X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

লুৎফরের জীবন নাটক

গোলাম মোর্তোজা
২৪ মে ২০১৭, ১৫:৪৫আপডেট : ২৪ মে ২০১৭, ১৫:৫১

গোলাম মোর্তোজা রাসেল ঢাকায় আসবে, মায়ের মন খারাপ। ছেলেটা চলে যাবে। বাবার মন খারাপ, আবার ভালোও। ছেলে ঢাকায় কাজ করে, টাকা পাঠায়। সংসারের স্বাচ্ছন্দ আসে। গ্রামে যাওয়ার সময় বাবার জন্যে লুঙ্গি-শার্ট, মায়ের জন্যে শাড়ি, ছোট বোনের জন্যে জামা- খেলনা কিনে নিয়ে যায়। এবারও রাসেল বাড়িতে গিয়েছিল অল্প কয়েকদিনের জন্যে। দুপুরে মায়ের হাতে রান্না খেয়ে রাসেল রওনা দিয়েছিল। তার কর্মস্থল ঢাকার উদ্দেশ্যে।
রাসেলের বাবা একজন কৃষক। অতি সাধারণ গ্রামীণ কৃষক। সহজ-সরল শব্দ দুটি দিয়ে যতটা বোঝানো যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি সাদামাঠা মানুষ লুৎফর। সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে যেন ভয় পান, সঙ্কোচ শুধু মুখে নয়, সারা শরীর জুড়ে। আস্তে আস্তে কথা বলেন, পুরোটা বোঝা যায় না। বোঝার জন্যে বারবার শুনতে হয়। কিছু বললেও যে পুরোটা বোঝেন, তা নয়।
আপনি কি কথা বোঝেন না?
‘শহরের শিক্ষিত মানুষের সব কথা তো বুঝি না’- লুৎফর সঙ্কোচের সঙ্গে উত্তর দেন। কথাগুলো বলেন, তিনি তার আঞ্চলিক ভাষায়। ‘আমরা তো আর লেখাপড়া জানি না...’ বাক্য শেষ করেন না লুৎফর। মুখের দিকে নয়, মাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেন বড় কোনও অপরাধ করে ফেলেছেন।
কৃষক লুৎফর যেমন সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারেন না, সব কথা বুঝতেও পারেন না। একটা বললে, আরেকটা বা আংশিক বোঝেন। লুৎফরের স্ত্রী, রাসেলের মা একজন অতি সাধারণ কৃষাণী। বাংলাদেশের যে গ্রামীণ দরিদ্র কৃষি সমাজ, তারই প্রতিনিধি লুৎফর দম্পতি। তিন সন্তান। রাসেল মেজ, বয়স ১৭ বছর। ৪ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে।
রাসেল ঢাকায় এসির কাজ করে। আগের দিন বিকেলে রাসেল বাড়ি থেকে ঢাকায় আসে। পরের দিন সকালে লুৎফরকে ফোনে জানানো হয়, ‘রাসেল মারা গেছে’। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন লুৎফর। জানানো হয়, ‘এসির কাজ করছিল। তিনতলা থেকে পড়ে রাসেল মারা গেছে।’
কে ফোন করে জানাল, লুৎফর তার নাম জানেন না। শুধু ফোন নম্বরটি জানেন।
আগের দিন যে রাসেল মায়ের হাতের রান্না খেয়ে ঢাকায় গিয়েছিল, পরের দিন হিমশীতল অ্যাম্বুলেন্সে বাড়িতে ফিরল।
ছেলে হারানো কৃষাণী মায়ের কথা, ‘রাসেলকে বললাম বাবা আরেকটা দিন থাক।’
‘মা তুমি কি আমাকে বৈশাখে বাড়িতে আসতে না করো’- মুখ কালো করে বলল রাসেল।
‘না বাবা তা বলব কেন’ রাসেলের মাথায় হাত রেখে বলেন মা।
‘আজ না গেলে বৈশাখে মালিক ছুটি দেবে না’- মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে রাসেল।
‘ঠিক আছে বাবা, তাইলে আজই যা। বৈশাখে আসিস’- রাসেলকে আদর করে বিদায় দেন মা।
‘সেই যাওয়াই যে শেষ যাওয়া হবে... তখন কি আর বুঝছি...।’
মনে আছে, রাসেল বাড়িতে এসেছিল কত তারিখে?
কৃষক-কৃষাণী মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমরা তো ইংলিশ মাস জানি না। বৈশাখের ৯ দিন আগে বাড়িতে আসছিল। একদিন থেকে ৭ দিন আগে ফিরে যায়। ৬ দিন আগে আবার ফিরে আসে...।’
আঞ্চলিক ভাষায়, যে আর্তনাদ-অভিব্যক্তির সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন, সেখানে যে পরিবেশ তখন তৈরি হলো, তা আসলে শব্দ-বাক্য দিয়ে বোঝানো অসম্ভব। সামনে থেকে কিছুটা অনুভব করা যায়, সহ্য করা যায় না, লেখা তো যায়ই না।
২.
যে শিক্ষিত মানুষদের সামনে দাঁড়িয়ে কৃষক লুৎফর কথা বলতে পারেন না, যে শিক্ষিত মানুষের কথা লুৎফর পুরোটা বোঝেন না, সেই শিক্ষিত মানুষেরা লুৎফরের সঙ্গে কী করলো, তা একটু বলার চেষ্টা করি। এতক্ষণ যা বলেছি তা লুৎফর দম্পতির জীবন। এবার আসি সেই জীবনের নাটকে।
লুৎফর শুধু জানে রাসেল ঢাকার বনশ্রী এলাকায় কাজ করতো। মালিকের বা প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিকানা কিছুই জানেন না। রাসেলের লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লুৎফরের বোনের জামাই সিএনজি চালককে ডেকে নেয় ‘মালিক’। লাশ তার কাছে দিয়ে দেয়। অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠাতে বলে, তিনি পাঠান। রাসেলের লাশ এসে যখন বাড়িতে পৌঁছায় তখন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। সেই দৃশ্যকে ছাপিয়ে যায় ‘অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া’। লাশ নিয়ে যাওয়ার ভাড়া ১১ হাজার টাকা। একদিকে ছেলের লাশ, আরেক দিকে ১১ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। কোথায় পাবেন এত টাকা। ‘টাকা দিতে পারবে না’- এ কথা বলার সাহস হয় না। শহরের শিক্ষিত ‘মালিক’ ফোনে বলে দিয়েছে, ১১ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে দিতে। ছেলের লাশ রেখে, কয়েকজনের থেকে ধার করে ১১ হাজার টাকা ভাড়া মেটায় লুৎফর।
‘মালিক’কে ফোন করে বললেন না কেন টাকার কথা?
‘যখন দেয় নাই, তখন আর বলি কেমনে। তাছাড়া তখন তো মনের অবস্থাও ভালো না। পাগল হওয়া বাকি... রাসেল তো ‘মালিক’র কাছে টাকাও পেত।’
কত টাকা পেত?
‘৭ হাজার টাকা মালিক জমা রাখছিল সিকিউরিটির জন্যে। বেতনেরও ১৭/১৮ হাজার টাকা পাওনা ছিল। মোট ২০/২৫ হাজার টাকা পাওনা ছিল রাসেলের।’
তো এই টাকা আপনি চাননি?
‘কিভাবে চাইব, প্রথম দিকে ‘মালিক’ ফোন করে ঢাকায় যেতে বলত।’
তো যান নাই কেন?
‘ছেলে যখন মারা গেলো, তখন তো মনে করছি সত্যি তিনতলা থেকে পড়েই মরছে। যারা গোসল করালো তারা বলল শরীরের কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই...। মরলো না কিছু করলো...।’
ময়না তদন্ত হয়নি?
‘কাটাছেঁড়ার কথা বলছেন’- প্রশ্ন করেন লুৎফর।
হ্যাঁ।
‘না, তখন তো মনে হয় নাই। তাছাড়া ছেলেই চলে গেলো... কাটাছেঁড়া করে আর কষ্ট দিয়ে কী লাভ... তাছাড়া তখন তো মাথা ঠিক নাই... কিছু বুঝিও নাই...।’
ফোন করে ‘মালিক’ ঢাকায় কেন যেতে বলত?
‘বলত ঢাকায় আসো, কিছু টাকা পয়সা নিয়ে যাও। কিছু যদি করে ভয়ে যাই নাই। তাছাড়া দারোগা ফোন করে বলত, মালিকের কাছে যাবা না। আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করবো। টাকা আমি উদ্ধার করে দেব।’
কোন দারোগা?
‘নাম তো জানি না। গুলশান থানার দারোগা। সে বলত, ‘মালিক’র কাছে যাবা না, আমি দেখতেছি। ‘মালিক’ ফোন করে বলতো, দারোগার কাছে যাবা না। ঢাকায় আসো, টাকা নিয়ে যাও। একটা মীমাংসা করি, পুলিশ আমাদের ঝামেলা করছে।’

৩.
বৈশাখ মানে পহেলা বৈশাখ ধরে হিসেব করলে রাসেল বাড়িতে গিয়েছিল এপ্রিলের ৫ তারিখে। ৬ তারিখ বাড়িতে থেকে, ৭ তারিখে ঢাকায় আসে। ৮ এপ্রিল রাসেলের লাশ বাড়িতে যায়।
লুৎফরের সঙ্গে আমার প্রথম কথা হয় মে মাসের প্রথমদিকে, ঘটনার প্রায় মাসখানেক পরে।
প্রশ্ন করি, এখন আপনি কি করতে চান?
‘কী চাইব, আমাদের কি আর ক্ষমতা আছে। ‘মালিক’ যদি কিছু টাকা পয়সা দিত।’
‘মালিক’ তো টাকা দিতে চেয়েছে। ঢাকায় গিয়ে নিয়ে আসেন। ঢাকায় যাচ্ছেন না কেন?
‘ভয় লাগে, যদি আটকায়া রাখে, যদি কিছু করে।’
তো, এখন কী করবেন?
‘আপনি যদি একটু বলে দিতেন।’
লুৎফরের ধারণা ‘মালিক’কে ফোন করে বলে দিলে, তাকে কিছু টাকা দিবে বা ঢাকায় এলে কিছু করবে না। লাশের ময়না তদন্ত হয়নি, থানায় কোনও মামলা হয়নি। আইনগতভাবে কাউকে কিছু বলা বা করার সুযোগ নেই। লুৎফরের থেকে ফোন নম্বর নিয়ে ফোন করলাম। লুৎফর যাকে ‘মালিক’ বলে জানে, সে আসলে কর্মচারী। যদিও ফোনের কথায় তাকে মাস্তান ছাড়া আর কিছু মনে হলো না। ‘ওরে আসতে কইছি আসে নাই। অহন আবার কিসের টাকা। পুলিশরে টাকা দিতে দিতে মালিকের অবস্থা খারাপ।’
আপনার কাজ করতো রাসেল?
‘না, মলিক না। আমি চাকরি করি।’
নাম কী আপনার?
‘নাম দিয়ে কী করবেন। কোনও টাকা পয়সা আর দেওয়া যাবে না। সব পুলিশরে দিয়ে ম্যানেজ করা হইছে।’
নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, মাস্তান কিছু বুঝলো বলে মনে হলো না।
মাস্তানের 017180... ফোন নম্বরটি রেজিস্ট্রেশন করা 'Boro' নামে। যে দারোগা ফোন করতেন তার ফোন নম্বর পাওয়া গেলো। তারও নাম জানেন না লুৎফর। জানা গেলো দারোগার নাম এসআই নাজমুল। তিনি গুলশান থানায় কর্মরত। যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছিল, তা গুলশান থানার মধ্যে। ময়না তদন্ত, মামলা কোনও কিছু না হলেও এসআই নাজমুলের নজরদারিতে ছিল শুরু থেকেই।
মামলা বা কবর থেকে লাশ তুলে ময়না তদন্ত কিছুই করতে চান না লুৎফর। শুধু কিছু টাকা পেতে চান। সহায়তা চান এক্ষেত্রে। বিনীত আর্তি, ‘যদি কিছু করেন’।
চিন্তা করি, রিপোর্টের ভালো বিষয়। কিন্তু তাতে লুৎফরের লাভ কী?
সেনাবাহিনীতে কর্মরত বন্ধুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম। পুরো ঘটনা শুনে আমার চেয়ে বেশি ব্যথিত হলো। সে তার জুনিয়র র‌্যাবের একজন সিও’র সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললো। র‌্যাবের সিও আইনগতভাবে সরাসরি কিছু করতে পারেন না। তারপরও ঘটনা শুনে লুৎফরকে তার কার্যালয়ে যেতে বললেন। লুৎফর গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে সহজ ঠিকানা অনেক ঘুরে দেখা করলেন র‌্যাবের সিও’র সঙ্গে। র‌্যাবের সিও তাকে ঠাণ্ডা ঘরে বসতে দিয়েছেন, ভালো খাইয়েছেন। এতে তার বিস্ময় কাটছে না। এটা তার সারা জীবনের গল্প হয়ে থাকবে।
র‌্যাবের সিও লুৎফরের সামনেই এসআই নাজমুলকে ফোন করে বলেছেন, আমার পরিচিত। উনার ছেলেটা যেভাবেই হোক মারা গেছে। কিছু পাওনা আছে। গরিব মানুষ। দেখেন যেখানে কাজ করত তাদের থেকে কিছু টাকা নিয়ে দিতে পারেন কিনা।
এস আই নাজমুল বলেছেন, ‘জি স্যার আমি দেখব’।
এসআই নাজমুল ছুটিতে ছিলেন। দু’দিন পর সন্ধ্যায় লুৎফরকে থানায় যেতে বলেন। ‘মালিক’কেও আসতে বললেন। এক সঙ্গে বসে একটা মীমাংসা করে দেবেন। র‌্যাবের সিওকে বলেন নাজমুল।
দু’দিন পর গ্রাম থেকে এসে সন্ধ্যায় গুলশান থানায় এসআই নাজমুলের কাছে যায় লুৎফর। সেখানে মালিক পক্ষের আরও দু’জন আসে। 01711...নাম্বারের একজনের নাম এসও মহিউদ্দিন। তারা লুৎফরকে ধমকায়। ২০ হাজার টাকা দিয়ে মীমাংসা করতে বলে। লুৎফর রাজি হয় না। ২ লাখ টাকা চায়। এসআই নাজমুল এবং অন্য দু’জন ক্ষেপে যায়। অবশেষে লুৎফরকে ৫০ হাজার টাকা দিতে চায়। তাতেও রাজি হয় না লুৎফর, থানা থেকে চলে আসে।
থানা থেকে বের হয়ে আমাকে ফোনে পুরো ঘটনা জানায় লুৎফর। জানায় র‌্যাবের সিও’কেও। রাতে গ্রামে ফিরে না গিয়ে, টঙ্গিতে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকে। সকালে ফোনে জানায়, ‘গ্রামে চলে যাবো।’
আমি বলি, ঠিক আছে যান। আবার দরকার হলে আসবেন। লুৎফরকে আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল, কেউ ফোন করে কোথাও যেতে বললে না জানিয়ে যাবেন না। সে কথা আবার মনে করিয়ে দিলাম।
একজন এসআই, একজন র‌্যাবের সিও’র কথায় গুরুত্ব দিলেন না। আইনগত দিক দিয়ে তা তিনি না দিতেই পারেন। খুব মন খারাপ হলো। ছেলে হারানো লুৎফরের জন্যে কিছুই করা গেলো না! একজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললাম। তিনি সরাসরি কিছু না করে, পরামর্শ দিলেন।
পুরো বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম বড় ভাই সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টুর সঙ্গে। যথারীতি পিন্টু ভাইও ব্যথিত হলেন। তিনি পুরো বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন তার পরিচিত পুলিশের একজন যুগ্ম কমিশনারের সঙ্গে। যুগ্ম কমিশনার পিন্টু ভাইকে ফোনে রেখেই আরেক ফোনে এসআই নাজমুলকে বললেন, লুৎফরের বিষয়টি দেখার জন্যে। বললেন, দেখো লুৎফর একজন গরিব মানুষ। মালিকদের ডেকে দেখো লুৎফরের জন্যে কী করা যায়। ওর ছেলের পাওনাও আছে।
পিন্টু ভাই জানালেন বিষয়টি। বেশ আশাবাদী হলাম। প্রত্যাশা করছিলাম, লুৎফর হয়তো ফোন করে জানাবেন। বলবেন ‘কাজ হয়েছে, টাকা পেয়েছি।’
কিন্তু পরের দু’দিন লুৎফরের আর কোনও খবর নেই। ফোন করতে গিয়ে দেখি, লুৎফরের ফোন বন্ধ। একজনকে ফোন করে লুৎফরের বাড়িতে যেতে বললাম। কথা হলো লুৎফরের স্ত্রীর সঙ্গে। লুৎফর মাঠে গেছেন। ঘণ্টা দুয়েক পরে লুৎফর ফোন করলেন।
ভয়ের সঙ্গে কান্না, লুৎফর যা বললেন-
লুৎফর সেদিন থানায় গিয়েছিল স্ত্রীসহ। যেদিন আমাকে বলেছিল, বাড়িতে যাব, সেদিন যাননি। স্ত্রীকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ঢাকায় থেকে যান। পরের দিন যখন বাড়িতে আসবেন, তখন একটি ফোন আসে। লুৎফরকে বলে, আপনার ছেলে রাসেলের কিছু কাপড়-পোশাক আছে আমাদের কাছে। মগবাজারে এসে পোশাকগুলো নিয়ে যান। যুগ্ম কমিশনার এসআই নাজমুলকে বলার দুই আড়াই ঘণ্টা পরে এই ফোন আসে।
ছেলের পোশাক- আবেগতাড়িত হয়ে কিছু না জানিয়ে ছুটে যান মগবাজার। গলির ভেতর দিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে চায় লুৎফরকে। সরল লুৎফরও বুঝতে পারেন বিপদে পড়েছেন। রাজি হয় না গলির ভেতরে যেতে। তারপর ছোট একটি হোটেলে নিয়ে যায়। সাদা স্ট্যাম্পে সই নেয়, পিস্তল দেখিয়ে। ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বলে, সোজা গাবতলী হয়ে গ্রামে চলে যাবি। না হলে, বিপদ আছে। দশ পনেরোজন মাস্তান ধরনের ছেলে, পিস্তল... আতঙ্কিত লুৎফর গ্রামে ফিরে আসে। লুৎফরের ধারণা বাসে উঠতে গিয়ে ফোন হারিয়ে গেছে। আমার ধারণা, ফোন বাসে উঠতে গিয়ে হারায়নি। মাস্তানরা রেখে দিয়েছে। মাস্তানরা জানত, ফোন না থাকলে লুৎফর কাউকে ফোন করে ঘটনা জানাতে পারবে না।
৪.
লুৎফরের জীবন নাটকের উপসংহারটা কী দাঁড়াল!
একজন সাধারণ কৃষক লুৎফর পুলিশের একজন যুগ্ম কমিশনারের কাছে গেলেন, এসআই নাজমুল তা পছন্দ করলেন না। র‌্যাবের সিও’র কাছে যাওয়াও এসআই পছন্দ করেননি। সিও’র কথা গুরুত্ব দেননি। যুগ্ম কমিশনারের কাছে যাওয়ায় প্রতিশোধ নিলেন। এসআই নাজমুল ‘মালিক’ পক্ষকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটিয়ে প্রমাণ দেখালেন যে, তার ক্ষমতা কতটা। এসআই খুব ভালো করে বুঝেছেন যে, লুৎফরকে কেউ সহায়তা করছে। এসআই তার ক্ষমতা দেখালেন লুৎফরকে নয়, সেই সহায়তাকারীদের।
লুৎফর পরে ফোন করে এসআইকে বিষয়টি বলেছেন। চুপচাপ শুনে এসআই নাজমুল বলেন, ‘ঠিক আছে। চিন্তা করো না। আমি বিষয়টি দেখব।’
দু’দিন পর লুৎফর আবার ফোন করেন এসআইকে। এবার এসআই নাজমুল বলেন, ‘এখন আমি আর কী করব...। যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে...।’
এত ঘটনার কিছুই জানতেন না র‌্যাবের সেই সিও। নিজের উদ্যোগে তিনি কথা বলেন, গুলশান থানার বড় কর্তার সঙ্গে। বড় কর্তাকে বিষয়টির মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে লুৎফরের জন্যে কিছু করতে বলেন। তিনি সিও’কে বলেন, ‘দেখেন স্যার মৃত রাসেলের বাবা লুৎফর লাশের ময়না তদন্ত করতে রাজি হননি। মামলাও হয়নি। এক্ষেত্রে আইনগতভাবে আর কিছু করার নেই। তাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছে, সেটাই নিয়ে নেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশের মানুষ, সাধারণ মানুষ, গ্রামের মানুষ কতটা অসহায়, নিরূপায়। এই একটি ঘটনা দিয়ে তা পরিষ্কার করে বুঝতে কোনও সমস্যা হয় না।
পাদটীকা: সেই 'মালিক'কে খুঁজে বের করা যায়। রিপোর্ট হতে পারে পত্রিকায়, টেলিভিশনে। যুগ্ন কমিশনারের কাছে বা তারও ওপরের আরও কারও কাছে যাওয়া যেতে পারে। মামলা করতে হবে লুৎফরকে। ময়না তদন্তের জন্যে লাশ কবর থেকে তোলা হবে। এই চক্র কী সঠিক ময়না তদন্ত হতে দেবে! সব কিছুর জন্যে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে লুৎফরকে। সেই সামর্থ, সময় কোনোটাই নেই লুৎফরের। লুৎফরের জন্যে কিছু করবো, এক নাগাড়ে লেগে থাকার সেই সময় তো আমাদেরও নেই।
সুতরাং এই রাষ্ট্রে বিজয়ী সব সময় এসআই নাজমুল আর 'মালিক'রাই। এরাই লুৎফরদের জীবন নাটকের নাট্যকার। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই মঞ্চে নাট্যকাররা লুৎফরদের জীবন নাটকের নির্দেশক। পরাজয়টা লুৎফরদের নিয়তি, আমাদেরও।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ