X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধিজীবী বৃত্তান্ত

গোলাম মোর্তোজা
১২ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৩৯আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৪৩

গোলাম মোর্তোজা রাজনীতিবিদরা দেশ পরিচালনা করেন। দেশ চালাতে গিয়ে তাদের অনেক ক্ষেত্রে আপোস করতে হয়, নৈতিক স্খলনও ঘটে। তারা কথা বলেন, রাজনৈতিক সুবিধা লাভের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে। সব সময় তা তথ্য বা যৌক্তিক নাও হতে পারে। চতুরতার আশ্রয়ও নিয়ে থাকেন। এর বিপরীতে বুদ্ধিবৃত্তিক কথা বা আলোচনার নেতৃত্ব দেন সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর শ্রেণি। অগ্রসর মানে আর্থিকভাবে সফল-বিত্তবান শ্রেণি নয়। অগ্রসর মানে শিক্ষা-জ্ঞান, চিন্তা-চেতনায় এগিয়ে থাকা শ্রেণি। যিনি বা যারা বিবেক দ্বারা পরিচালিত হন, অন্যকে বা সমাজকে বিবেক দ্বারা পরিচালিত হতে উদ্বুদ্ধ করেন। জ্ঞানের চর্চা করেন। নৈতিকতা ধারণ করেন। বিভিন্ন পক্ষের রাজনৈতিক, করপোরেট চাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন। সবচেয়ে ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধেও নির্মোহভাবে কথা বলতে পারেন। নিজেকে সরকারি প্রশাসনের বা রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি বা কোনও রকম প্রাপ্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন না। তারা প্রতিনিধিত্বহীন দুর্বল-পিছিয়ে পড়াদের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই অবস্থানে অটুট থাকতে গিয়ে রাজনীতি বা শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানির মধ্যে তাদের থাকতে হয়। পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি এই অগ্রসর শ্রেণি থাকেন। তারা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। শিল্পী-শিক্ষক-লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের একটা অংশ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পান। তারা দেশ-সমাজকে সঠিক ও নৈতিক পথে রাখার ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা রাখেন, নিজেদের সকল বিপদকে উপেক্ষা করেন। দেশের সাধারণ জনমানুষ তাদের ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। তাদের দিকনির্দেশনামূলক নির্মোহ বিশ্লেষণ থেকে নিজেরা ঋদ্ধ হন।
বাংলাদেশের জন্মের যে ইতিহাস, সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজনীতিবিদরা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বুদ্ধিজীবীরা। স্বাধীন বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির নৈতিক স্খলন ঘটেছে। তারপরও নব্বইয়ের আন্দোলন পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীদের একটা জোরালো অবস্থান দৃশ্যমান ছিল। আস্তে আস্তে এখন বুদ্ধিজীবী হিসেবে যারা পরিচিত তারা দলীয় কর্মী-নেতা বা ক্যাডারে পরিণত হয়েছেন। তারা পদ-পদবির পেছনে ছুটতে শুরু করেছেন। নৈতিক স্খলনের কারণে সাহস হারিয়ে ফেলেছেন। ক্ষমতাসীনরা কী চাইছেন, সেই বিবেচনায় কথা বলেন। ক্ষমতাসীনরা রুষ্ট হতে পারেন বলে, নিরব থাকেন। কখনও চরম অন্যায় বা অনৈতিকতার পক্ষে কথা বলেন, অবস্থান নেন। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের অনুগত বুদ্ধিজীবীরাও দলীয় অবস্থানের বিপক্ষে সত্য কথা বলেন না। অনেক ক্ষেত্রে অসত্য সমর্থন করেন বা নিরব থাকেন।
পাকিস্তানি শোষকরা বুদ্ধিজীবীদের দলে টানতে চেয়েছিল সুবিধার বিনিময়ে। কিছুসংখ্যককে টানতে পেরেছিলও। বুদ্ধিজীবীদের দলে টানা বা কেনার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। আমেরিকায় রকফেলার বা ফোর্ডসের মতো করপোরেট পুঁজি গবেষণার নামে অর্থ দিয়ে দলে টানে। তারপরও সেখানে নোম চমোস্কির মতো বুদ্ধিজীবী থাকেন। ট্রাম্পের মতো শাসকের বিরুদ্ধে কয়েকদিন আগে নোয়াম চমোস্কি বলেছেন, ‘আমার মনে হয় সাজানো বা কথিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনার বিষয়টি আমাদের উপেক্ষা করা উচিত হবে না। যে ঘটনা মুহূর্তেই দেশ বদলে দেবে।’

মুসলমানদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের যে অবস্থান, তা যৌক্তিক প্রমাণ করতে গিয়ে সাজানো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানো হতে পারে। এর মাধ্যমে ট্রাম্প তার হারানো জনপ্রিয়তা ফেরানোর চেষ্টা করতে পারেন এবং তার কর্মকাণ্ড জায়েজ করার যুক্তি খুঁজতে পারেন। স্পষ্ট করে একথা বলেছেন মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমোস্কি। এর কয়েক দিন পরেই সিরিয়ায় জীবাণু অস্ত্রের নাটক এবং মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা দেখা গেছে। দেশের অভ্যন্তরেও হয়তো সন্ত্রাসী কোনও ঘটনা ঘটতে দেখা যেতে পারে। অথবা আগে থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করায় এ থেকে সরেও আসতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন।

ধর্মীয় পরিচয়ে যিনি প্রোটেস্ট্যান্ড, জেরুজালেমে জন্ম নেওয়া বুদ্ধিজীবী অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ পশ্চিমা আগ্রাসন এবং ইসরায়েলের দানবীয় নীতির বিরুদ্ধে সারা জীবন সোচ্চার থেকেছেন, সকল রকম বিপদকে তুচ্ছ করে। বাংলাদেশে একজন আহমদ ছফা সকল বিপদকে তুচ্ছ করে সারাজীবন সেচ্চার থেকেছেন। তীব্র ভাষায় কথা বলে জীবন দিয়ে গেছেন হুমায়ুন আজাদ।

এসব উদাহরণ যখন দিচ্ছি, তখন দেশের বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র বিশ্লেষণ করা বড়ই বিপদজনক- ঝুঁকিপূর্ণ। বুদ্ধিজীবীরা যেহেতু দলীয় ক্যাডারে পরিণত হয়েছেন, তারা দলকে ব্যবহার করে ক্ষিপ্ততা প্রকাশ করেন। আবার দলও ক্ষিপ্ত হবে, তার অনুগত-পোষা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কথা বলায়। বহুবিধ ঝুঁকি সত্ত্বেও সাম্প্রতিক ঘটনার আলোকে সংক্ষেপে কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি।

১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর দল আওয়ামী লীগ এই সফর নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। বিরোধী দল বিএনপি সমালোচনা করবে, সেটাও অস্বাভাবিক নয়। এর বাইরে বিশেষজ্ঞ বা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একটা নির্মোহ অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন ছিল। তাদের থেকে আওয়ামী লীগের উচ্ছ্বাস, বিএনপির সমালোচনার বাইরে, দেশের স্বার্থ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দিকনির্দেশনামূলক কথা-লেখা প্রত্যাশিত ছিল। তারা প্রায় কিছু লিখলেন না। যারা লিখলেন তার প্রায় সবই দলীয় প্রচারপত্র। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই পক্ষের ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। টকশোতে সাবেক রাষ্ট্রদূত-শিক্ষক-সাংবাদিক... যাদের ডাকা হলো, তাদের প্রায় সবাই কথা বললেন দলীয় কর্মী-ক্যাডারের ভাষায়।
‘দেশ বিক্রি করে দিল, স্বাধীনতা গেলো, সার্বভৌমত্ব গেলো’ - বিএনপির এই দুর্গন্ধযুক্ত বক্তব্যের প্রায় হুবহু প্রতিধ্বনি ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে বোঝানোর চেষ্টা করলেন তাদের অনুগত বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ। আরেকটি অংশ নিরব। যেন কোথাও কিছু ঘটছে না।

‘তিস্তা চুক্তি হওয়া সময়ের ব্যাপার, তিস্তা বড় ইস্যু নয়, দিল্লি জয় করে ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী’- আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের কথারই প্রতিফলন দেখা গেলো আওয়ামী শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্যে। নির্মোহ-যৌক্তিক-বুদ্ধিবৃত্তিক কোনও বিশ্লেষণ কোনও পক্ষ থেকেই পাওয়া গেলো না।

এর বিপরীতে ভারতের দিক থেকে কী দেখলাম? বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ায় কাজ করে যাওয়া তিনজন সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জী, বিনা সিক্রী, পিনাক রঞ্জনকে দেখা গেলো অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকায়। তারা অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে কথা বললেন। ভারতের স্বার্থ অগ্রাধিকার দিয়ে লিখলেন, তবে বাংলাদেশের স্বার্থের কথা একেবারে ভুলে গেলেন না। তিস্তা চুক্তি বিষয়ে কেউ নিরব থাকলেন না। তিস্তার পানি যে বাংলাদেশের অধিকার,  লিখলেন অনেকে। তাদের লেখা বাংলাদেশের পত্রিকায় অনুবাদ করে ছাপা হলো। ভারতীয় গণমাধ্যমও বাংলাদেশের স্বার্থ গুরুত্ব দিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ করলো। সেদিক থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিশ্লেষণও যথেষ্ট দুর্বল বলেই প্রতীয়মান হলো।

২. এত বড় প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দিল্লি গেলেন। সেখানে পানি বিশেষজ্ঞ কেউ ছিলেন বলে দৃশ্যমান হলো না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তিস্তার পরিবর্তে তোর্সাসহ অন্য নদীর পানির কথা বললেন, তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে এ তথ্য দেওয়ার মতো কেউ ছিলেন না যে, এটা সময় ক্ষেপণের একটা অবাস্তব প্রস্তাব। আমরা তা জানলাম কলকাতার পানি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের বক্তব্য থেকে। এই কল্যাণ রুদ্রকেই মমতা কংগ্রেস সরকারের সময়ে তিস্তা বিষয়ে গবেষণার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কল্যাণ রুদ্র ঘনিষ্ঠ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেই কল্যাণ রুদ্র অবাস্তব বলে মমতার প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিলেন। আমাদের কোনও বিশেষজ্ঞ মমতার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কোনও লেখা লিখতে পারলেন না।

‘মমতা ব্যানার্জির বিকল্প প্রস্তাব বাংলাদেশ- ভারত কোনও পক্ষই গুরুত্ব দেয়নি, দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতেও বিষয়টি নেই’- গত দু'দিন ধরে অনবরত এমন কথা শুনছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গীদের অনেককেই একথা বলতে শুনছি। গণমাধ্যম লিখেছেও।

সাংবাদিক- নদী বিষয়ক গবেষক শেখ রোকন জানাচ্ছেন, মমতা ব্যানার্জি যে 'তোর্সা' নদীর কথা বলেছেন, বাংলাদেশের 'দুধকুমার' নদী-ই ভারতে তোর্সা নামে পরিচিত। এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতির ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে সাতটি নদী ' ফেনী, মনু, মহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার'- বিষয়ে আলোচনার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মমতার প্রস্তাব ভারত গুরুত্ব দিয়েই নিয়েছে। তিস্তার আলোচনা থেকে শুধু মমতা নয়, মোদিও সরে যেতে চাইছেন, তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। দেখে- বা না দেখে, জেনে বা না জেনে বাংলাদেশও মমতার প্রস্তাবকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি অন্তরভূক্তির পর বলার সুযোগ থাকে না যে, গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মোদির মৌখিক সত্ত্বেও কার্যত তিস্তা চুক্তি নতুন করে অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে।
আমাদের নদী বিষয়ক কোনও বিশেষজ্ঞ বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন না। তবুও আমরা শেখ রোকনের মতো তরুণদের গুরুত্ব না দিয়ে, গুরুত্ব দেই বিবেক বিক্রিত তথাকথিত নদী বা পানি বা পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের।

দেশের এমন একজন পানি বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীর রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের একটি নমুনা দিলে কল্যাণ রুদ্রদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য দৃশ্যমান হবে। আমাদের সেই বুদ্ধিজীবী-বিশেষজ্ঞ অন্য ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। সালাম দিয়েই বুদ্ধিজীবীর প্রথম বক্তব্য ছিল, ‘আপা আমি আপনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ চাই’। সেখানে উপস্থিত অন্যরা এ ওর মুখের দিকে তাকাতে শুরু করলেন। কল্যাণ রুদ্রদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডাকেন। তারা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নির্মোহ গবেষণা করে প্রতিবেদন দেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাওয়া তাদের বিবেচনায় থাকে না। আমাদের বুদ্ধিজীবী গবেষক বা বিশেষজ্ঞরা প্রথমে আনুগত্য প্রকাশ করে নেন যে, আপনি যা চাইছেন বা চাইবেন, আমি তা করার জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছি।

৩. বুদ্ধিজীবী শ্রেণির দলীয় আনুগত্য এবং নৈতিক স্খলনের কারণে, বাংলাদেশের স্বার্থে বিশেষ করে ভারত বিষয়ে কথা বলা একটা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বিএনপি তথ্য-উপাত্ত এবং বাস্তবতা বিবর্জিতভাবে ভারত বিরোধিতা করে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরকে কেন্দ্র করে বিএনপির বক্তব্য শুধু অন্তসারশূন্যই নয়, চরম হাস্যকরও বটে। তারা একদিকে বলছে প্রতিরক্ষা সমঝোতা মানে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব চলে যাওয়া, আবার বলছে তিস্তা চুক্তি এবং দ্বিপক্ষীয় সমস্যার সমাধান ছাড়া প্রতিরক্ষা সমঝোতা গ্রহণযোগ্য হবে না। যে সমঝোতায় সার্বভৌমত্ব চলে যাবে, দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধান বা তিস্তা চুক্তি হলেই তা গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে? আপনাদের ভাষায় ‘সার্বভৌমত্বই’ যদি না থাকে, তিস্তা চুক্তি দিয়ে কী করবেন?

৪০ বছর আগের রাজনীতি, শিশুসুলভ ভারত বিরোধিতা বিএনপি এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, বাংলাদেশের পক্ষে কথা বললেও, তা ভারত বিরোধিতা হিসেবে দেখার চেষ্টা হয়। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি দায়িত্ব পালন না করায় এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

৪. কোনটা হাস্যরস আর কোনটা হাস্যকর, কোনটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব আর কোনটা দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা, তা রাজনীতি এবং আমলাতন্ত্র যেমন বুঝতে পারছেন না, বুদ্ধিজীবীরাও বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন না। চুক্তি-সমঝোতা ২২টি, ৩৪টি না ৩৬টি, তা নিশ্চিত না বাংলাদেশ। অথচ চার দিনের সফর শেষ করে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে এসেছেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানালেন, চুক্তি ১১ টি সমঝোতা ২৪ টি মোট ৩৫ টি।

দিল্লিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব হাসতে হাসতে বলেছেন ‘কয়টি, এখনও গুনে শেষ করতে পারিনি’। 

এটা কি হাসির বিষয় ১, ২, ৩ করে গোনার বিষয়? এর ব্যাখ্যা যদি এভাবে করা হয় যে, কী চুক্তি- কয়টি চুক্তি- সমঝোতা সব ঠিক করেছে ভারত, বাংলাদেশ কিছু জানত না। যে কারণে চুক্তি-সমঝোতার সংখ্যা পর্যন্ত বলতে পারছেন না, ভেতরে কী আছে বলবেন কী করে! যৌথ বিবৃতি প্রস্তুতের সময় কী বাংলাদেশের সম্মতির প্রয়োজন হয়নি?

দেশের একজন লেখক-বুদ্ধিজীবী-বিশেষজ্ঞ বিষয়টি নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ করলেন না।
দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণায় এত বিষয় অন্তর্ভূক্ত হলো যার কিছু বাংলাদেশের জন্যে একেবারেই গুরুত্বহীন। যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের ভিসা, চিকিৎসা, সীমান্ত হাট, কমিউনিটি ক্লিনিকে সহায়তা প্রভৃতি। যৌথ নদী কমিশনের বিষয়টি আলোচনায় তো থাকলই না, যৌথ ঘোষণায়ও স্থান পেল না। পানি সমস্যাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানতম সমস্যা। পানি বিশেষজ্ঞ বা একজন বুদ্ধিজীবীও বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন না, লিখলেন না।
৫. কয়েকদিন আগে একজন নেপালিকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে। নেপালের রাজনীতিবিদ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের মুখে ভারত দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে। একজন শ্রীলঙ্কান জেলেকে ভারতীয় নৌবাহিনী ধরে নিয়ে গেলে, যে প্রতিবাদ শ্রীলঙ্কা সরকার ও তাদের বুদ্ধিজীবী-নাগরিক সমাজ করেন, ভারত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। সীমান্তে প্রায় প্রতিদিন বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা করে। বিজিবি পতাকা বৈঠক করে লাশ ফেরত আনে। সরকার নির্বিকার থাকে। এর আগে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, সীমান্তে দু’একটি হত্যাকাণ্ডকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ বলেন, সীমান্তে গরু আনতে না গেলে হত্যাকাণ্ড ঘটবে না, হত্যাকাণ্ড আগের চেয়ে কমেছে। অর্থাৎ হত্যার পক্ষেই তাদের এক ধরনের অবস্থান।
শ্রীলঙ্কা-ভারত নৌ সীমান্তেও চোরাচালন হয়, নেপাল-ভারত সীমান্তেও হয় চোরাচালান। গুলি করে নেপালি বা শ্রীলঙ্কান চোরাচালানীদের হত্যা করা হয় না। হত্যা করা হয় বাংলাদেশিদের। সরকার প্রতিবাদ করে না। গণমাধ্যমের কাছেও প্রায় গুরুত্বহীন। বুদ্ধিজীবীরা নিরব-নিশ্চুপ।
৬. যে কোনও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান, প্রতিনিধিত্বহীনদের প্রতিনিধিত্ব করার কথা বুদ্ধিজীবীদের। পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিয়ে বিতাড়িত করে পুলিশ, বুদ্ধিজীবীরা নিরব থাকেন। পাহাড়িরা নির্যাতিত হয়, বুদ্ধিজীবীদের কান পর্যন্ত সেই নির্যাতনের আওয়াজ এসে পৌঁছায় না। গুম-নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সন্তান-স্বামী-বাবার ছবি নিয়ে গ্রাম থেকে অসহায় মানুষগুলো নগরে ছুটে আসেন। তাদের আকাশ-বাতাস কাঁপানো কান্না বুদ্ধিজীবীদের বিবেক পর্যন্ত পৌঁছায় না। সুন্দরবন ধ্বংসের প্রকল্প রামপাল নিয়ে বুদ্ধিজীবী-বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ সরকারের তোষামোদী করেন, কেউ কেউ নিরব থাকেন। যে শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-অ্যাকটিভিস্টরা সরব থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
৭. তিস্তা চুক্তি নিয়ে মোদি-মমতার রাজনৈতিক কৌশলের ফাঁদে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ দেখছি, মমতা তা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তার এটা করা দরকার। বিজেপি পঞ্চায়েতসহ আগামী নির্বাচনগুলোতে পশ্চিমবঙ্গে ভালো করতে চায়। মমতাকে দিয়ে তিস্তা চুক্তি করিয়ে মোদি প্রমাণ করতে চান যে, মমতা পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ দেখেননি। মমতা চান কেন্দ্র তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলুক। তখন মমতা বলবেন বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ দেখেনি। মোদি-মমতার রাজনৈতিক খেলায় বঞ্চিত বাংলাদেশ। কোনও বুদ্ধিজীবী-বিশ্লেষক-বিশেষজ্ঞ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থে কথা বলছেন না।
৮. এক বুদ্ধিজীবীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখাশোনা করার। সেখানে চরম অরাজকতা চলছে। এই বুদ্ধিজীবীর সেদিকে নজর নেই। তিনি প্রতিনিয়ত বিএনপিকে বিষোদ্গার করে কলাম লিখছেন, টকশোতে কথা বলছেন। বিএনপিকে বিষোদ্গার করে কথা বলার জন্যে তো আওয়ামী লীগে নেতার অভাব নেই। অথচ নেতাদের দায়িত্ব বুদ্ধিজীবী নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। মানুষ ভোট দিতে যায় না, বুদ্ধিজীবীরা সংবাদ সম্মেলন ঘোষণা দেন 'নির্বাচন ভালো হয়েছে'। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইনে একের পর এক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা হয়, বুদ্ধিজীবীরা নিরব থাকেন।

ভারত সফর নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা উৎফুল্ল। সম্মান-শ্রদ্ধা দেখানোয়, আবেগে তাদের অনেকের চোখে প্রায় পানি চলে আসছে। দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনের রাজনীতিতে তা আসতেই পারে। বুদ্ধিজীবীরাও আবেগে টইটম্বুর হয়ে থাকবেন? গণমাধ্যম কর্মীরা কেন তথ্যভিত্তিক সংবাদ প্রকাশে গুরুত্ব না দিয়ে, গদগদ ভাব প্রকাশ করবেন। শ্রদ্ধা-সম্মান আমাদের দেখিয়েছে, এতে আমরা অবশ্যই খুশি, আপ্লুতও হতে পারি। তা প্রকাশ করতে গিয়ে কেউ কেউ তো প্রায় কেঁদে দিচ্ছি। এর নাম তো পেশাদারিত্ব নয়।
পেশাদারিত্ব, শ্রদ্ধা-সম্মানের দিকটি ধারণ করে, বাংলাদেশের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির নির্মোহ বক্তব্য দেওয়ার দৃষ্টান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে করে দেখিয়েছেন। ফিরে এসে দেশের গণমাধ্যম বা সংবাদ সম্মেলনে তিনি সফরের সাফল্য নিয়ে যাই বলেন না কেন, ভারতের মাটিতে ভারতীয়দের সামনে তিনি বলতে পারলেন, ‘পানি চেয়েছিলাম, বিদ্যুৎ পেলাম। কিছু তো পেলাম’।

এই সফরে তাকে যে শ্রদ্ধা-সম্মান দেখানো হয়েছে, তাতে যে তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন, তা পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন।
যাদের দায়িত্ব ছিল, যাদের কাছে প্রত্যাশা ছিল সেই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তা তুলে ধরেননি, পারেননি। চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
৯. বিএনপি যেহেতু যৌক্তিক সমালোচনা করে না, ফলে তাদের বক্তব্য অহেতুক ভারত বিরোধিতা ছাড়া আর কোনও গুরুত্ব বহন করে না। সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা যেহেতু তোষামোদী করেন, আনুগত্য প্রকাশের প্রতিযোগিতা করেন, নির্মোহ বিশ্লেষণ করেন না, ফলে সফরের প্রাপ্তির দিকগুলো নিয়েও যখন তারা কথা বলেন, মানুষের কাছে তা বিশ্বসযোগ্যতা পায় না। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিরবতায়, বুদ্ধিজীবীরা জনমানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছেন। এই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, আস্থা ইচ্ছে করলেও, আবার অর্জন করা খুব কঠিন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা তাদের অবস্থান থেকে সবচেয়ে সঠিক ( বাংলাদেশের জন্যে সবচেয়ে ক্ষতি) কাজটি করতে পেরেছিল, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। সেই ফল আমরা এখন ভোগ করছি।
আমাদের এখনকার বুদ্ধিজীবীদের নৈতিক স্খলনের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাদের থেকে আর আশা করার কিছু নেই। তারা তাদের প্রাপ্তি বিবেচনায় আবার কখনও হয়তো সরব হবেন বা হওয়ার চেষ্টা করবেন। তা মানুষ গুরুত্ব বা বিবেচনায় নেবে বলে মনে হয় না।
‘তারা কেন কথা বলেন না’- বুদ্ধিজীবীদের থেকে এমন প্রত্যাশা করা সম্পূর্ণরূপে বাদ দিতে হবে। তারা গুরুত্বহীন আছেন, তাদের আরও গুরুত্বহীন করে দিতে হবে। রামপালবিরোধী প্রতিবাদ তাদের ছাড়া চলছে, ফুলবাড়ী আন্দোলন, কানসাট আন্দোলন, আড়িয়াল বিলের আন্দোলন, সাঁওতালদের পক্ষে দাঁড়ানোর আন্দোলন তাদের ছাড়া হয়েছে। তাদের নিরবতা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি কোনও গুরুত্ব বহন করেনি।
তথাকথিত বিবেক বিক্রিত বুদ্ধিজীবীদের ছাড়াও বাংলাদেশ তার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিশ্চয়ই বিজয়ী হবে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ