X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভাস্কর্য সমাচার এবং বিক্রি হয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব

গোলাম মোর্তোজা
১৬ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৩২আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৩৪

গোলাম মোর্তোজা সুপ্রিম কোর্টের সামনে ‘থেমিস’ স্থাপন করা হয়েছে। যা ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে সারা পৃথিবীতে পরিচিত। স্থাপন করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াত বা অন্য কোনও সরকারের সময়ে নয়, বর্তমান সরকারের সময়ে। হেফাজতে ইসলাম মিছিল-হুমকি দিচ্ছে ‘গ্রিক মূর্তি’ সরাতে হবে। হুমকি-ধামকি গত কয়েক মাস ধরে চলছে। শিল্প বোদ্ধা, জ্ঞানী-গুণী, শিক্ষক-সাংবাদিক-নাগরিক সমাজের তেমন কাউকে হেফাজতের সঙ্গে সুর মেলাতে দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী হেফাজত মাওলানা শফীর সঙ্গে মিটিং করার পর, একদল লোককে আবির্ভূত হতে দেখা গেলো। মৃণাল হকের এই শিল্পকর্ম নান্দনিক নয়, সরানোই উচিত। ভাস্কর্যটি শিল্পসম্মত হয়নি, সরানো উচিত। গ্রিক দেবীর মূর্তি কেন সুপ্রিম কোর্টের সামনে থাকবে, বাংলাদেশের বিচার তো গ্রিক আইন অনুযায়ী চলে না, সুতরাং মূর্তি সরাতে হবে। ভাস্কর্য এবং মূর্তি এক নয়, সেই ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন অনেকে।
হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক মিল- মহব্বতের সমীকরণে দেশের রাজনীতি-সংস্কৃতি অঙ্গণের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে। হেফাজতের সমর্থক বিএনপি এখন হেফাজত বিরোধী। আওয়ামী লীগ এবং সরকার সংশ্লিষ্ট সুবিধাবাদী একটি চক্র যারা যে কোনও ইস্যুতে লেখেন এবং বলেন ‘এখন তারা কী বলবেন’ নিরব-নিশ্চুপ। প্রায় বধির হয়ে গেছেন। হেফাজত হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় বিএনপি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
হেফাজতকে নিয়ে বাংলাদেশে যে রাজনীতি, সেই রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, নাগরিক সমাজের অবস্থান একটু পেছনে ফিরে দেখার চেষ্টা করছি।
১. প্রথমে আসি ভাস্কর্য থেমিস প্রসঙ্গে। হেফাজত ভাস্কর্য বলে না, মূর্তি বলে। মূর্তি না ভাস্কর্য, সেই আলোচনাতেও যাবো না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও মূর্তি হিসেবেই উল্লেখ করেছেন ভাস্কর্যটিকে। বলেছেন, ‘গ্রিক মূর্তিকে আবার শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা আমারও পছন্দ হয়নি। এটা সরানোর ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলব। আমার ওপর আস্থা রাখেন। হই-চই করার দরকার নেই।’

প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রেখে এখন উল্লসিত হেফাজত।

২. প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর অনেকে বলছেন, ভাস্কর্যটি নান্দনিক নয়। এটা দেখা চোখের জন্যে কষ্টকর।

মৃণাল হকের কোনও শিল্পকর্মই নান্দনিক নয়। এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। নান্দনিক নয় বলে যদি ভাস্কর্যটি সরানোর সিদ্ধান্ত হয়, ভালো সিদ্ধান্ত। আলোচনাটা হওয়া দরকার এটা সরিয়ে নান্দনিক আরেকটি ভাস্কর্য সেখানে স্থাপন করা হবে। থেমিসকে শাড়ি না পরিয়ে থেমিসের যে পোশাক ‘ন্যায় বিচারের প্রতীক’র যে আসল ভাস্কর্য, তেমন একটা নির্মাণ করে স্থাপন করা হবে, প্রধানমন্ত্রীর যদি শাড়ি পরানো নিয়ে আপত্তি থাকে। তখন আবার শ্লীল-অশ্লীল প্রসঙ্গ সামনে আনা হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেমিসের ভাস্কর্যের পোষাক, সেই দেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট অনুযায়ী পড়ানোর রেওয়াজ আছে।

আসলে হেফাজতের চাওয়া অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর্যটি সরানোর ব্যবস্থা করছেন। এর সঙ্গে শাড়ি-লুঙ্গি, মৃণাল হক, নন্দনতত্ত্বের কোনও সম্পর্ক নেই।

মৃণাল হকের করা শিল্পকর্ম এই নগরে একটিই নয়। বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছর আগে বিস্তারিত রিপোর্ট করা হয়েছিল ‘সাপ্তাহিক’-এ। শিল্পকর্মগুলোর কোনোটিই মানসম্পন্ন নয়। যেমন রূপসী বাংলার সামনে ঘোড়ার গাড়ি। এটা পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি নয়। বিদেশি ঘোড়ার গাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের ‘রত্নদীপ’র ঝিনুকগুলো দেশি ঝিনুক নয়। এয়ারপোর্টের সামনের ঈগলটি, আমেরিকান ঈগলের প্রতিচ্ছবি। সাত রাস্তার মোড়ের ময়ূর বাংলাদেশের ঐতিহ্য নয়। বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী রফিকুন নবী, হাসেম খান, নেসার হোসেন, প্রয়াত কাইয়ুম চৌধুরীসহ কারও চোখেই এগুলো নান্দনিক শিল্পকর্ম নয়।

এগুলো অপসারণ করে নান্দনিক শিল্পকর্ম স্থাপন করা দরকার, এটা যৌক্তিক বক্তব্য। হেফাজতের বক্তব্য অপসারণই করা দরকার, প্রতিস্থাপন নয়। হেফাজতের ভাষায় যারা কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছেন, তারা নান্দনিকতার প্রসঙ্গ আনছেন। নান্দনিকতার প্রসঙ্গ আসলে, হেফাজতের দাবি এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরে তারা কথা বলতেন না। যাদের চোখের কষ্ট এখন হচ্ছে, তারা হেফাজতের চোখ দিয়ে দেখছেন- নিজেদের চোখ দিয়ে নয়। অথবা নিজেদের চোখও আসলে হেফাজতেরই চোখ, এতদিন ভান ধরে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর স্বরূপে ফিরেছেন।

৩. নন্দনতত্ত্বের যুক্তিটি এতই দুর্বল এবং হাস্যকর যে, তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন। কেউ কেউ তা অনুধাবন করে বলে ফেলছেন ‘অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হয়’ সে কারণেও মূর্তি সরানো উচিত। ‘ধর্মীয়’ অনুভূতিতে আঘাত - এটাকে বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না? তালিকাটা কেমন হবে?

ক. সেনানিবাসের ভেতরের ‘শিখা অনির্বাণ’ ইসলামী ঐক্যজোটের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়। এর বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য, আন্দোলন আছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সামনের শিখা চির অম্লান নিয়ে কথা তোলা হবে, আন্দোলন হতে পারে।

খ. ভাস্কর্য ‘দূরন্ত’ যারা ভেঙেছিল, তারাও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথাই বলেছিল।

গ. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলেই প্রতিবছর প্রতীমা ভাঙচুর করা হয়।

ঘ. শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য, নভেরার শিল্পকর্ম, শামীম সিকদারের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে নাকি আঘাত দেয়। এখন এগুলোর বিষয়ে হেফাজত কথা বলছে না, থেমিস অপসারণ সাফল্যের পর, হেফাজতের ধর্মীয় অনুভূতিতে এগুলোও আঘাত হানবে।

ঙ. কলকাতার মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগছে এই যুক্তিতেই তারা বেকার হোস্টেল থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবি তুলেছে।

৪. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকে বিবেচনায় নিলে, এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন হবে? মমতা ব্যানার্জী যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং মুসলমানদের ভোটের বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণ করেন, সমর্থন করবেন?

শামীম সিকদারের করা বঙ্গবন্ধুর বিশাল ভাস্কর্যটি যে মোটেই নান্দনিক বা শিল্পসম্মত নয়, তা নিয়ে দ্বিমত নেই বললেই চলে। সেটাকে শিল্পসম্মত করার কথা বলাই যায়। যদি বলা হয়, এটা অপসারণ করতে হবে? যেহেতু শিল্পসম্মত নয়, নান্দনিক নয়। তখন কী বলবেন? রাষ্ট্রের অবস্থান বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান কী হবে?

৫. পাকিস্তানিরা যখন হিন্দু সংস্কৃতি বলে রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল, পক্ষে তখনও কিছু শিক্ষক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী পেয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও একই মতাদর্শের কিছু মানুষ তো এখনও আছে। তাদেরকে সরকার সঙ্গে পেয়েছে। এদের যেহেতু বুদ্ধি আছে, এদের চাতুরতাটাও বুদ্ধিদীপ্ত। এতটাই বুদ্ধিদীপ্ত যে, চাতুরতা চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। যেমন একজন বলছেন, ‘এটা আওয়ামী লীগের আপস নয়, উপলব্ধি’।

পাঠ্যপুস্তক হেফাজতিকরণ, আপস নয় উপলব্ধি। হেফাজতের দাবিতে ভাস্কর্য অপসারণ, আপস নয় উপলব্ধি। শফী হুজুরকে পাশে বসিয়ে আলোচনা, আপস নয় উপলব্ধি। কওমি মাদ্রাসার কারিকুলাম, শিক্ষক- শিক্ষার মান, পরীক্ষা পদ্ধতি কোনও কিছু কোনও পর্যায়ের মধ্যেই পড়ে না। সেই শিক্ষার স্বীকৃতি আপস নয় উপলদ্ধি। যে গাছের শিকরই নেই, সেই গাছের ওপরের দিকে পানি ঢালা, আপস নয় উপলদ্ধি।

নিশ্চয়ই এরপর তিনি ‘আপস’ এবং ‘উপলব্ধি’র সংজ্ঞাও দেবেন। তিনি বলেছেন ‘বিএনপি জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট করেছে, সে কারণে হেফাজতসহ যেসব ইসলামি দল তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে তাদের সঙ্গে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।’

এতদিনের  বক্তব্য ছিল বিএনপিকে জামায়াত ছেড়ে আসতে হবে। যেহেতু বিএনপি জামায়াত ছাড়ল না, সেহেতু আওয়ামী লীগ হেফাজতকে টেনে নিল। বাংলা বা হিন্দি সিনেমার সেই নায়কের মতো ব্যাপারটা। মাস্তানকে ভালো হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, মাস্তান ভালো হলো না। নায়ক নিজেই আরও বড় মাস্তান হয়ে গেলেন। হেফাজত-আওয়ামী লীগ মহামিলনের যুক্তিটা খারাপ না। চোখেমুখে দেখা যাওয়া চাতুরতাপূর্ণ।

তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ ‘মেনে নিয়েছে’ কারা? জামায়াত যতটা মানেনি, শফী হুজুররাও ততটাই মানেননি। কওমি মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না। মেনে নেওয়া না নেওয়া বোঝানোর জন্যে আর কোনও উদাহরণ দেওয়ার দরকার নেই। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ করেছে জামায়াত। মাওলানা শফীরা কী করেছে? জামায়াতের মতো দলীয়ভাবে যুদ্ধাপরাধ করেছে, তার প্রমাণ নেই। কিন্তু শফী হুজুররা একাত্তরে করেছেন কী? মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন? এর স্বপক্ষে তথ্য নেই।

একাত্তরে কী করেছিলেন, শফী হুজুররা জীবনপঞ্জিতে তা উল্লেখ করেন না।

এর থেকে ধারণা করা যেতেই পারে, একাত্তরে তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছে। জামায়াতের মতো না হলেও, অবস্থান বাংলাদেশের বিপক্ষেই ছিল। বাহ্যিকভাবে জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের পার্থক্য বা বিরোধ আছে। আবার বাংলাদেশের জঙ্গি ইস্যুতে তাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান থেকে শুরু করে যত জঙ্গিদের তথ্য জানা গেছে, দেখা যায় কওমি মাদ্রাসার এবং জামায়াত শিবিরের কর্মী ক্যাডাররাই জঙ্গি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে জানা গেলো ইংরেজি মাধ্যমের বিত্তবানের সন্তানরাও জঙ্গি হচ্ছে।

মেঘের গর্জনের সময় হটটিটি পাখি পা আকাশের দিকে তুলে দেয়। যদি আকাশ ভেঙে পড়ে পা দিয়ে সে ঠেকাবে। চারিদিক থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়ছে, এই চতুর শ্রেণির প্রতিনিধিরা পা ওপর দিকে তুলে দিয়েছেন। হটটিটি পাখি বিশ্বাস থেকে বিপদের সময়ে কিছু  একটা করতে চায়।

আমাদের বুদ্ধিমানরা চাতুরতা করে পা ওপরের দিকে তোলে। লুঙ্গি- ঝুটিধারীরা উলঙ্গ হয়ে ইতিমধ্যেই চাতুরতা প্রমাণ করেছেন। এখন প্যান্ট- ঝুটিধারীদের প্যান্ট হাঁটুর ওপরে ওঠে গেছে, ক্রমশ যা কোমরের নিচে নেমে যাচ্ছে।

নিজেরা উলঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের সব কিছু ধ্বংস প্রক্রিয়ায় সহায়তা করছেন, নিজের লাভের কাছে সবকিছু বিক্রি করে দিচ্ছেন। হাতের ‘কলম’ বিবেক বিক্রি করছেন। একটুও লজ্জাবোধ জাগছে না। বিবেক বিক্রি করে দেওয়ার পর লজ্জা বলে তো কিছু থাকার কথাও নয়।

৬. ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের তাণ্ডব, বিএনপি- জামায়াতের সমর্থন। কোরানশরীফ পুড়িয়ে সরকারকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল হেফাজত। এই দাবি সরকার, সরকার প্রধানের। সরকার হেফাজতকে শক্ত হাতে দমন করেছিল। তার প্রতিবাদ করেছিল বিএনপি- জামায়াত। হেফাজত হাজার হাজার মানুষ হত্যার অভিযোগ তুলেছিল সরকারের বিরুদ্ধে। হেফাজতের দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান শুভ। জেলে পাঠিয়ে শুভর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল সরকার।

হেফাজতের প্রধান মাওলানা শফী নারীদের ‘তেঁতুল’র সঙ্গে তুলনা করে, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অশ্লীল কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে মাওলানা শফীকে ‘তেঁতুল হুজুর’ বলেছেন। জঙ্গি বলেছেন। সেই ‘তেঁতুল হুজুর’কে পাশে বসিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাবি মেনে নিচ্ছেন। এই মাওলানা শফি বলেছিলেন, ' নাস্তিকদের কতল করা ওয়াজিব হয়ে গেছে'। তারপর নাস্তিক আখ্যা দিয়ে অনেক মানুষকে কতল করতে দেখা গেছে। সেই শফী মাওলানার পাশে এখন প্রধানমন্ত্রী!

এই দৃশ্য দেখে এখন যারপরনাই হতাশ বিএনপি। বিএনপির অবস্থান বদলে গেছে। হেফাজতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। আগে হেফাজতকে নিয়ে কিছু লিখলে বিএনপি নেতা-কর্মী-সমর্থকরা, বিষোদ্গার করতেন লেখকের। এখন তারা লেখকের পক্ষে, হেফাজতের বিরুদ্ধে লিখছেন। আগে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা হেফাজতকে বিষোদ্গার করা ছাড়া কোনও মন্তব্য করতেন না, এখন তাদের অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে। অনেকে ইতিমধ্যে হেফাজতের পক্ষে সহানুভূতিশীলতা প্রকাশ করে ফেলেছেন, অনেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অপেক্ষা করছেন। চাতুরতার উপায় খুঁজছেন।

৭. বিএনপি বলত তারা যদি জামায়াতকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ টেনে নেবে। আমরাও বলেছি, আর যাই হোক আওয়ামী লীগ কোনোদিন জামায়াতকে সঙ্গে নেবে না। কয়েকদিন আগেও মনে করা হয়েছিল, আর যাই হোক হেফাজতের চাওয়া অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার ভাস্কর্য অপসারণ করবে না।

তখন চিন্তাও করা যায়নি, মাওলানা শফীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাশাপাশি বসে আলোচনা করবেন। হেফাজতের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করবেন। মাওলানা শফীর পাশে শেখ হাসিনার ছবির পর, একথা কি বলা যায় যে, জামায়াতকে আওয়ামী লীগ কখনও সঙ্গে নেবে না?

৮. রাজনীতি-রাজনৈতিক নেতা-কর্মী আর সামাজিক সাংস্কৃতিক নেতা-কর্মী, এক নয় আলাদা বিষয়। রেওয়াজটা ছিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দিকে তাকিয়ে, রাজনীতিবিদরা নীতি নির্ধারণ করতেন। আস্তে আস্তে রেওয়াজটা বদলে গেছে। এখন সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতা-কর্মীরা রাজনীতির সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছেন। রাজনীতিবিদরা সাংস্কৃতিবিদদের কাছে আসেন না। সাংস্কৃতিবিদরা রাজনীতির পায়ের কাছে বসে থাকার রেওয়াজ চালু করেছেন।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন ছিল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বাম এবং আওয়ামী লীগ সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল, নেতৃত্বে ছিল না। নেতৃত্ব ছিল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মাধ্যমে জাহানারা ইমামদের হাতেই। আবদুর রাজ্জাকের মতো রাজনীতিবিদরা সঙ্গে থেকেছেন, কিন্তু আন্দোলনের নীতি-নির্ধারণ করেছেন সামাজিক সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব তথা জাহানারা ইমামরাই। এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব। নিজেদের নেতৃত্ব রাজনীতির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।

যে শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দুঃসাহসিক কাজ করলেন, অন্য কেউ যা করতেন না। সেই শেখ হাসিনা মাওলানা শফীকে পাশে বসালেন। সামান্যতম যুক্তি না থাকলেও কওমি মাদ্রাসাকে মাস্টার্সের স্বীকৃতি দিলেন। শিক্ষক-শিক্ষাবিদ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতা-কর্মীদের জোরালো বক্তব্য নেই। দু’একজন ‘মিন মিন’ করছেন, যা করার চেয়ে না করা ভালো। নিজেরা দেশ বিরোধী এশিয়া এনার্জি থেকে ব্যবসার নামে অর্থ নেবেন, আর সাংস্কৃতিক কর্মীদের বলবেন লাঠি ধর!

এখনও আশাবাদের জায়গা এই কর্মীরাই। যারা দেয়াল চিত্র ধ্বংসের প্রতিবাদে, পুরো রাস্তা চিত্র তৈরি করে ফেলে রাতারাতি। এই সাংস্কৃতিক কর্মীরা নিশ্চয়ই লাঠি ধরবে। লাঠি কি শুধু দেওয়াল চিত্র ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ধরবে? বিক্রি হয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক নেতারা রক্ষা পাবেন তো!

এই আওয়ামী লীগ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে ৭ দফা চুক্তি করেছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গণের বিরোধিতা বা প্রতিবাদের মুখে তা বাতিল করেছিল। এখন হেফাজতকে পাশে নেওয়ার যুক্তি নাকি ‘কৌশল’ । জামায়াতকে নিয়েও এই ‘কৌশল’র গল্প বলা হয়েছিল।

জঙ্গিবাদের ভেতরে বসবাস করছেন বাংলাদেশের মানুষ। সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যেখানে আরও বিস্তৃত করার কথা, সেখানে ভাস্কর্য অপসারণের সিদ্ধান্ত হচ্ছে হেফাজতের কথায়। পাঠ্য পুস্তক হেফাজতিকরণ করা হয়েছে তাদের চাওয়া অনুযায়ী । র‌্যালি- শোভাযাত্রা বাতিল হয়ে যায় হেফাজতের দিকে তাকিয়ে। এই সমাজ-সংস্কৃতি দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করা যায় না।

‘কেন আমাদের ৫’টার মধ্যে ঘরে ঢুকে যেতে হবে’- সংস্কৃতিমন্ত্রী এ কথা কার কাছে বলছেন? রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, আপস করাটা বেশ ভালো মতোই শিখেছেন। সরকারের ভেতরে বলতে পারছেন না, গণমাধ্যমকে বলছেন। তাও ভালো যে, গণমাধ্যমকে এখনও বলতে পারছেন। আওয়ামী লীগ জামায়াতকে যখন সঙ্গে নেবে, হয়তো যুক্তি আসবে, যুদ্ধাপরাধীমুক্ত জামায়াতকে রাজনৈতিক ‘কৌশল’র অংশ হিসেবে সঙ্গে নেওয়া যায়।

তখন প্রশ্ন করার মতো কাউকে আওয়ামী লীগের ভেতরে তো পাওয়া যাবেই না, পাওয়া যাবে না বিক্রি হয়ে যাওয়া সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গণের নেতাদেরকেও।

কর্মীরা সব বিক্রি হয়ে যাননি, গেলে রাস্তা চিত্র হতো না, হতো না মঙ্গল শোভাযাত্রাও। আশা সেখানেই।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
ফসলের মাঠে সোনারঙ, তীব্র গরমেও কৃষকের মুখে হাসি
ফসলের মাঠে সোনারঙ, তীব্র গরমেও কৃষকের মুখে হাসি
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ