X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আনন্দের দিনেও কষ্টের কথা

গোলাম মোর্তোজা
১৭ মে ২০১৭, ১২:১৯আপডেট : ১৭ মে ২০১৭, ১২:২৩

গোলাম মোর্তোজা বাংলা ট্রিবিউনের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, মানে সাফল্যের গল্প।
দেশ হিসেবে সাফল্য বা অর্জন আছে বাংলাদেশেরও। অনেকের লেখায় নিশ্চয়ই সেসব প্রসঙ্গ আসবে। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। মার্জনা করবেন, আজও বেদনার কথাই বলি।
১.
স্বাধীনতার ৫০ বছরের কাছাকাছি বাংলাদেশ। আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার গল্পে মশগুল। মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া নাকি সময়ের ব্যাপার। অথচ দেশে এমন একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে পারলাম না, যে হাসপাতালে আমলা, এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির চিকিৎসা হতে পারে। ১৬ কোটি মানুষের নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে এসব মানুষের চিকিৎসার একটি হাসপাতাল নেই। এই যে আমরা বিশ্বব্যাপী ‘উন্নয়নে’র গল্প বলছি, তার সঙ্গে বিদেশে গিয়ে চেকআপ কি মানানসই!
বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে নিশ্চয়ই অনেকের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। নিশ্চয়ই ভারত-থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর-ইংল্যান্ড-আমেরিকার ডাক্তাররা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিস্মিত হন। জটিল রোগের জন্যে হলে ঠিক আছে, সাধারণ চেকআপের জন্য সিঙ্গাপুর-ইংল্যান্ড? তাও আবার জনগণের টাকায়! লাখ লাখ মানুষ যখন অভুক্ত!!
২.
নিজেদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হয় না বলে এই খাতে নজর দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেন না কর্তাব্যক্তিরা। ফলে দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় সবসময় একটা দুর্নীতির মহোৎসব চলে, বিশেষ করে চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কেনাকাটার ক্ষেত্রে। শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি সুনির্দিষ্ট করে লেখা যাবে। সেদিকে না গিয়ে একটি চলমান দুর্নীতির নমুনা তুলে ধরছি।

ক্ষমতার চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি রোগীর সেবা দিয়ে থাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। এখানকার ডাক্তাররা দীর্ঘদিন ধরে একটি উচ্চ মানসম্পন্ন কার্ডিয়াক এমআরআই মেশিনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। কিছুদিন আগে মন্ত্রণালয় এমন একটি কার্ডিয়াক মেশিন কেনার জন্যে ১১ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। এতে তৎপর হয়ে ওঠে মেডিক্যাল সরঞ্জামাদি কেনার ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ একটি চক্র। ডাক্তাররা চান উচ্চ মানসম্পন্ন মেশিন, যার দাম ৯ থেকে ১০ কোটি টাকা। অন্যদিকে চক্রটি দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা দিয়ে নিম্নমানের একটি মেশিন কিনেই ১১ কোটি টাকা তুলে নিতে চায়।

এর আগেও ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ চক্রটি অনেক জায়গায় এমন করেছে। এক্ষেত্রে বাধ সাধেন ডাক্তাররা। বিষয়টি নজরে এলে ফেসবুকে লিখি, ‘সাপ্তাহিক’-এ রিপোর্ট করা হয়। চোখে পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের। দুদকের তৎপরতায় চক্রটি কৌশল পরিবর্তন করে। তারা দুদককে বোঝায়, এত দাম দিয়ে একটি কার্ডিয়াক এমআরআই মেশিন কেনারই দরকার নেই। ফলে কেনার প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়।

যেহেতু একটি মেশিন কিনে টাকা আত্মসাৎ করা যাবে না, ফলে ওই টাকা দিয়ে ছোট ছোট কয়েকটি মেশিন কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে চক্রটি। এই প্রক্রিয়ায় আর দুদকের তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় না। দুদক সবই জানে, তবুও চুপচাপ।

ডাক্তাররা হতাশ হয়ে বসে আছেন। তারা সবই দেখছেন-জানছেন-বুঝছেন, করতে পারছেন না কিছুই! ‘কিছুই’ করতে পারার কোনও মানুষও কোথাও নেই। যারা আছেন, তারা তো ইংল্যান্ড-সিঙ্গাপুর-আমেরিকায় চিকিৎসা নেন; দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কী হলো, দেখার সময় কোথায় তাদের, প্রয়োজনই বা কী!

৩.

১৯৮৯ সালের কথা। মালয়েশিয়া তখন উন্নত নয়। দেশটির চিকিৎসা খাতের অবস্থাও তথৈবচ। রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন মাহাথীর মোহাম্মদ। পেশায় তিনি ও তার স্ত্রী চিকিৎসক। মাহাথীর বুকে ব্যথা অনুভব করলে ধরা পড়লো হৃদযন্ত্রের সমস্যা। বাইপাস সার্জারি করতে হবে। ওই সময় মালয়েশিয়ার রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ীরা চিকিৎসার জন্যে আমেরিকা, লন্ডন বা সিঙ্গাপুর যেতেন। মাহাথীরকে লন্ডনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। জানতে পারলে বাগড়া দিলেন মাহাথির। প্রশ্ন করলেন, কেন লন্ডন? কেন মালয়েশিয়া নয়?

বলা হলো- মালয়েশিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থা অতটা উন্নত বা পরীক্ষিত নয়। তাই এ ধরনের অপারেশনের জন্যে ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। মাহাথির যুক্তি দিয়ে বললেন, ‘আমার অপারেশন তো মালয়েশিয়ান ডাক্তাররাই সবচেয়ে গুরুত্ব ও যত্ন নিয়ে করবেন। আমরা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করলে সাধারণ মালয়েশিয়ানরা তো বিদেশেই যাবে, দেশে ভরসা করবেন না। সুতরাং আমার অপারেশন মালয়েশিয়াতেই হবে।’

চিকিৎসক স্ত্রী রাজি নন, প্রশাসন রাজি নয়। মাহাথিরও অনড়। অবশেষে সবাই রাজি হলেন। তারপরও সিঙ্গাপুর থেকে যোগাযোগ করলেন লি কুয়ান ইউ। লন্ডনের পরিবর্তে সিঙ্গাপুরে অভিজ্ঞ সার্জনের অধীনে অপারেশন করানোর প্রস্তাব দিলেন। সে প্রস্তাবেও রাজি হলেন না মাহাথির।

মাহাথিরের অপারেশন মালয়েশিয়াতেই হলো, সফলভাবে হলো।

৪.

মালয়েশিয়া এখন চিকিৎসা সেবায় বিশ্বে তৃতীয়। ঢাকা শহরে কিছুদিন আগেও তাদের বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড চোখে পড়ত। বাংলাদেশ থেকে তো বটেই, ইউরোপ এমনকি অস্ট্রেলিয়া থেকেও মানুষ চিকিৎসার জন্যে মালয়েশিয়াতে যান। আর আমরা কথায় কথায় মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দিই, কাজ করি তার উল্টো। আমরা আনন্দের দিনে দুঃখের কথা বলি, আনন্দদিনের প্রত্যাশায়।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ