X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘আমি নারীবাদী নই’

সাদিয়া নাসরিন
২৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:১৫আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৩৮

সাদিয়া নাসরিন পুরুষতন্ত্রের নতুন ভাষা, খেলার নতুন চাল। অনেক নারী এখন পুরুষের এই ভাষায় কথা বলছেন। আমি এরকম প্রচুর নারী দেখেছি যারা নারীমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে থাকেন, নারী নীতি খসড়া করেন, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেন, লেখেন তারপর- ‘আমি নারীবাদী না’ বলে ঘোষণা দেন। এই নারীরা যখন স্পষ্টভাবেই বলেন যে, ‘আমি নারীবাদী নই’, তার অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, নারীবাদী হওয়া একটা অপরাধ এবং নারীবাদীরা ভুল পথে চলছেন।
নারীদের এই বিভক্তি আর ভয়ই পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে যুগ যুগ ধরে। পুরুষতন্ত্রের রাজনীতি ঠিক এটাই চায় যে, নারীদের মধ্যে আদর্শিক বন্ধন গড়ে না উঠুক, নারীরা বিভক্ত হোক। কারণ, পুরুষতন্ত্রকে আরও হাজার বছর টিকিয়ে রাখতে হলে নারী অধিকার আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, নারীদের মধ্যে অনৈক্য নিয়ে আসা, এবং পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো ভালো অস্ত্র আর কী আছে পুরুষের হাতে? এই ফাঁদে পা দিয়ে নারীরা বিভক্ত হয়, দ্বিখণ্ডিত হয়। একদল বলে তারা নারীবাদীই নন, আবার একদল প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে তারা ‘ভালো’ নারীবাদী আর অন্যরা ‘খারাপ’ নারীবাদী। আর এই বিভক্ত নারীরা নারীবাদ না পড়ে, না জেনে, না বুঝে বিভেদ বাড়িয়ে শুধু পুরুষতন্ত্রকে দীর্ঘজীবী করেন।
পুরুষ জানে ঐক্যবদ্ধ নারী আন্দোলন বা নারীবাদ পুরুষতন্ত্রের ঠিক কোন জায়গায় আঘাতটা করে। তাই নারীবাদ নিয়ে এত ট্যাবু তৈরি করা হয়েছে, এত অপবাদ দেওয়া হয়েছে, বিতর্ক হয়েছে যে, অনেক ক্ষমতাবান নারীই এখন এই মতবাদকে স্বীকার করতে ভয় পান। ‘নারীবাদের সঠিক তথ্যের চেয়ে বিকৃত তথ্য অনেক বেশি পেয়েছি আমরা। পুরুষতন্ত্র একথা প্রচার করতে সফল হয়েছে যে, নারীবাদ হচ্ছে বিকার। নারী অধিকার কর্মীরাও তাই নারীবাদের কথা শুনলে ভয় পান, নিজেদের নারীবাদী বলতে নববধূর মতো লজ্জা পান’(হুমায়ুন আজাদ, নারী)।
কিছুদিন আগে একজন নারীমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপে তিনি বলছিলেন, ‘যেদিন নারীরা তুচ্ছ শাড়ি গয়নার লোভকে পেছনে ফেলে শিক্ষিত হবে, রোজগার করবে, পরিবারে অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ করবে, সেদিনই সমমর্যাদা পাবে।’ তার কথা শুনে আমি খুব আশাবাদী হয়ে সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার, অবিভাবকত্ব আইন নিয়ে কথা তুলতেই তিনি থেমে যান। তারপর বলেন, ‘এসব নারীবাদী ইস্যু তুলে সমাজে অহেতুক টেনশন তৈরি করার দরকার নেই।’ এসব নারীবাদী ইস্যু! নারীবাদ নিয়ে তার এবং ক্ষমতাবান অনেক নারীরই যে শঙ্কা বা সংস্কার তা পুরোই রাজনৈতিক, যেখানে পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আছে।
পুরুষতন্ত্র আসলে নারীর বাইরের জগৎ নিয়ন্ত্রণ করেই থামেনি, মনোজগতও নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেক নারীই তাই নারীর বিরুদ্ধে সক্রিয় হন এবং পুরুষের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য  নারীবাদ শব্দটির গায়ে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে চলেন। পুরুষের শেখানো ভাষাতেই এই নারীরা সমঅধিকারের লড়াই করা নারীদেরকে ‘তসলিমা নাসরিন, নাস্তিক, ডিভোর্স প্রমোট করা, পরিবার অস্বীকার করা, বাচ্চা ঘৃণা করা, পুরুষবিদ্বেষী, ঝগড়াটে, অ্যারোগেন্ট, মেয়েলি(?)কাজ ঘৃণা করা, পুরুষ হতে চাওয়া মেয়ে বলে স্টিগমাটাইজ করেন। ডেমি রেবেকা ওয়েস্ট, একজন ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নারীবাদ কী আমার ঠিক জানা নেই। আমি শুধু জানি, যখনই আমি আমার ভেতরের আমিকে প্রকাশ করি এবং তা আমাকে পা মোছার পাপোস বা বেশ্যা হওয়া থেকে আলাদা করে, তখনই লোকে আমাকে নারীবাদী বলে ডাকে।’

আবার এমন অনেক নারী আছেন, যাদের কাছে নারীবাদ যে স্বাধীনতার কথা বলে তা রীতিমত বিরক্তিকর। কারণ, এই শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত নারীদের জীবন দর্শনটি খুবই নিরুপদ্রপ যেখানে তারা চান স্বামীরা তাদের এটিএম মেশিন হয়ে তাদের জীবনকে সচ্ছলতায় ভরিয়ে রাখবে। ওরা জানে এই জীবনে অপমান আছে, উপেক্ষা আছে, নিয়ন্ত্রণ আছে, মানিয়ে চলার ক্লান্তি আছে। তবু ওরা এই ঝুঁকিহীন জীবনকেই পছন্দ করে, পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বকে সমীহ করে এবং একেই ‘সুখি নারীর’ আদর্শ হিসেবে ব্র্যান্ডিং করে। তাই তারা পুরুষতন্ত্রের সুবিধাভোগী হয়ে নিজেরা স্কুল মাঠের ভাবিদের সঙ্গে আড্ডা-আউটিং, শপিং, পার্লার, জিরো ফিগার, ব্যাংস কাট আর হট পিংক লিপস্টিকের পেছনে ব্যস্ত থাকে এবং পুরুষের মুখপাত্র হিসেবে রোজগেরে স্বনির্ভর নারীদের ‘বেচারা’ হিসেবে চিহ্নিত করে, আর পুরুষ দূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়।  

পুরুষতন্ত্রের চোরাগলিতে পথ হারানো নারী এবং পুরুষরা দয়া করে অহেতুক বিভেদ আর বিতর্ক না বাড়িয়ে নারীবাদকে পরিষ্কার করে বুঝুন। খোলা মনে জেনে নিন, নারীবাদ মানেই পুরুষ বিদ্বেষ নয়, এক্সট্রিমিস্ট নয়, ডিভোর্স নয়, ফ্রি সেক্স নয়, মাতৃত্ববিরোধী নয়, পরিবার, সমাজ ছারখার করার বিপ্লবও নয়। আবার নারীবাদ মানে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণও নয়। নারীবাদ মানে প্রশ্ন তোলা, অবিরাম প্রশ্ন তোলা এবং চ্যালেঞ্জ করা। নারীবাদ একটি রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং চর্চা, যা পুরুষতন্ত্রের তৈরি সমস্ত পক্ষপাতমূলক নিয়মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে এবং ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সকল নারীকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করে। ভালো-খারাপ বিচার করার কোনও সুযোগ নারীবাদে নেই। কারণ এটিই একমাত্র মতবাদ যেখানে চূড়ান্ত বলে কিছু নেই। এটি একটি শিখন প্রক্রিয়া, এখানে আমরা সবাই শিখছি। 

নারীবাদ এমন এক জীবনব্যাপী শিক্ষার নাম, যা আমাদের মনের অস্পষ্ট ধারণাগুলোকে নতুন করে ভাবায়, নির্মাণ করে, নিজেকে চিনতে, খনন করতে শেখায়। এটি সেই মতবাদ যা আমাদের শিখিয়েছে, আমাদের স্ত্রী লিঙ্গটাই শুধু প্রাকৃতিক, আর সব কিছু সামাজিক নির্মাণ; সমাজই আমাদের মেয়েলি, পুরুষালি করে তৈরি করেছে। নারীবাদ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, বেশিরভাগ সংসারের “শান্তিপূর্ণতা” হচ্ছে সামনের ছবি, যার পেছনে নারীর স্বপ্ন, অনুভূতি, ব্যক্তি স্বাধীনতা, আবেগ এবং যোগ্যতার ভাঙা টুকরো ছড়ানো। নারীবাদ এই ভাঙা টুকরোগুলো এক করে একটি পূর্ণ, সত্যিকার শান্তির ছবি আঁকতে চায়, সমমর্যাদা ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবার গড়তে চায়। নারীবাদ মাতৃত্ব নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সেই মিথগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছে , যা নারীকে মাতৃত্বের মহিমার মধ্যে আটকে রেখে রোজগার উৎপাদন থেকে নির্বাসিত করেছে। নারীবাদ আমাদের একপেশে আপোসের দায়ভার থেকে, সম্মানহীন-অধিকারবিহীন সম্পর্ক থেকে মুক্ত হওয়ার শক্তি ও সাহস দিয়েছে, নিয়তির বিশ্বাস থেকে, নিরন্তর অপরাধবোধ থেকে, হীনমন্যতা থেকে মুক্ত করেছে।

নারীবাদ এক রোমাঞ্চকর গতিশীল ভ্রমণ, যেখানে আমরা ঘনিষ্ট সম্পর্কগুলোকে, একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাসগুলোকে পুনর্মূল্যায়ন করে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরবির্তন করতে শিখেছি। নারীবাদ এক আত্মিক যোগাযোগের নাম, যা আমাদের পূর্বনারীদের আত্মত্যাগ, আর্ত চিৎকার আর বলিদানকে বোঝার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সকল নিপীড়িত নারীর সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটার নিরন্তর পথ তৈরি করেছে। নারীবাদ আমাদেরকে সেসব নারীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, যারা আমাদের আনন্দ বেদনার সহযাত্রী, যারা আমাদের বলা এবং না বলা কথা অনুভব করতে পারে, যারা আমাদের যা ইচ্ছা আলোচনা করার, প্রাণখুলে কাঁদার অথবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার জায়গা করে দিয়েছে।

জানি তবুও অনেক নারী ভয় পান সে আগুনের আঁচকে, যে মহাশক্তিমান পুরুষতন্ত্রের আগুনে পোড়েন জোয়ান অব আর্ক, খনা, সুলতানা রাজিয়া, সীতা বা আজকের তসলিমা। তবুও আগুন লাগা এই পৃথিবীতে পথ খুঁজে নিতে হবে আমাদেরকেই। একটি সমতার পৃথিবী সৃষ্টির জন্য নারীবাদের মতো একটি আন্দোলনকে সব রকম কুসংস্কার আর ট্যাবু থেকে মুক্ত করা খুব জরুরি। আমাদের কন্যাদের, আমাদের উত্তরনারীদের জন্য এই পৃথীবিতে পূর্ণ মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার পথ তৈরি করতে চাইলে আর কোনও রাস্তা কিন্তু খোলা নেই।

আমি নিশ্চিত,কোনও এক সুন্দর ভোরে প্রতিটি সচেতন নারীই সকল অপবাদ, শঙ্কা আর বিভেদের দেয়াল উড়িয়ে দিয়ে নারীবাদের লড়াইয়ে যুক্ত হবেন। সেদিন এই পৃথিবীতে নতুন নারীরা নেতৃত্ব দেবে, যারা লক্ষ-কোটি বৈষম্যপীড়িত নারীর সম্মলিত শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করবে লিঙ্গ বৈষম্যের অপ-রাজনীতিকে।

 (রেফারেন্স: নারীবাদ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এর প্রাসঙ্গিকতা: কমলা ভাসীন ও নিঘাত সাইদ খান

লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ, কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাবির সব ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
ঢাবির সব ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
বাংলাদেশের আম-কাঁঠাল-আলু নিতে চায় চীন
বাংলাদেশের আম-কাঁঠাল-আলু নিতে চায় চীন
শিশু অপহরণ করে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করতো চক্রটি
শিশু অপহরণ করে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করতো চক্রটি
রাজধানী স্থানান্তর করছে ইন্দোনেশিয়া, বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে জাকার্তা
রাজধানী স্থানান্তর করছে ইন্দোনেশিয়া, বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে জাকার্তা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ