X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘অনুভূতি’র কাছে লেখকের কলম বন্ধক থাকবে?

সাদিয়া নাসরিন
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:১৮আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:৩৮

সাদিয়া নাসরিন এই ছোট্ট দেশটিতে বেশ বড় রকমের অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। নানারকম অনুভূতি আক্রান্ত এই দেশে মত প্রকাশের অপরাধে লেখকের মগজ ছড়িয়ে থাকে রাজপথে। এখানে শিশুদের শিরদাঁড়ার ওপর হেঁটে বেড়ান জনপ্রতিনিধিরা। এই দেশের আইনপ্রণেতাগণ শিশু মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ঝামেলা কমানোর ব্যবস্থা করেন, রাষ্ট্রীয় পাঠ্যপুস্তকের মধ্যমে লিঙ্গ বৈষম্য শেখানো হয় শিশুদের, এই দেশে প্রত্যন্ত চরে মেয়েদের স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়, প্রকাশ্যে মেয়েদের চাপাতি দিয়ে কোপায় হিংস্র পুরুষেরা, পাঁচ বছরের শিশুর যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে বড় করে ধর্ষণ করে পুরুষ হায়েনারা। তবু এই দেশে ভীষণ সুন্দর কিছু ব্যাপার এখনও ঘটে।
বইমেলা তেমন সুন্দর একটি ঘটনা। শুধু সন্দর নয়, পবিত্র ঘটনা। একটি দেশে বই কিনতে বা দেখতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে, এই একটি দৃশ্য আমার কাছে স্বর্গীয় পবিত্রতা নিয়ে আসে। এই দেশের অনেক পরিবার তাদের বছরের বাজেটে কিছু টাকা গুছিয়ে রাখে বইমেলায় এসে বই কেনার জন্য। এই দেশে অনেক লেখক খুব কষ্ট করে টাকা জমিয়ে রাখেন একটি বই ছাপানোর জন্য, ক্ষতি মাথায় নিয়ে ও কিছু প্রকাশক দাঁত কামড়ে পড়ে থাকেন বই ছাপানোর ব্যবসা করবেন বলে। এই দেশের মানুষ নিজের জীবন দিয়ে ভাষা রক্ষা করেছিলো সেই প্রমাণ আমি বারবার পাই এই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখে। বইমেলা এ দেশে আক্ষরিক অর্থেই লেখক পাঠক ও প্রকাশকের মেলায় পরিণত হয়। এতো প্রাঞ্জল, এতো রঙিন বইমেলা পৃথিবীর আর কোনও দেশে হয় কিনা আমার জানা নেই।
কিন্তু এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে বারবার আক্রান্ত হয়েছে লেখক, প্রকাশক। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার সময় মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলার শিকার হয়েছিলেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি সংলগ্ন এলাকায় মৌলবাদীদের সশস্ত্র হামলায় নিহত হন লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়, আহত হন তার স্ত্রী লেখক বন্যা আহমেদ। একই বছর কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎ রায়-এর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে এবং আহত হন আরও দুজন। ২০১৫ সালে মুক্তচিন্তার বই প্রকাশনী ‘রোদেলা প্রকাশনী’ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগে ২০১৬ সালে বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় প্রকাশনীর মালিক শামসুজ্জোহা মানিক, কর্মকর্তা ফকির তসলিম উদ্দিন কাজল ও শামসুল আলম চঞ্চলকে। শামসুজ্জোহা মানিকের গ্রেফতারের প্রতিবাদ করায় এ বছর বইমেলা থেকে দু'বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় শ্রাবণ প্রকাশনীকে। পরে ব্যাপক প্রতিবাদের চাপে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারও করা হয়। বইমেলাতেও নাশকতা হয়েছে। ২০১৩ সালে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় বইমেলায়, পুড়ে যায় ২৭ টি স্টল; ২০১৬ সালে ও বইমেলায় আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা।
এই বইমেলার মাধ্যমে লেখক প্রকাশক ও পাঠক মিলে যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লড়াই করেন সেই স্বাধীনতার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়ে এখন পুলিশের নজরদারীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে লেখকের কলমকে। পুলিশের ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘গোয়েন্দারা পুরো প্রক্রিয়াটিতে সক্রিয় থাকবেন। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে বা গোষ্ঠীগত অনুভূতিতে বা নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয় বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনও বিষয় প্রকাশ প্রচারিত হচ্ছে কিনা, সেটি পুলিশ দেখবে, ব্যবস্থাও পুলিশ নেবে'। তার মানে কী দাঁড়ালো? লেখকের চিন্তা পুলিশের- ‘অনুভূতি’র কাছে বন্ধক রেখে লিখতে হবে? এটা লেখক ও প্রকাশকদের কপালে একটা জোরে সোরে লাত্থি মারার মতই অপমানের।
এই দেশটা এমনিতেই বিভিন্ন ধরেনের অনুভূতিতে আক্রান্ত। এখানে মেয়েদের পোষাকের কারণে অনেকের যৌন অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। নারী স্বাধীনতার কথা বললে অনেকের পুরুষানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মতামত এক দলের পক্ষে গেলে অন্য দলের চেতনা অনুভূতি আবার সেই দলের বিপক্ষে গেলে জাতীয়তাবাদ অনুভূতি ব্যাথা পায়। এরকম একটি অবস্থায় আমাদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি পুলিশ বাহাদুর কিসের ভিত্তিতে মানুষের ধর্মীয়, গোষ্ঠীগত, নাগরিক এই ‘বিবিধ অনুভূতি সমগ্র’ নজরদারিতে রাখবে? বিশেষ করে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’-এর বিষয়ে সরকার যেখানে কোনও নীতিমালা ঘোষণা করেনি সেখানে একটা সাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর থেকে বের হয়ে আসা একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত ‘ভালো-মন্দ অনুভূতি’র ওপর সিদ্ধান্ত নেবেন আপনার লেখা বইটি বিক্রি করা যাবে কী যাবে না?
আমি জানি, পুলিশ বাহিনীর প্রচুর সদস্য আছেন যারা নিয়মিত লেখালেখি করেন, প্রচুর বই পড়েন। সেটা অন্য বিষয়। কিন্তু বইমেলাতে আসা বই নজরদারি এবং ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত বৈধতা কি পুলিশ সদস্যদের আছে? এর জন্য কি পুলিশ বিভাগকে বাংলা একাডেমির অনুমতি নিতে হয়েছে? বাংলা একাডেমি বলছে তারা এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। বইমেলার নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো বই যাতে মেলায় ঢুকতে না পারে তা নিয়ে সভা হয়েছে অথচ সেখানে প্রকাশকদের কোনও প্রতিনিধিত্ব ছিলো না, ডাক পড়েনি বাংলা একাডেমিরও! এই জায়গাটিই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। বইমেলায় কোন বই আসতে পারবে বা পারবে না তা ঠিক করার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ডিএমপি কি নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছে? নাকি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে? তবে কি লেখকের চিন্তার ওপর পুলিশি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাইছে সরকার? যদি তাই হয় তবে এই দেশের ধ্বংস তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমাদের।
যখন পুরো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার হেফাজতিকরণ চলছে, নতুন নতুন ইসলামি দল নতুন নতুন দাবি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে, তখন লেখকের চিন্তাকে পুলিশের পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার এই চক্রান্ত কী বার্তা দিতে চাইছে আমাদের? গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লেখক প্রকাশকরা যেভাবে জঙ্গি ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর হামলার শিকার হয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন, একটা হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি, সেখানে এই পুলিশি নজরদারি যে বার্তাটি দিলো তা বড়ই বিপজ্জনক। এই নজরদারি লেখককে সাবধান করেছে, ‘পুলিশি সেন্সরসিপ’-এর চাপে ফেলেছে। এই সেন্সরশিপ নিয়ে একজন লেখক যা লিখবেন তা তার নিজের লেখা হবে না। পৃথিবীর কোনও দেশেই লেখককে লেখার আগে সেন্সরশিপ নিয়ে ভাবতে হয়না, প্রকাশককে বই প্রকাশ করতে আলাদা অনুমতি নিতে হয় না।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যপার হলো পুলিশের পক্ষ থেকে মুক্তচিন্তার সংজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার আমাদের রাজনীতিবদদের ভাষায় বলেছেন, “ মুক্তচিন্তা করতে গিয়ে আপনি যদি কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেন ও গোষ্ঠীগত দাঙ্গা সৃষ্টিতে উস্কানি দেন তাহলে সেটা মুক্তচিন্তার মধ্যে পড়ে না।’আরও দুর্ভাজনক ব্যাপার হলো পুলিশের সাথে গলা মিলিয়ে অনেক লেখক প্রকাশক ও বলছেন মুক্তচিন্তা মানেই বিতর্কিত লেখা নয়। হায়রে! মুক্তচিন্তা মানে তো মুক্তচিন্তাই। সংজ্ঞা আরোপ করে, বর্ডার দিয়ে, লিমিটেশন দিয়ে আর যাই হোক মুক্তচিন্তা যে হয় না এই সহজ কথাটা যদি লেখক প্রকাশক না বোঝেন তাহলে কোথায় যাবো আমরা? ভলতেয়ারের একটা বহুল জনপ্রিয় উক্তি আছে এরকম, 'আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে পারবো না কিন্তু আমার সঙ্গে দ্বিমত করার যে অধিকার আপনার আছে, সে অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজন হলে আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।’সেই জন্যই ওই বিতর্কিত লেখকের লেখার স্বাধীনতার পক্ষেও লড়তে হয়। যদি আপনি তার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান না করেন তাহলে  কাল আপনার কলম ও পুলিশের বুটের তলায় গুড়ো হবে।
আমি মনে রাখতে চাই, দিনের শেষে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমার বাঁচার মূল শর্তগুলোর একটি। এই স্বাধীনতা না থাকলে মানুষ ক্রিতদাসে পরিণত হয়, তার আর আলাদা কোনও সত্তা থাকে না। তাই ভলতেয়ারের মতোই বলব, আমি নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা চাই মত প্রকাশের জন্য। আর যদি রাষ্ট্র তা কেড়ে নেয়, তবে হে পুলিশি রাষ্ট্র, লেখকের কপালে তোমার ওই পুলিশ বাহিনীর বুটের আঘাতই দাও! অনুভূতির ষাঁড়াশি বুটের তলায় গুড়িয়ে যাক লেখকের কলম আর মাথার খুলি !!!

লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী সংযোগ বাংলাদেশ

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ