X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্ধেক গ্লাস ভরা: খালি তত্ত্ব এবং আইনের শাসন

গোলাম মোর্তোজা
১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১৬:০৭আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১৬:১২

গোলাম মোর্তোজা এক একটি উপলক্ষ আসে, উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সমালোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে। এই তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হন, সাধারণত শহুরে শিক্ষিত দাবিদার মানুষেরা। সাধারণ যে জনমানুষ, তারা এসব তর্কে সম্পৃক্ত হন না বা হওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে খেতের মাঝে দাঁড়িয়ে কর্মরত কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম।
যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার চলতেছে, জানেন?
‘হ জানি। টেলিভিশনে দেহি।’
এই বিচার নিয়ে আপনার কী মনে হয়, ঠিক হইতেছে নাকি...?
‘একাত্তরে এরা অপরাধ করছিল, মানুষ মারছিল, আগুন দিছিল। ওগো বিচার তো ঠিকই আছে। বিচার অওয়া দরকার। বিচার অউক, শাস্তি অউক। তয় এইডা নিয়া এত কথা কেন? এত কথার তো কোনও দরকার নাই...।’
কৃষক বা সাধারণ মানুষ অপরাধের বিচার চায়, শাস্তি চায়। অহেতুক তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া দেখতে চায় না। তারা এসব করেনও না। করি আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত হিসেবে দাবি করি। এ কাজ করার পেছনে আমাদের অনেকের চাওয়া-পাওয়া বা স্বার্থের বিষয় কাজ করে।
এখন যেমন উচ্ছ্বাস এবং তর্ক চলছে নারায়ণগঞ্জের সাত অপহরণ ও হত্যা মামলার রায় নিয়ে। র‌্যাব কর্তা, আওয়ামী লীগ নেতাসহ ২৬ জনের ফাঁসির রায়ের পর একদল বলছেন, দেশে যে আইনের শাসন আছে তা প্রমাণ হলো। কেউ ভাবছেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় পদেক্ষপ। কেউ বলছেন এই রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলো। কেউ কেউ তদন্ত পর্যায়ের দুর্বলতা, কাউকে বা কিছু বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ সামনে আনছেন। অন্যান্য হত্যাকাণ্ড, যেগুলোর বিচার হয়নি তাও আসছে সামনে।

এসব প্রসঙ্গ নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ।

১. সাত হত্যা মামলার রায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ইতিবাচক। সেনা ও নৌবাহিনী থেকে আসা র‌্যাব সদস্য, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ফাঁসির রায়, কোনোভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। সত্যি বিচার হবে কিনা, সবার শাস্তি হবে কিনা, সর্বোচ্চ শাস্তি হবে কিনা-  নানা সংশয় সন্দেহ জনমনে ছিল। সব সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে ফাঁসির রায় হয়েছে। উচ্চ আদালত, আপিলের বিষয়গুলো সামনে আছে। তারপরও এই রায় অনেক বড় ইতিবাচক ঘটনা।

২. তাৎপর্যপূর্ণ এই রায়ের পর ‘দেশে আইনের শাসন আছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ’- এভাবে বিষয়টিকে দেখা যায় কি না!

অপরাধীদের শাস্তি হবে, বিচার হবে- এটা তো একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়ার কথা। এত বড় একটি অপরাধের বিচারের পরে সরকারকে ধন্যবাদ বা অভিনন্দন জানানোর প্রসঙ্গ সামনে আসছে কেন?

হয়তো বিষয়টি সামনে আসছে এই বিবেচনায় যে, সরকার বিচার প্রক্রিয়ায় পদক্ষেপ করেনি।

রক্ষার চেষ্টা করা হয়নি মন্ত্রীর জামাতা র‌্যাব কর্মকর্তা সাঈদ তারেককে। এর জন্যে ধন্যবাদ জানানো যায়। কিন্তু একটি রায়ের মধ্য দিয়ে তো আইনের শাসন আছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলো- প্রমাণ হয় না। আইনের শাসন কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, একটি সামগ্রিক বিষয়।

৩. এই মামলার ক্ষেত্রেও শুরুর দিকটা একটু স্মরণ করতে অনুরোধ করি। প্রথমদিকে আওয়ামী লীগ নেতা এবং র‌্যাব সদস্যদের ক্ষেত্রে তেমন আচরণই করা হয়েছিল, আর দশটি ঘটনার ক্ষেত্রে যা করা হয়। সাহসী এবং বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত এসেছিল আদালত থেকে। যার প্রেক্ষিতে র‌্যাব সদস্যদের গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছিল প্রশাসন। ‘সব বিষয়ে আদালত কেন কথা বলবে’- এমন একটি বক্তব্য তখন এসেছিল উচ্চ পর্যায় থেকে। সেই কথায় কোরাস গেয়েছিলেন অনেকেই, সেই অনেকেই এখন বলছেন ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলো’।

সেই সময় আদালতের এমন কঠোর নির্দেশনা না এলে, মামলাটির ভাগ্যে কী ঘটতো তা বলা যায় না অথবা বলা যায়, কিন্তু বলছি না। শুধু স্মরণ করি ত্বকী হত্যার প্রসঙ্গ।

ত্বকী হত্যায় অংশ নেওয়া দু’জন আসামি ধরা পড়ল, আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে পুরো হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তুলে ধরলো। নাম বললো হত্যার পরিকল্পনাকারীর। র‌্যাব খুঁজে বের করলো টর্চার সেল। রক্তমাখা শার্টসহ পাওয়া গেল আরও অনেক কিছু। র‌্যাব তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দেওয়ার ঘোষণা দিলো।

সেই চার্জশিট আর দেওয়া হলো না।

দেওয়া কোন দিন হবে, কতটা পরিবর্তন করে কাকে বাঁচিয়ে দেওয়া হবে, কিছুই জানি না। জানি, আইনের শাসন থাকা কোনও দেশে এমন ঘটনা ঘটে না। বাবাকে সন্তান হত্যার বিচার পাওয়ার জন্যে ‘মঞ্চ’ তৈরি করতে হয় না।

এদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে- তারপরও বলা যাচ্ছে না যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা যদি হতো, সাগর-রুনির সন্তান মেঘকে বাবা-মা হত্যার বিচারের প্রত্যাশা নিয়ে, বড় হতে হতো না। তনু-মিতুসহ অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের বিচার হতো, বিচারের পদক্ষেপ নেওয়া হতো। বিচার চেয়ে হুমকির মুখে পড়তে হতো না তনুর মা বা পুরো পরিবারকে।

৪. দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, অর্ধেক গ্লাস খালি দেখবো, না অর্ধেক ভরা দেখবো। অর্ধেক গ্লাস ভরা দেখতে চাওয়া মানে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অপরাধকে সমর্থন করা। এর সঙ্গে আশাবাদের সম্পর্ক নেই, বিষয়টি এত সরল নয়। আপনার দুটি ভালো চোখের একটি আঘাত করে নষ্ট করে দেওয়া হলো। নিশ্চয় একটি অক্ষত রাখার জন্যে আঘাতকারীকে ধন্যবাদ বা অভিনন্দন জানাবেন না। দুই সন্তানের একজনকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করল, আরেকজনকে করলো না। নিশ্চয় অভিনন্দন জানাবেন না, একজনকে হত্যা করেনি বলে। রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ডলার চুরি হয়ে যাওয়ার পর, ২৮ বিলিয়নের বাকিটা চুরি হয় নাই বলে গভর্নরকে ধন্যবাদ বা অভিনন্দন জানাবেন না।

গ্লাসের পুরোটা ভর্তি থাকার কথা, অর্ধেক ভর্তি থাকার কথা নয়। বাকি অর্ধেক অন্যায়ভাবে খালি করা হয়েছে, হচ্ছে। এখানে গ্লাসের পানি মানে শুধু পানি নয়, মানুষের জীবন। বহু আগে, হয়তো বর্বর যুগে বলা যেত ‘যাক তাও তো কিছু একটা হয়েছে’। তখন অর্ধেক গ্লাস ভরা বা আংশিক প্রাপ্তি নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার ব্যাপার কাজ করে থাকতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে এসব পুরনো তত্ত্ব অচল। অচল তত্ত্ব নিয়ে পড়ে থাকলে সমাজবিরোধীরা উৎসাহ পায়। এখন সময় হিসেব নেওয়ার, অর্ধেকের নয়, পুরোটার।

৫. নূর হোসেনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান। নূর হোসেনের যে অপরাধ জগৎ, তা টিকিয়ে রেখেছে তার গডফাদার। অপরাধ জগতের অর্থের একটা বড় অংশ গডফাদার পেয়েছে, এখনও পাচ্ছে। অপহরণের পর নূর হোসেনকে রক্ষা করার দৃশ্যমান চেষ্টার বিষয়গুলো তদন্তের আওতায় আনা হয়নি। নূর হোসেনের পালিয়ে যেতে সহায়তা করার প্রমাণ টেলিফোন কথোপকথনও বিবেচনায় আনা হয়নি। ‘গৌর দা’ ‘আগায়া যাও’ বিষয়গুলোর স্বচ্ছ তদন্ত হয়নি। ভারতে ধরা পড়ার পর নূর হোসেনের যে বক্তব্য ‘আমি আমার নেতার নির্দেশে এখানে এসেছি’- সেই ‘নেতা’ কে, পরিষ্কার করা হয়নি। ‘সব কইয়া দিমু’- নূর হোসেনের থেকে তা শোনা হয়নি। ফিরিয়ে আনার পর জিজ্ঞাসাবাদ না করে, নানা অহেতুক দুর্বল কূ-যুক্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে বিচারের এমন তাৎপর্যপূর্ণ রায়ের পরও অনেক কিছু রহস্যই থেকে গেছে।

র‌্যাব কর্তা তারেক সাঈদের বিরুদ্ধে অপহরণ-হত্যা, অপরাধ জগতের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ সাত অপহরণ হত্যার সময়ই প্রথম আসেনি। কমপক্ষে এক ডজন অপহরণ-হত্যার সঙ্গে তার নাম আলোচিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। এই আলোচনা হয়েছে, সাত অপহরণ-হত্যার আগে। এখন যেভাবে সামনে আসছে, তখন সেভাবে সামনে আসেনি, ভয়ে।

৬. কথা দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কাজ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। সাত অপহরণ-হত্যা মামলার রায়কে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে, যদি স্বাভাবিক গতিতে অপরাধের বিচারের ধারা তৈরি হয়। তা কি হবে?

উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে কী বলবেন?

উচ্ছ্বাসওয়ালারা নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করেন। তা না করে অপরাধ আড়াল করা বা দু’একটি বিচার করে, অনেকগুলো বিচার না করার সংস্কৃতির অংশ হয়ে যাবেন না।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ