X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ নির্ভর নেতৃত্ব, দূষিত বিবেক

গোলাম মোর্তোজা
০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:৫২আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:০৬

গোলাম মোর্তোজা বাংলাদেশ চলে ‘অ্যাডহক’ ভিত্তিতে। স্থায়ী সুদূরপ্রসারী নীতি তৈরিতে বিশ্বাসী নই আমরা। যখন যে ইস্যু সামনে আসে, সেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এখন যেমন আলোচনা চলছে ‘সার্চ’ কমিটি নিয়ে। পরপর দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে বলছে, একটা আইন করা দরকার। তবে এবার যেহেতু ‘সময় নেই’ আগেরবারের মতো সার্চ কমিটি করেই নির্বাচন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। আইনের খসড়া করা আছে। ১৫ দিন থেকে এক দেড় মাসের মধ্যে আইন করা যায়। তারপরও ‘সময় নেই’!
এবারের নির্বাচন কমিশন যেমনই হোক, একটা কিছু গঠন হবে। তারপর সবাই ভুলে যাবে আইনের কথা। আবার নির্বাচনের আগে শুরু হবে আলোচনা। ‘অ্যাডহক’ ভিত্তিতে চলা এবং কোনও একটি ঘটনা-দুর্ঘটনার পরে সুনির্দিষ্ট করে সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করি- প্রেক্ষাপট আলোচনা করি না। চালাকি বা ধূর্ততার সঙ্গে মূল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আলোচনা করি। কেন এমন কথা বলছি, তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি।
১. ইদানীং খুব সহজে, অতি সাধারণ কারণে বা অকারণে বা অসত্য অজুহাতে সংবাদকর্মীদের গ্রেফতার করে পুলিশ। তার সর্বশেষ উদাহরণ সাভারের সাংবাদিক নাজমুল। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাভার প্রতিনিধি। নাজমুলকে গ্রেফতার করার দু’তিন দিন পর থেকে সোচ্চার হলেন সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতারা। দু’জন সাংবাদিক নেতার সঙ্গে একটি টকশোতে অংশ নেওয়ার সুযোগ হলো। তারা বিশেষ করে একজন বারবার বললেন, ‘সাভার থানার ওসি আইনের অপব্যবহার করছেন, তিনি এটা করতে পারেন না। তিনি বেআইনি কাজ করছেন।’
বাস্তবতা কি তাই? সাংবাদিককে কি একজন এসআই বা ওসি গ্রেফতার করেন? গ্রেফতার করা কি আইনের অপব্যবহার বা বেআইনি?

বলার চেষ্টা করলাম, আমরা সবকিছু ঘটনাভিত্তিক আলোচনা করছি। সামগ্রিকভাবে আলোচনা করছি না, ঘটনার মূলে প্রবেশ করছি না। আজকে পুলিশ যে সাংবাদিককে গ্রেফতার করতে পারছে, গ্রেফতার করছে, কোমরে রশি বেঁধে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে, তার শক্তির উৎস কী? পুলিশের শক্তির উৎস কূখ্যাত কালো আইনের ৫৭ ধারা। এই আইন পুলিশ করেনি, আইন করেছে সরকার। সরকার আইন করে পুলিশকে ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ সেই ক্ষমতার প্রয়োগ করছে। এখানে সরাসরিভাবে বলার সুযোগ নেই যে, পুলিশ বেআইনি কাজ করছে। অথচ আমরা কথা বলছি একজন ওসির বিরুদ্ধে। আইন করে একজন এসআই বা একজন ওসিকে যারা ক্ষমতা দিলেন, তার বিরুদ্ধে আমরা জোরালো কথা বলিনি, এখনও বলছি না। ৫৭ ধারা প্রয়োগ করে একজন এসআই বা ওসি পদমর্যাদার পুলিশ সদস্য যে কোনও সময়, একজন সাংবাদিক এমনকি সম্পাদককেও গ্রেফতার করতে পারেন।

এখন আন্দোলন কি এসআই বা ওসির বিরুদ্ধে, না যারা আইন করে এসআই বা ওসিদের ক্ষমতা দিলেন তাদের বিরুদ্ধে?

আমরা আন্দোলন করছি এসআই বা ওসির বিরুদ্ধে। কারণ তা করলে, রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। আমাদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রায় ভৃত্যের পর্যায়ে চলে গেছে। আইনের ৫৭ ধারা যারা করে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি না, যারা প্রয়োগ করে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলি।

২. বাংলা একাডেমির বই মেলার স্টলগুলোতে কী বই থাকবে, কোন বই কার মনে-হৃদয়ে আঘাত দেবে, তা দেখবে পুলিশ সদস্যরা। এখন আমরা বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনও কথা বলছি না। ধর্মীয় অনুভূতিকে দেওয়া আঘাত দেওয়া বই সনাক্ত করবে পুলিশ, প্রতিদিন বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন পুলিশের কর্তারা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা অন্য কোনও কারণে, কোনও বই বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ মেলায় রাখতে না রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেটা সনাক্ত তো বাংলা একাডেমি করবে, পুলিশ নয়। পুলিশের সেই সক্ষমতা নেই। বাংলা একাডেমি সনাক্ত করে দিলে, ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। অবিশ্বাস্যভাবে নিজেদের কাজ বাংলা একাডেমি পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। এর অপব্যবহার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা পরিত্যাগ করে, বাংলা একাডেমি যেন লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। অথচ লেখক- প্রকাশক- বুদ্ধিজীবী কেউ বিষয়টির তাৎপর্য উপলব্ধি করছেন না। অথবা দলবাজ মানসিকতায় কথা বা প্রতিবাদ করছেন না। কথা বলবেন তখন, যখন পুলিশ ‘আঘাত’ দেওয়া সনাক্ত করে লেখক বা প্রকাশকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। বলা হবে, পুলিশ ‘বাড়াবাড়ি’ করছে, পুলিশ কেন এটা করবে... ইত্যাদি। পুলিশকে যারা এই কাজ করার ক্ষমতা দিলো তাদেরকে নিয়ে অতটা কথা বলবো না, যতটা বলা দরকার। এদেশে বিবেক সম্পন্ন মানুষ হিসেবে যারা পরিচিত, তাদের অধিকাংশের বিবেক পচে গেছে। পদ- পদবীর কাছে তারা আলু পটলের মতো বিবেক বিক্রি করে দিয়েছেন।

৩.  পুলিশ দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। র‌্যাব, সোয়াত... সব তো পুলিশেরই অংশ। এত সমালোচনা, তারপরও আমরা বিপদ বা যে কোনও প্রয়োজনে পুলিশেরই শরণাপন্ন হই। পুলিশ কাজ করে না, শুধু অনিয়ম-দুর্নীতি করে, তা তো সত্যি নয়। নিশ্চয়ই পুলিশ কাজ করে, ভালো কাজও করে। ঢাকা শহরে যে তরুণ-তরুণী পুলিশ সার্জেন্টদের দেখা যায়, তা তো এক ধরনের আশা জাগায়। তাদের আচার-ব্যবহার, কথা সবই তো ইতিবাচক চিত্র বহন করে। পুলিশের ভেতরের অনেক সৎ যোগ্য অফিসার তো দৃশ্যমান। তাহলে পুলিশের এত সমালোচনা কেন? সমালোচনার মূল কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেরা অসৎ- অনৈতিক। বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণকে বাদ দিয়ে প্রশাসন বা পুলিশের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার নীতি নিয়েছে। এই নীতিতে অতিরিক্ত নির্ভরতা বেড়েছে পুলিশের ওপর। পুলিশও সেই সুযোগটিই নিচ্ছে। কাজের বাইরে বেশ কিছু অকাজ বা কূ-কাজ করছে পুলিশ। পুলিশ যে কূ-কাজ করছে, তা সরকার খুব ভালো করে জানে। সরকার জেনে-বুঝেই পুলিশের কূ-কাজকে সমর্থন করছে, প্রশ্রয় দিচ্ছে। অপরাধী পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ব্যবস্থা নেওয়ার নামে নানাকিছু করছে, তাতে পুলিশের ইমেজ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে পুলিশের কূ-কাজ সকল সীমা অতিক্রম করছে। সাম্প্রতিক সময়ে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীতে আগুন। ভিডিও চিত্রে পরিষ্কার দেখা গেলো যে, সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিলো পুলিশ। প্রথমাবস্থায় পুলিশ কর্তৃপক্ষ পুরো বিষয়টি চেপে গেল। বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর, সেই ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো, উঠে আসলো দেশের গণমাধ্যমেও। পুলিশের নীতি-নির্ধারকরা বললেন, ‘যদি’ কোনও পুলিশ জড়িত থাকে, তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা তদন্ত করে দেখছি।’

ঘটনার কয়েক মাস পরও তদন্ত বা সনাক্ত বা ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। এর মধ্যে বিচারিক তদন্ত কমিশন রিপোর্ট দিল, ‘সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন পুলিশই দিয়েছে, স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে।’ চিন্তা করা যায়, একটি দেশের পুলিশ তার নাগরিকদের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়! আগুন দেওয়া সেই পুলিশকে সনাক্ত করা হয় না, তদন্ত হয় না, শাস্তি হয় না। এত বড় অপরাধের বিরুদ্ধে দেশের ভেতর থেকে জোরালো কোনও প্রতিবাদও হয় না।

৪. আমরা বলছি মূল্যবোধ ও সামাজিক অবক্ষয়ের কথা। সব হারিয়ে গেলো, ধসে গেলো, চিন্তার শেষ নেই আমাদের। এমনটা ঘটছে কেন?

যে সমাজে শিক্ষক অসত্য বলেন, চিকিৎসকরা মারামারি করেন, পুলিশ অপহরণ-হত্যা করেন, সাংবাদিকরা দলে-উপদলে বিভক্ত, পরিবার কর্তার অবৈধ আয় সন্তানের সামনে দৃশ্যমান- সেই দেশে মূল্যবোধের অবক্ষয়ই তো স্বাভাবিক বিষয়। কারণ নিয়ে আমরা কথা বলি না, চিন্তা করি না। চিৎকার করি ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’ নিয়ে। অবক্ষয় কেন হয়েছে বা হচ্ছে, তা অনুসন্ধান করি না, যদিও তা দৃশ্যমান। প্রতিকারে কোনও ভূমিকাও রাখি না।
‘উন্নয়ন’ নিয়ে চিৎকার করি, ৬৬% কর্মক্ষম জনসংখ্যা নিয়ে গর্ব করি। অথচ এক কোটিরও বেশি শিক্ষিত তরুণ নিষ্ক্রিয়। তাদের সামনে কোনও কাজ নেই, স্বপ্ন নেই। আমরা ভাবিনা ভবিষ্যতের ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ