X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

তিনটি সিরিয়াস রসিকতা!

গোলাম মোর্তোজা
১৫ মার্চ ২০১৭, ১৪:১৭আপডেট : ১৫ মার্চ ২০১৭, ১৪:৪১

গোলাম মোর্তোজা রসিকতা নম্বর এক:
‘হলে ছেলে দেওয়াকে কেন্দ্র করে একটা ঘটনা ঘটেছে। হাউজ টিউটরের সঙ্গে কয়েকজন ছাত্রের কথা কাটাকাটি হয়েছে।’
উপরের কথাগুলো ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইনের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হলে কোন ছাত্র আসন পাবে, তা নির্ধারণ করে দেয় ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নয়। ‘বিজয় একাত্তর’ হল ছাড়া অন্য সবগুলো হলে, এই নিয়ম কয়েক বছর আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হল প্রভোস্ট বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাজ অনেক কমিয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগ। একাত্তর টেলিভিশনে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক পরিষ্কার করে বললেন, ‘হলে ছেলে দেওয়াকে’ কেন্দ্র করে ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনাটা কী?
রাত বারোটায় ছাত্রলীগ হলে ‘ছেলে দিতে’ গেছে। হলের বৈধ ছাত্রদের রুমে তারা তাদের ‘ছেলেদের’ তুলে দিতে শুরু করে। বৈধ ছাত্ররা প্রতিবাদ করে। দশ বারোজন শিক্ষক এসে হাজির হন মাঝরাতে। ‘ছেলে দেওয়া’ কাজে তারা বাধা দেন। ছাত্রলীগের কাজে যে শিক্ষকরা বাধা দেন তাদেরকে ‘জামায়াত’ বলে দৌড়ানি দেওয়ার অধিকার রাখে ছাত্রলীগ। এবং তারা তাই করে। আওয়ামীপন্থী রাজনীতির শিক্ষক এজেএম শফিউল আলম ভূঁইয়া কঠোর এবং সাহসী মানুষ। ‘বিজয় একাত্তর’ হলটিতে ছাত্রলীগ যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, তার কারণ তিনি। ছাত্রলীগের তার ওপর রাগ থাকা খুব স্বাভাবিক। তাকে ‘জামায়াত’ বলে দৌড়ানি দিতে একটু দ্বিধা করেছে। রুমে তার উপস্থিতিতে জানালার গ্লাস ভাঙচুর করে মনোভাব ঠিকই বুঝিয়েছে ছাত্রলীগ। সব হল ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে, হলে ‘ছেলে দেওয়া’র একক মালিক তারা। একটি হল এই নীতির বাইরে থাকবে, তা ছাত্রলীগের মতো সংগঠন মানতে পারে না।
এই ছাত্রলীগ ১৯৭১ সালে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে। ৩ মার্চ পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতাকেও সেই সময়কার ছাত্রলীগ নেতারা চাপে রেখেছেন। সব সময়ই ছাত্রলীগের চিন্তা-মনোভাবকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সেই ছাত্রলীগই আবার স্বাধীন বাংলাদেশে মহসিন হলে ‘৭ হত্যা’ সংগঠিত করেছে।
কিংবদন্তিতুল্য ঐতিহ্য হারিয়ে অস্ত্র-সন্ত্রাস-হত্যা ছাত্র রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে। পরবর্তীতে জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রদল সন্ত্রাসে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। আওয়ামী ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, বিএনপির ছাত্রদলের ত্রিপক্ষীয়, কখনও আওয়ামী ছাত্রলীগ-বিএনপির ছাত্রদলের সন্ত্রাস-গুলি যুদ্ধে বহু ছাত্র প্রাণ দিয়েছেন। এরশাদের নতুন বাংলা ছাত্র সমাজও অনেক ছাত্র হত্যা করেছে। জামায়াতের শিবির লোমহর্ষক সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
এসব কোনও কিছুই এখন আর নেই। প্রতিপক্ষ নেই ছাত্রলীগের। একক ক্ষমতার মালিক তারা। নিজেরা নিজেদের ৬০ জন নেতা-কর্মী হত্যা করেছে, ছাদ থেকে ট্রেন থেকে নিজেরা নিজেদের নেতা কর্মীদের ফেলে দিয়েছে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে,গত ছয় সাত বছরে।
প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষ বা সন্ত্রাস নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। আপাত দৃষ্টিতে শান্ত পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শতভাগ আনুগত্য শিকার করেছে ছাত্রলীগের কাছে। আত্মসমর্পণের এই ধারায় ব্যতিক্রম ছিল ‘বিজয় একাত্তর’ হল। সেখানে ‘ছেলে দেওয়াকে’ কেন্দ্র করে এই ঘটনা আর বেশি কী! হাউজ টিউটরের সঙ্গে ‘কথা কাটাকাটি’ এও তো সামান্য ব্যাপার। ছাত্রলীগের সঙ্গে ‘কথা কাটাকাটি’র সাহস শিক্ষক দেখাবেন কেন!
ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ নেতা বয়দের বিষোদ্গার করবেন, প্রতিবাদ করলে শিক্ষককেও বিষোদ্গার করা হবে। সেটাকেও ‘বেয়াদবি’ হিসেবে দেখা যাবে না। ছাত্র-শিক্ষকের বন্ধুসুলভ  দার্শনিক চিন্তা হিসেবে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষকদের অধিকাংশ যাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, সেখানে আবার নিয়ম-নীতি-ন্যায্যতা!
যে কাউকে জামায়াত বলা তাদের অধিকার। আবার ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের জামায়াতি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ কর্তৃক ষড়যন্ত্রের শিকার প্রগতিশীল মতাদর্শের শিক্ষক ড. রিয়াজুল নাজেহালের বিষয়ে তারা নিরব।
রসিকতা নম্বর দুই:
বুড়িগঙ্গার পানিকে আলকাতরা বানাব, পরিবেশ কলুষিত করবো, কারণ আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি। চামড়া শিল্প ও ট্যানারি মালিকদের বক্তব্য মোটামুটি এরকমই। ট্যানারি শিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ হাজার। এর মধ্যে ৬০% অস্থায়ী শ্রমিক। মানবেতর জীবন তাদের। আদালত গত দশ বারো বছর ধরে বলছে, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নিতে হবে।
সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ও তাদের সাভারে সরিয়ে নিতে চায়।
আদালতের এক একটি রায় আসে, টালবাহানা শুরু করে ট্যানারি মালিকরা। সময় বাড়ে। আদালত সর্বশেষ বলেছে গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। সেই অনুযায়ী সরকারের কাজ চলছে।
ট্যানারি মালিকরা বলছেন, আমরা যাবো না। কারখানা বন্ধ করে দেব। যুক্তি, সাভারে জায়গা প্রস্তুত হয়নি। গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়নি। এখন ফ্যাক্টরি বন্ধ হলে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হবে।
২০০৩ সাল থেকে সাভারে চামড়া শিল্প সরিয়ে নেওয়ার কাজ করছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত বিসিক। তাদের সক্ষমতা দেখলে রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়! ১১০০ কোটি টাকা খরচ করে এখনও তারা জায়গা প্রস্তুত করতে পারেনি। কী যে প্রস্তুত করতে পেরেছে সেটাও পরিষ্কার করে বলতে পারছে না। ২০০৫ সালে যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, ২০১৭ সালে তার ৫০ শতাংশ কাজও সম্পন্ন হয়নি।
মূলত আদালতের রায় নিয়ে ট্যানারি মালিক-সরকার সাপলুডু খেলার নীতি পালন করছে বছরের পর বছর ধরে। সবশেষে ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন মালিকরা। তাদের কাছে জিম্মি শ্রমিক-জনগণ-দেশ
ভারতের আগ্রা তাজমহল ছাড়াও লোহা পুড়িয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির জন্যে বিখ্যাত ছিল। ৪৭০টি ঝালাই কারখানা ছিল আগ্রায়। লোহা পোড়ানোয় বাতাস এবং যমুনা নদী দূষিত হয়ে তাজমহলের ক্ষতি হচ্ছিল। এলাহাবাদ কোর্ট উত্তর প্রদেশ সরকারকে বারবার এসব ঝালাই কারখানা বন্ধ বা সরিয়ে নিতে আদেশ দিয়েছিল। সেখানেও আমাদের ট্যানারি শিল্পের মতো খেলাধুলা চলছিল। সবশেষে আদালত বলেছিলেন, ‘আগামীকাল রাত ১২টার মধ্যে ৪৭০টি ঝালাই কারখানায় তালা দিয়ে, চাবি আদালতে জমা দিতে হবে।’
উত্তর প্রদেশ সরকার তাই করেছিল। আমাদের আদালত ট্যানারি শিল্পের গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পরবর্তীতে আমাদের নিশ্চয়ই শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিসিকের খেলাধুলা নিয়েও আদালতের বক্তব্য জানার সুযোগ হবে।
রসিকতা নম্বর তিন:
ঢাকা শহরে এমন অনেক ভবন আছে যার আংশিক অবৈধ। কোনোটি কিছু জমি দখল করা, কোনোটির রাজউকের আংশিক অনুমতি আছে। হয়ত ১০ তলার অনুমতি নিয়ে ১৪ তলা তৈরি করেছে। বড় ভবনগুলোর মধ্যে একমাত্র শতভাগ অবৈধ বিজিএমইএ ভবন। জায়গার মালিকানা তাদের নয়। বলা হয় রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে তারা জায়গা কিনেছেন। বাস্তবে জায়গাটি রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর নয়। যে জমি যার নয়, সে বিক্রিও করতে পারেন না। রাজউকের অনুমতি ছাড়াই তৈরি হয়েছে বিজিএমইএ’র ১৬ তলা ভবন। সম্পূর্ণ অবৈধ ভবন। আদালতের রায়ে তা এখন ভাঙার অপেক্ষায়। সরকারের প্রধান আইন কর্তার এই রায়ে খুশি হওয়ার কথা। আমরা দেখলাম তার ক্ষুব্ধতা! এও বিস্ময়করই বটে!!
ভাঙতে-সরতে তিন বছর সময় লাগবে, ইত্যাদি রসিকতার আগে বহু রসিকতা হয়েছে। আমরা বড়লোক, আমরা সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি, আমরা জলাভূমি দখল করে অবৈধ ভবন নির্মাণ করবো, তা ভাঙা হবে কেন! আমাদের লোকজনই রাজনীতিবিদ, এমপি, মন্ত্রী। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দেই। আমাদের এত প্রভাব, এত ক্ষমতা। যাই হোক এই রসিকতার অবসান হতে যাচ্ছে। অনেক হতাশার মাঝেও আশার কথা সেটাই।
পৃথিবীতে যখন আমেরিকার বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল, একটা ব্যালান্স ছিল। একক ক্ষমতা মানুষকে দানবে পরিণত করে, আমেরিকাকে যেভাবে করেছে। প্রতিপক্ষ না থাকায় একক ক্ষমতায় ক্ষমতাবান ছাত্রলীগ তা ধারণ করতে পারছে না। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা তাদেরকে উদ্ধত করে দিচ্ছে। শিক্ষক লাঞ্ছনা, হলে ‘ছেলে দেওয়া’, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি হয়ে গেছে পেশা।
ট্যানারি মালিকরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রমিকদের তো বটেই, পুরো দেশকেই জিম্মি করার চেষ্টা করছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিসিক সাভারে ১১০০ কোটি টাকা খরচ করে কোন ধরনের রসিকতা করছে গত ১৪ বছর ধরে, তা গবেষণার দাবি রাখে। ট্যানারি মালিকদের মতো, যাবো না জাতীয় একই কাজ বছরের পর বছর করেছে বিজিএমইএ।
আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার পর তারা দাম্ভিকতার সঙ্গে বলতে পারেন, ‘ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেব’। হঠাৎ অর্থবানরা একত্রিত হলে, গোষ্ঠীবদ্ধ হলে, আইন-শাসন সবকিছু থেকে নিজেদের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে। অর্থ আর ক্ষমতার দাপটে পুরো দেশ এবং দেশের মানুষকে নিয়ে তারা রসিকতা করতে শুরু করে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ