X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘তোমরা যারা কাসেম পড়ো’

শেগুফতা শারমিন
০২ মে ২০১৭, ১৫:২৫আপডেট : ০২ মে ২০১৭, ১৭:৩৭

শেগুফতা শারমিন দুঃখিত। আপনি যদি মনে করে থাকেন, এখানে কাসেম বিন আবু বাকার নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছি, তাহলে ভুল করেছেন। কাসেম বা কাসেমের মতো লেখকরা আমার বিষয় নয়। তাদের বইপত্রের তালিকা দেখে আপনি যেমন বিস্মিত, ক্রোধান্বিত, আমি তার বিন্দুমাত্র না। কারণ বহুবছর ধরে এসব বই আমি রাস্তার পাশে, বাস স্ট্যান্ডে,  রেল স্টেশনে বিক্রি হতে দেখেছি। সহযাত্রী অনেককে পড়তেও দেখেছি। আমার কোনও দিন পড়তে ইচ্ছাও হয়নি, পড়িনি, হয়তো পড়বও না। যে কারণে এই যে হুজুগ, এই যে উস্কে দেওয়া আলোচনা, সেই হুজুগে আপনিও কাসেমের বই পড়ে ফেললেন। কারণ কাসেমের বই আপনার মেধার সঙ্গে যায়।
অথচ, এর আগে যখন স্যাটানিক ভার্সেস নিয়ে আলোচনা হয়েছে, মানুষ বুঝে না বুঝে তর্কে অংশ নিয়েছে কিন্তু বেশিরভাগই স্যাটানিক ভার্সেস পড়েনি। বলতে পারেন, স্যাটানিক ভার্সেস তো নিষিদ্ধ, পাওয়া যায় না। পেলেও কি কে পড়তো? গড অব স্মল থিংকস পড়েনি। যত আলোচনায় আসুক আপনারা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শওকত আলীর বই পড়বেন না। আনিসুজ্জামানের ‘বিপুলা পৃথিবী’ পড়বেন না। আপনারা হুমায়ুন আজাদ পড়বেন না। কিন্তু গলার রগ ফুলিয়ে হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে তর্ক করবেন। আপনাদের কয়েকজন হয়তো হুমায়ুন আজাদকে চেনেন 'নারী' বা 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল'-এর লেখক হিসেবে। তিনি আহত হওয়ার সময় ও মারা যাওয়ার পরপর 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' বইটির নাম আলোচনায় এসেছিল বলেই হয়তো কিছু মানুষ নামটা জানে। কিন্তু কতজন 'লাল নীল দীপাবলী' বা 'কত নদী সরোবরে' র নাম জানে? কতজন জানে 'বুক পকেটে জোনাকি পোকা'র লেখক কে? কতজন 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না' পড়েছে?
কিন্তু কাসেমের বইয়ের স্ক্রিনশট আপনারা ভাইরাল করে ফেললেন। এ কারণে কাসেম আমার বিষয় নয়। আমার বিষয় ‘আপনি’। হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। স্বয়ং আপনি, এই নাগরিক মধ্য বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত। আপনিই ভালো জানেন, আপনার বাবার প্রজন্ম ছিল নিপাট মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত। সেখান থেকে শ্রেণি উত্তরণ ঘটে। আপনি এখন এক ধাপ ওপরে অবস্থান করছেন। আগের প্রজন্মের চেয়ে আপনি শিক্ষার সুযোগ বেশি পেয়েছেন। এমন শিক্ষা, যে শিক্ষা আপনাকে গ্রাম থেকে বিচ্যুত করে ফেলেছে। আপনার জীবন এখন পুরোপুরি নগরকেন্দ্রিক। এই আপনাকে দেখেই আমি বিস্মিত হই, আমার ক্রোধ জাগে।

কারণ, আপনি এই দেশের স্বঘোষিত প্রতিনিধি। কিন্তু আপনার শেকড় থেকে আপনি ছুটে গিয়েছেন। একধরনের ভাসমান শ্যাওলার মতো জীবন-যাপন করেন, শেকড় কাকে বলে তাও ভুলে গেছেন। আপনি মনে করেন, আপনি এদেশের সংখ্যাগুরু। কিন্তু এই গুরু-লঘু কিসের বিবেচনায় নির্ণীত হয়, তা বলতে গেলে বিরাট এক বিতর্ক করতে হবে। আপনার বন্ধু, সমগোষ্ঠীয় মানুষদের সঙ্গে। আপনারা একমত হতে পারবেন না। কখনও পারেনও না। এ কারণে যেকোনও কিছুতে আপনারা শতভাগে ভাগ হয়ে যান। আপনার ধারণা,  আপনার হাতে থাকা সোশ্যাল মিডিয়া আপনাকে ক্ষমতাশালী করেছে। আপনার সব বিপ্লব, সব স্বপ্ন আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় উজাড় করে দেন। হুট হাট খিস্তিখেউড় লিখে ফেলেন। নিজেকে ‘স্মার্ট’ প্রমাণ করার উচ্চারণ অযোগ্য গালি বানান করে লিখতেও আপনি কুণ্ঠিত হন না। আপনি নিজেকে মনে করেন, মূলধারার প্রতিনিধি। আপনার  মতের সঙ্গে বা আপনার বোধের সঙ্গে গেল না, সুতরাং তা আর কিছু হতে পারে না। আপনি তেড়ে আসবেন।

অস্বস্তির কিছু নেই, এ রকম আপনি একা নন। আপনার মতো আরও মানুষ আছে। তাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি ছোট সমাজ। আসলেই ছোট। সমগ্র বাংলাদেশের তুলনায় খুব ছোট, খুব ক্ষুদ্র এই সমাজ। তাদের পেছনে পড়ে আছে আরেক বাংলাদেশ। এই যে পরস্পর বিরোধী সমাজব্যবস্থা, এটা এই ছোট্ট ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলেই তৈরি হয়েছে। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। যে দেশের প্রায় সব মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, মাত্র নয় মাসে স্বাধীন করেছে একটি গোটা দেশ, সেই দেশে এই বিভক্তি আসার কথা ছিল না। আর ছিল না বলেই পরিকল্পিতভাবে বিভক্তি তৈরি করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমাদের কোনও সুদূরপ্রসারী সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা ছিল না। আমাদের রাজনীতিতে কোনও আদর্শ নেই। এখন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষা জীবনমুখী হতে পারেনি। মুখস্ত বিদ্যা প্রসারের আমাদের শিক্ষা শ্রেণি বৈষম্য তৈরিতে ভূমিকা রেখে গেছে। একই দেশে, আর্থিক সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে নানা রকম শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে। দীর্ঘ যুগের সামরিক স্বৈরশাসন আমাদের মানুষেদের দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো যতটা ব্যস্ত থেকেছে নিজেদের আখের গোছাতে, ততটা ভূমিকা রাখেনি সমাজ গঠনের প্রচেষ্টায়। সবার চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা সব কিছু খুব স্বল্প মেয়াদের। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা, দীর্ঘ মেয়াদি টিকে থাকার জন্য কেউ ভাবে না। এ কারণে এদেশে প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায় না।

সমাজের বা রাষ্ট্রের একটা বাতিঘর থাকা লাগে। আজ এই ৪৭ বছর পরও বাংলাদেশ নামের দেশটায় কোনও বাতিঘর খুঁজে পাওয়া যায় না। যারা মানুষকে দিক নির্দেশনা দেবে। সুন্দর, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য। যে বাতিঘরের আলো ছুঁয়ে যাবে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকে। আমাদের একমাত্র বাতিঘর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র এবং আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। সুযোগ পেলে আপনারা সায়ীদ স্যারকে নিয়েও দুয়েক লাইন কটু কথা বলতে ছাড়েন না। কিন্তু নিজেরা আর একটা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র বানিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন না। একসময় এদেশে ‘বেগম’ নামে পত্রিকা ছিল। এক জেনারেশনের অক্ষর-জ্ঞানসম্পন্ন নারীদের প্রায় সবাই ‘বেগম’ পড়তো। ‘বেগম’ থেকে শিখতো। এদেশেই স্বাধীনতার পর পরই আসে ‘বিচিত্রা’। মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক চিন্তাধারা থেকে অন্দরমহল, খাবার থেকে পোশাক সবকিছুতেই একটা রুচিসম্পন্ন দিক নির্দেশক ছিল সেই সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’। সেই ‘বিচিত্রা’কে মেরে ফেলা হয় আখের লাভের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়।

অথচ হাজারো সমালোচনার পরও পশ্চিমবঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকা একটা পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে আছে। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের যে ক্ষীণ ধারা, সেটা টিকিয়ে রেখেছে আনন্দবাজার। এরপর অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, অনেক বেশি বাজেট নিয়ে মাঠে নেমেছে। কিন্তু কেউ দাঁড়াতে পারেনি। এটাও কিন্তু নিজেদেরই দুর্বলতা। নিজের দুর্বলতা ঢাকতে অন্যকে গালি দিয়ে লাভ নেই। যেমন গালি দিয়ে লাভ নেই, কাসেম বিন আবুবাকার বা তার মতো লেখকদের। বরং তাদের ছাড়িয়ে যে বা যারা যেতে পারল না, এটা তাদের দুর্বলতা।

কাসেমরা গ্রামের মানুষ, লিখেছেন গ্রামের মানুষের জন্যই। মার্কেটিংও করেছেন গ্রামকে মাথায় রেখেই। এই যে প্রায় ৫০ বছর হতে চললো স্বাধীনতা প্রাপ্তির, আমাদের দেশে প্রতিবছর বইমেলাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয়। সারাবছর কয়টা বই বিক্রি হয়? পণ্য হিসেবে বইয়ের কি কোনও ভ্যালু চেইন গড়ে উঠেছে? ধরুন, কারও জন্মদিন, কারও বিয়ে, ভাবলেন বই উপহার দেবেন। তো কোথায় পাবেন সেই বই? আপনাকে যেতে হবে শাহবাগ। বাসা উত্তরায়, কিন্তু আসতে হবে শাহবাগ। আপনি থাকেন, নীলফামারী কিন্তু বইয়ের দোকান শাহবাগ। পাড়ার যে বুক স্টল, সে ঢাকা হোক বা নীলফামারী, কয়টা গল্পের বই সেখানে পাওয়া যায়? আর পাওয়া গেলেও সেটা কোন লেখকের খুঁজে দেখেছেন?

বছর কয়েক আগে বন্ধুর স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে উপহার দেব বলে শাহরিয়ার কবিরের বই খুঁজছিলাম, পাড়ার বুক স্টলে। দোকানের সেলসম্যান এই লেখকের নামই শোনেনি কোনও দিন। অগত্যা রকমারিডটকমে ভরসা। এই যে অনলাইনে বই কেনার বিরাট সুযোগ, আজকাল এখানে বেস্ট সেলার হওয়াটা নাকি বিশাল প্রেস্টিজের ব্যাপার। আপনাদের নাগরিক কবি-সাহিত্যিকদের জন্য। বিক্রি হলেই হলো, কে কিনলো, কার বাসায় ঠিকানায় বই ডেলিভারি হলো, সেই কবি বা লেখকের বাসাতেই কিনা, সেটা কিন্তু আপনাদের জন্য বিবেচনার কোনও বিষয় নয়। আবার আরেকটা কথা, রকমারিতে অর্ডার দিলে ওদের এক্সিকিউটিভরা কিন্তু ফোন দিয়ে লম্বা একটা সালাম দিয়ে কথা শুরু করে। আশঙ্কা করি, একসময় এটাও একটা ইস্যু হতে পারে আপনাদের ফেসবুক গরম করতে।

আপনারা যারা অতি নগরকেন্দ্রিক, আপনারা মমতাজকেও চিনতেন না বছর পনেরো আগে। তারও শ’খানেক গানের ক্যাসেট বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর আবিষ্কৃত হয়েছিলেন, হানিফ সংকেতের ইত্যাদিতে। আপনি ফেসবুক থেকে চোখ তুলে গ্রামে যান, মিশুন মানুষের সঙ্গে। আপনিও আবিষ্কার করতে পারবেন, আরও কাসেম, আরও মমতাজ। শেষ পর্যন্ত কে কতটুকু টিকে থাকবে, সেটা সময় বলে দেবে। কিন্তু বর্তমানটাও অস্বীকার করা যাবে না। যেমন অস্বীকার করা যাবে না, আপনাদের নাগরিক বইমেলাকেন্দ্রিক কাসেম মার্কা আরও শত শত ‘সাহিত্যিকের’ দাপট। যারা লিখছে, ছাপছে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, বিক্রিও নাকি হচ্ছে। কিন্তু কী লিখছে, কেউ পড়ছে না। খুঁজতে গেলে দেখা যাবে সেই একই গভীরতাহীন চরিত্রাবলি। ঘটনার সরল বিবরণ। পাঠকের ভাবার অবকাশ নেই। চরিত্রের কোনও মনস্তত্ত্ব নেই। গ্রাম্য কাসেম আর শহুরে হাসেমদের মধ্যে কোনও তফাৎ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরেকটা কথাও মনে রাখতে হবে, আপনাদের ভেতর তো আবার সম্প্রতি পাঠকের চেয়ে লেখক বেশি। সবাই লেখে, সবাই সাহিত্যিক, সবাই কবি। তাই কে আর কার বই পড়ে!

আর শুধু বই পড়া নিয়ে এত কথা বলি কেন? আপনাদের টিভি। এত এত চ্যানেল। হাজার হাজার নাটক। ঘণ্টায় ঘণ্টায় টক শো। কারা দেখে? আপনারা কি জানেন, এদেশের গ্রামের মানুষ টিভিতে কী দেখে? বটতলার চায়ের দোকানের রঙিন টিভিতে দিন রাত কী চলে? আপনাদের কোনও নাটক না, কোনও টকশো না, ইন্ডিয়ার সিরিয়ালও না। এই সব টিভিতে সারাক্ষণ চলে বাজার কাটতি ভারতীয় বাংলা সিনেমা আর তা ফাঁকে ফাঁকে, লোকাল চ্যানেলে বানানো নানারকম হেকিমি দাওয়াখানার ‘আকর্ষণীয়’ বিজ্ঞাপন। মানুষ হা করে সেই সব গেলে। সব বয়সী মানুষ। জানি না, আপনাদের সুধীসমাজ কবে এই জিনিস আবিষ্কার করবে, আর হাপিত্যেস করবে,  আদৌ করবে কিনা। আদৌ এতে আপনাদের কিছু আসে যায় কিনা!

লেখক: উন্নয়নকর্মী

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ