X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার রাস্তায় নেই আস্থা

শান্তনু চৌধুরী
২১ জুলাই ২০১৭, ১৩:৫৯আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৭, ১৪:০৫

শান্তনু চৌধুরী বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বাস অযোগ্য শহরের তালিকায় বারবার ওঠে এসেছে রাজধানী ঢাকার নাম। বিশেষ করে শহর এলাকার পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ। আর বর্তমান অবস্থা, একমাত্র ভুগছে, শুধু তারাই সেটি কল্পনা করতে পারবেন। পুরো ঢাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা জটিল ও ব্যাপকতার বিষয়। কিন্তু সম্প্রতি যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তা ঢাকার রাস্তা। সহজ কথায় বলতে গেলে অল্প বৃষ্টিতে জলজট আর এর কারণে সৃষ্ট যানজট। নাকাল নগরবাসী। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস ওঠে। ঘরে থাকা দায়, বাইরেও বের হওয়া যায় না। কয়েক সপ্তাহের মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে যে বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে, মাত্র কয়েক মিলিমিটার বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড, চকবাজার রোড (কারা অধিদফতরের সামনের অংশ), সিদ্দিকবাজার, নাজিরাবাজার, কাজী আলাউদ্দিন রোডসহ বেশ কয়েকটি সড়ক। জলজট সৃষ্টি হয় মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর, রাজারবাগসহ বিভিন্ন এলাকার প্রধান সড়কের পাশাপাশি গলিপথও। এমন অবস্থাও দেখা গেছে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার কয়েকঘণ্টা পর্যন্ত দিলকুশা, আরামবাগ, ফকিরাপুল ও নয়াপল্টনের প্রধান সড়কে ছিল হাঁটুপানি। একই অবস্থা উত্তর ধানমণ্ডি, কলাবাগান বশিরউদ্দীন রোড এবং জিগাতলারও।
উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কারওয়ান বাজার, এফডিসির সামনের সড়ক, গ্রিনরোডের কিছু অংশ, মিরপুর, কাওলা, খিলক্ষেতে জলজটের কারণে দুর্ভোগে পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। এই সময়ে জলজট হলেই সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক যানজট। অন্য সময়ের তুলনায় এখন সেটা বেড়েছে বহুগুণ। এর কারণ কী? বৃষ্টি, জলাবদ্ধতার পাশাপাশি ঢাকার প্রায় প্রতিটি রাস্তায় এখন খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। কোথাও বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়ন কাজের জন্য, কোথাও মেট্রোরেল প্রকল্পের কারণে। কিন্তু যে রাস্তাগুলো খোঁড়া হচ্ছে সেগুলো ভাঙাচোরাই থেকে যাচ্ছে। মিরপুর ১০ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পুরো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে শেষ। গাড়ি চলতে হয় এক লেইনে। রামপুরা ব্রিজ থেকে মেরাদিয়া ব্রিজ পর্যন্ত সড়কটি খানা-খন্দে ভরা, মালিবাগ রেলগেট হয়ে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত সড়কের একাংশ কাটা। এমন উদাহরণ অনেক। এছাড়া হানিফ ফ্লাইওভার, বাংলামোটর থেকে মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা দেখলে মনেই হবে না এটা রাজধানী ঢাকার রাস্তা। এসবই জলজটের পাশাপাশি যানজটের জন্য দায়ী। রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ন, অবৈধ রিকসা ও অতিরিক্ত যানবাহনের চাপও। প্রশাসনের নাকের ডগায় যেখানে সেখানে যানবাহন পার্কিং ও ফুটপাতসহ রাস্তার অনেকাংশ অবৈধ দখলে রয়েছে। এতে ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে রাজধানীর যানজট। এক প্রতিষ্ঠান রাস্তা কেটে ড্রেনেজ পাইপ লাইন স্থাপন শেষ করার কিছুদিন পর আরেক প্রতিষ্ঠান গ্যাস লাইনের জন্য একই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে। কাজ শেষে রাস্তা যখন মেরামত করা হয়, তখন বিদ্যুৎ অথবা টেলিফোন লাইন স্থাপনের নামে ওই রাস্তা খুঁড়তে আসে আরেক প্রতিষ্ঠান। সমন্বয় না থাকায় পরিকল্পিতভাবে কিছুই করা হয় না। এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হয় নগরবাসীকে।

হুট করে সমাধান হয়তো হবে না। এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। রাজধানী জলজট ও যানজটমুক্ত করতে শুধু স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই চলবে না। পাশাপাশি প্রয়োজন মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিশটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৫৬টি প্রতিষ্ঠান রাজধানীতে সেবা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে দৃশ্যমান সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপদ, ওয়াসা, রাজউক ও জেলা প্রশাসন। মুশকিল হলো সংস্থা জনগণের ‘উন্নয়নে’ কাজ করে, কিন্তু জনগণ সুফল ভোগ করতে পারে না। কারণ এদের মধ্যে সমন্বয় নেই। যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। 

১৯৮৭-৮৮ ও ১৯৮৮-৮৯ সালের বন্যায় রাজধানীর অভিজাত এলাকা নামে পরিচিত গুলশানে নৌকা চলেছিল। আর এখন সব রাস্তায় গাড়ির পাশাপাশি নৌকা চলে। সেই সময় থেকে নগর পরিকল্পনাবিদসহ পানিবিশেষজ্ঞরা রাজধানীর ৩২টি খাল সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। কিন্তু এখন পর্যন্ত খাল সংস্কার বা উদ্ধার শুধু মুখের বুলিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। চোখে পড়ার মতো কাজ হয়নি। ব্যতিক্রম ছিল ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওইসময় হাতিরঝিল প্রকল্প সুপরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন হয়। নগরবাসীদের বন্যার প্রকোপ থেকে বাঁচানোর জন্য ছিল বেড়িবাঁধ প্রকল্প। স্লুইসগেট ও বৃত্তাকার নৌপথ। সবই এখন অকেজো। তবে কারো কারো মতে, বেড়িবাঁধের ফলে জলাবদ্ধতাও বাড়ছে। আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, দেখা গেলো হঠাৎ করেই প্রকল্প নেওয়া হলো। এরপর জনবল আর অর্থবলের অভাব, তাও যদি কাজ শেষ হয় পরে সেই প্রকল্পের আর সংস্কার না থাকায় সেটিও অকেজো হয়ে পড়ে। উত্তরের মেয়র নিজে স্বীকার করেছেন, লোকজন এখন খাল, নালা বা ড্রেনের ওপর বাড়ি তুলছে। এর ফলে বাড়ছে জলাবদ্ধতা। এগুলো অপসারণের দায়িত্ব কার। রাজউক অবশ্য সম্প্রতি কিছু কিছু জায়গায় কাজ করছে অবৈধ বাড়ি, রাস্তা অপসারণে। কিন্তু সেটা ব্যাপকভাবে করতে হবে। খাল উদ্ধার করা না গেলে ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর হবে না। অন্যান্য কারণের পাশাপাশি এর ফলে যে যানজট হচ্ছে তাও নিরসন হবে না।

অর্থাৎ খাল উদ্ধারের বিকল্প যে নেই হাতিরঝিল প্রকল্পের সার্থক বাস্তবায়ন তেমনিই সমন্বিত উদ্যোগের উদাহরণ। এ কৌশল অবলম্বন করতে হবে সবজায়গায়। সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কারণে হাজারীবাগ ট্যানারি সরে যাওয়ায় বুড়িগঙ্গা নদীর পানি ৪০ ভাগ পর্যন্ত পরিষ্কার ও স্বচ্ছ হয়েছে। নদীতে গোসল করা ও মাছ ধরা চলছে সমানতালে। রাজধানীর পয়োবর্জ্য শোধনাগারে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন মহাপরিকল্পনা। পয়োবর্জ্য ও বৃষ্টির পানি কখনও এক নালা দিয়ে যেতে পারে না, ড্যাপ কার্যকর করা গেলে ভয়াবহ জলজট হবে না, জলাশয় ভরাট যারা কারে তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। সর্বোপরি ঢাকাকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন আন্তরিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সেবা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক ব্যক্তি, সংসদ সদস্যরা যদি স্ব স্ব এলাকার জন্য, মানুষের কাজের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন তবে সবকিছু সঠিক পথে চলতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, ‘রাজধানীর যানজট, জলজট ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপের দিকে নজর দিন। আগের মতো ঘরে বসে নির্বাচন করার দিন শেষ। সামনে নির্বাচন, জনগণকে জবাবদিহি করতে হবে। সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে ভোট করতে হবে।’

আমারও কথা সেটাই। সামনে ভোট, তাই ভোটের জন্য এক জোট হয়ে যতোটুকু সময় আছে জনগণের কষ্ট লাঘবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। উন্নত দেশের মতো জলজট আর যানজটে রাস্তাঘাটে আটতে থাকা মানুষগুলোকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে তবেই না ভোটের ময়দানে ওরাও নিরাপদে প্রতিনিধিকে মসনদে পৌঁছে দেবে।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ