X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফেসবুকে সবকিছু জানাতে হবে কেন?

শান্তনু চৌধুরী
০২ জুলাই ২০১৭, ১৬:১৫আপডেট : ০২ জুলাই ২০১৭, ১৬:২১

শান্তনু চৌধুরী ঈদের আনন্দ নগরজীবনের চেয়ে গ্রামীণ জনপদে যেন বেশিই। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া প্রায় ৬০ লাখ মানুষই সেকথা বলে দেয়। সন্তানের অপেক্ষায় থাকেন বাবা-মা, স্বামীর অপেক্ষায় স্ত্রী। ভাইয়ের অপেক্ষায় বোন। সেই অপেক্ষার আনন্দ যে প্রিয়জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সেটা ঈদের আগে আগে ট্রেন, বাস বা লঞ্চে করে যাওয়ার মুখের সারি অনায়াসে বলে দেয়। এখন প্রযুক্তির যুগ, প্রযুক্তির কল্যাণে যে কোনও খবর ছড়াতে খুব বেশি সময় নেয় না। এর মধ্যে ফেসবুকতো আরো একধাপ এগিয়ে। সত্যের পাশাপাশি মিথ্যার মিশেলও। প্রতিটি মোবাইল অপারেটর থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোও ফেসবুকের জন্য আলাদা আলাদা অফার চালু রেখেছে। আবার ফেসবুকও প্রতিনিয়ত তাদের মান ও নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকছে।
আমাদের দেশ ইন্টারনেট সেবায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি আমরা বাইরেও আমাদের ব্যান্ডউইথ বিক্রি করছি। একই সঙ্গে নিম্নমানের মোবাইল ফোনে ছেয়ে গেছে আমাদের দেশ। এর ফলে অনেক কম দামি মোবাইলেও এখন কথা বলো, মেসেজ পাঠাও, ইন্টারনেট, বাতি জ্বালাও, ভিডিও অডিও রেকর্ড, চার্জ লাইট হিসেবে ব্যবহার, বা কোনও কোনও মোবাইল শুধু সেলফি বিশেষজ্ঞ। বিশেষ করে উৎসবগুলোতে এর ব্যবহার আরো বেড়ে যায়। বাড়ির বা বিশেষ কোনও জায়গায় যাত্রা থেকে শুরু উৎসবের প্রতিটি ক্ষণ যেন শেয়ার করা চাই সবার সঙ্গে। অনেকে রোজ ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমানো যাওয়া অব্দি শেয়ার করতে চান। শুধু ওয়াশরুমে থাকার সময়টা ছাড়া! কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, হনুমানের হাতে আগুন দিলে কী হয় সেটা মাত্রই লঙ্কাবাসী জানে। বাবা-চাচা বিদেশে থাকার কারণে এসব দামি দামি বা অল্প দামি কিন্তু কাজ অনেক এমন মোবাইল গিয়ে পড়েছে সমাজের হনুমান টাইপের কিছু মানুষের কাছে। এতে করে প্রতিদিন কোনও না কোনও দুর্ঘটনার খবর আমরা পাচ্ছি যা আপলোড হচ্ছে ফেসবুকে এবং ঘটছে নৈতিক অবক্ষয়। সাম্প্রতিক এমন ঘটনা যেন বেশি ঘটছে। বিশেষ করে প্রেমের অভিনয় বা প্রেম করে, গোপনে মেয়েদের ভিডিও ধারণ করে বা প্রকাশ্যে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে অহরহ। তার কিছুটা হয়তো গণমাধ্যম জানতে পারছে। জীবন পাতার অনেক খবরের মতো কিছু রয়ে যাচ্ছে অগোচরে। এর ফলে কোথাও কোথাও সামাজিক লজ্জায় মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে এমন সংবাদও এসেছে গণমাধ্যমে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, মোবাইল ফোনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার একই সঙ্গে ফেসবুকের ব্যবহারবিধি সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় অনেক সময় বিপদ ডেকে আনছে।

বছরখানেক আগে ঢাকা কর্মাস কলেজের এক ছাত্র ও এক ছাত্রীকে বহিস্কার এবং আরো নয়জনকে টিসি দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র প্রেম নিবেদনের কারণে। তারা প্রেম নিবেদনের দৃশ্য ভিডিও করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে মহৎ হতে চেয়েছেন। ওরা যে বয়সে প্রেম নিবেদন করছে সেটার পরিণতি যদি ভালো না হয় বা সেটা যদি বিকৃত রূপ নেয় সেটার দায়ভার কে নেবে? কারণ আমাদের সমাজ এখনও বিষয়গুলো মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা তৈরি করতে পারেনি। তাই আগে দরকার আমাদের মানসিকতা উন্নত করা। আবার প্রেম করে ছবি তুলে রাখা, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া এসবের মধ্যে যে সবসময় ভালো উদ্দেশ্য থাকে তাওতো নয়। এক সাংবাদিক সম্প্রতি একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন, যেটার মাধ্যমেই বোঝাতে পারি ফেসবুকে ছবি আপলোড করার সময় কেন সতর্ক থাকা উচিত। তিনি তার কিশোরী কন্যার ছবি আপলোড করেছিলেন কোনও একটা অনুষ্ঠানের। কিন্তু পরে তিনি সেই ছবি দেখতে পান ‘বাজে কথা সম্বলিত’ কোনও একটা পর্নো ওয়েবসাইটে। বিষয়টি তাকে আহত করে। যদিও তার মনোবল অটুট এবং নিজেকে বা মেয়েকে জানেন বলেই সেটা নিয়ে তেমন হা-হুতাশ করেননি। কিন্তু বিষয়টাতো ঘটলো। অনেক সময় প্রিয়জন বা প্রতিষ্ঠানের ওপর রাগ, ক্ষোভ বা অভিমান আমরা প্রকাশ করে থাকি ফেসবুকের মাধ্যমে। সেটার আঙ্গিক যদি শৈল্পিক হয় তবে তেমন অসুবিধা হয় না। কিন্তু অনেক সময় নিজের পরিবারের অন্দরমহলের ঘটনা অন্যকে জানানোটা দৃষ্টিকটুই বটে! আবার এমনও ঘটেছে, যেহেতু সবকিছু ফেসবুকে জানানোয় আমরা অব্যস্ত হয়ে যাচ্ছি, সে কারণে ব্যর্থতার ফাঁস গলে ঢুকে পড়ছে প্রতিহিংসা পরায়ণ, কপট কেউ। মডেল সাবিরা ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এবং এর জন্য তার প্রেমিক আলোকচিত্রী নির্ঝর সিনহাকে দায়ী করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ইঙ্গিত করেছেন, শারীরিক সম্পর্কে নির্ঝর যতোটা আগ্রহী ছিল বিয়েতে ততোটা নয়। প্রেম মহৎ সম্পর্ক। সেখানে ভালোবাসার সব রকমের প্রয়োগ হবে, কিন্তু কতোটা বিষন্ন হলে, কতোটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলে বা কতোটা কষ্ট পেলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে, ভিডিও আপলোড করে একটা মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিতে পারেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু যারা তাকে সেই আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছে তারাও এক শ্রেণির বখাটে। রেইনট্রির ঘটনার কথা যদি বলি ওই বখাটেরাও দুই নারীকে হুমকি দিয়েছিলেন ইন্টারনেটে ছবি ছড়িয়ে দেবেন বলে এবং বডিগার্ডকে দিয়ে ভিডিও করিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রসরাজের কাহিনীতো সবার জানা। তার ফেসবুক আইডির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়ানো হয়েছিল ষড়যন্ত্রমূলকভাবে। অনুরূপ রামুর ঘটনাতো সারাবিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। প্রযুক্তি বিষয়ক সাইটগুলো ফেসবুক বিষয়ে নানা সতর্কতা দিয়ে থাকেন। আমাদের অনেকে এসব সতর্কতা সম্পর্কে ঠিক ওয়াকিবহাল নন। সে কারণে যথেচ্ছ ব্যবহার দেখা যায়। যেসব তথ্য ফেসবুকে দিতে না করা হয় তার মধ্যে রয়েছে, ফোন নম্বর। এটি বাড়তি ঝামেলা ঢেকে আনতে পারে। নিজের বাসার ঠিকানা। অফিসের বিষয়ের কথা আগেই বলেছি। সম্পর্কের বিষয়ে ফেসবুকে খোলামেলা না হওয়াই ভালো। নিজের পরিবার সম্পর্কে ফেসবুকে বেশি তথ্য না জানানোটাই ভালো। লাইক বেশি পাওয়ার আশায় অনেকে এটি করে থাকেন। কিন্তু পরিবার শুধুমাত্র সামাজিক জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফেসবুকের হাজার হাজার বন্ধু কোনও মতেই নিজের সামাজিক বন্ধনের অংশ নয়। যদি নিরাপদ বোধ না করেন তবে নিজের দৈনন্দিন কাজ বা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা আগেভাগেই না জানানো ভালো। শত্রুরতো অভাব নেই। কে কোথায় ওৎ পেতে থাকে। নিজের শিশুর ছবিও ফেসবুকে না দেওয়া ভালো। এতেও বিপদের ঝুঁকি থাকে। এমন অনেক খারাপ দিক রয়েছে বলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক ব্যবহারে সতর্কতা জরুরি।

আবার ফেসবুক যে অনেক আন্দোলনের সুতিকাঁগার সেটাও অস্বীকার করা যায় না। কতো কতো ঘটনা যে শুধু ফেসবুক ব্যাবহারকারীদের সোচ্চার থাকার কারণে সামাজিক সমস্যা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সমস্যা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। অনেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেসবুক ব্যবহার করেই এলাকার বিভিন্ন বিষয়ের সমাধান দেন এমন সংবাদও এসেছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের আগনুকালী গ্রামের মামুন বিশ্বাসতো রীতিমতো ফেসবুক বিপ্লব করে ফেলেছেন। হাজার হাজার মানুষকে তিনি সহযোগিতা করেছেন ফেসবুকের মাধ্যমে বিপদের খবর পেয়ে। ফেসবুকের মাধ্যমে খবর পেয়ে পাপুয়ার পাহাড় থেকে এভারেস্টজয়ী মূসা ইব্রাহীমকে উদ্ধারে সচেষ্ট হন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। ফেসবুকের ফলে সম্ভব হয়েছে এমন অনেক ভালো কাজের উদাহরণও কম নয়। তাই জরুরি সতর্কতা। কোন বিষয় সবাইকে জানানো উচিত কোন বিষয় জানানো উচিত হবে না সেটার সিদ্ধন্ত নিতে হবে নিজেকেই। তবেই সম্ভব রুখে দেয়া সামাজিক অনেক অনাচার, বৈষম্য বা সহিংসতা। 

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ