওতালদের প্রতি পুলিশের প্রচণ্ড ঘৃণা আর আক্রোশ প্রকাশ পেয়েছে। আগুন দেওয়ার আগে সাঁওতালদের ঘরে প্রচণ্ড আক্রোশে লাথি মারে , আক্রমণ করে পুলিশ।

তিন. পুলিশ চেয়েছে সব বাড়ি যেন পুড়ে কয়লা হয়ে যায়।  সে কারণেই পুলিশ সদস্যরা আগুনে পুড়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন।

চার. এটা তাদের একটি মিশন ছিল। আর এই জঘন্য মিশন পুলিশের ওপরের নির্দেশ ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না।   

আপনারা এরই মধ্যে সাঁওতালদের উচ্ছেদ ও তাদের জমি দখলে স্থানীয় এমপি, ইউপি চেয়াম্যানসহ ভূমিদস্যু ও চিনিকল কর্তৃপক্ষের ভূমিকার কথা জেনে গেছেন। সাঁওতাল রক্ষার কথা বলে  তারাই সাঁওতাল বিতাড়নের ছক করেছেন।

কিন্তু পুলিশ কেন যুক্ত হলো এই অভিযানে? আর এখন স্পষ্ট যে, আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নেতৃত্বেই সাঁতালদের বাড়ি-ঘর পোড়ানো হয়েছে। লুটপাটকারীরা তাদের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। আর এই আগুন দেওয়ার সময় সাঁওতালরা তাদের বাড়িতে থাকলে তাদের ওপর যে, রোজ কেয়ামত নেমে আসতো তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

এই আগুন দেওয়ার আগে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। আর সেখানে সাঁতালরা পুলিশের বন্দুক এবং টিয়ার গ্যাসের মোকাবিলায় তীর ধনুক ব্যবহার করেছেন। তিন সাঁওতাল নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। আর পুলিশের ৯ সদস্যও আহত হয়েছেন। পুলিশের কি তিন সাঁওতালকে মেরেও ক্ষোভ মেটেনি? মনে হয় মেটেনি। তাই তারা প্রবল ঘৃণা ও আক্রোশে সাঁওতালদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়েছে। আমার মনে হয় ক্ষোভের বাইরে পুলিশ নেপথ্যের শক্তির কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। ভাড়াটে বাহিনীর কাজ করেছে।

সরকারের একটি ডিসিপ্লিনারি ফোর্স যে জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে, তা কোনোভাবেই আইনের ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। এরসঙ্গে আত্মরক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই। এটি ক্রিমিনাল অফেন্স বললেও কম করে বলা হবে। এটি একটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জঘন্য-প্রক্রিয়া। যা আমরা একাত্তরে দেখেছি। দেখেছি বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর আচরণে। সাঁওতালদের ওপর একই আচরণের এই দায় রাষ্ট্র কিভাবে এড়াবে?

শুরুতেই আমি বলেছি, ‘মহান সাঁওতাল’। এই মহান কোনও আরোপিত শব্দ নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তাদের মহত্বের কথা। এই সাঁওতালরাই প্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারে তারা দাদনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জীবন দিয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন ১৯ বীর সাঁওতাল। যা ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত-পরিচিত সাঁওতাল হুল নামে।

আর বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অসামান্য অবদান রয়েছে। দিনাজপুরে ১ হাজার সাঁওতালের মুক্তিবাহিনী গঠনের কথা অনেকেরই জানা। মুক্তিযুদ্ধে সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৬০২ জন শহীদ হয়েছেন।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চানপুর চা বাগানের বীরাঙ্গনা হিরামনির বীরত্ব গাঁথা হয়তো অনেকেই জানে না। এই হীরামনি শাঁওতাল চা শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম নারী যিনি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন। পাক হায়েনাদের বর্বর নির্যাতনের শিকার হন। বীরঙ্গনা হিরামনি বেঁচে নেই। গত মার্চে ৬৮ বছর বয়সে মারা যান।

হীরামনির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বেঁচে থাকা সাঁওতালদের যে নির্মূলকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার জবাব দেবে কে? যারা দেশ স্বাধীন করেছেন, ব্রিটিশদের তাড়িয়েছেন, এখন তারাই তাড়া খাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে। পুড়ছেন তারা। পুড়ছে মহান সাঁওতাল।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ