X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইউএনও তারিক যদি সাংবাদিক হতেন

হারুন উর রশীদ
২৩ জুলাই ২০১৭, ১৭:০৪আপডেট : ২৩ জুলাই ২০১৭, ২৩:৪২

হারুন উর রশীদ বরগুনা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারিক সালমন, যিনি এর আগে বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ছিলেন, তাকে নিয়ে এখন দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি কার্ডে ছেপে মানহানি ও ক্ষতিপূরণের মামলায় দুই ঘণ্টার কোর্ট হাজতবাসের জেরে মামলার বাদী আইনজীবী সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ সাজু আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। ধর্মবিষয়ক সম্পাদকের পদ হারিয়েছেন। এ ঘটনায় বরিশাল আদালতের ছয় পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইউনও’র পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর সর্বশেষ খবর হলো তার বিরুদ্ধে মামলাও প্রত্যাহার হয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে ইউনও’র পাশে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়েছেন বলে।
এখন তাকে প্রশাসনিকভাবে হেনস্তাকারী জেলা প্রশাসক ফেসবুকে ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। বিভাগীয় কমিশনার রাজনৈতিক নেতাদের দোহাই দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে মনে হতে পারে, ন্যায় বিচারের ব্যত্যয় কোনোভাবে মেনে নিচ্ছে না প্রশাসন, পুলিশ থেকে দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। আর প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসার আগেই এই ইউএনও’র পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকরা প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদন করেছেন।
ইউএনও গাজী তারিক সালমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স করে বিসিএস ২৮ ব্যাচে প্রশাসনে যোগ দেন। তার চাকরির বয়স একযুগের একটু বেশি হতে পারে। এবার একটু কল্পনার জগতে ঘুরে আসি। মনে করি, গাজী তারিক সালমন একজন সাংবাদিক। যদি তিনি সাংবাদিকতায় যোগ দিতেন, তাহলে সিনিয়র রিপোর্টার হতেন।
তিনি যদি সাংবাদিক হতেন, তাহলে এই পরিস্থিতিতে কী ঘটতো, তা জানার আগে তিনি ইউএনও হিসেবে যা করেছেন, তার কিছু সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, তা একবার দেখে নেই। ইউএনও হিসেবে আট মাস আগৈলঝাড়া থাকতে ওইসব কাজের কারণেই প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়েন তিনি। আর সেগুলো হলো-
১. ঠিকাদার ও রাজনৈতিক নেতাদের কোনও অবৈধ সুযোগ দেননি। কাজ মানসম্পন্ন না হওয়ায় তিনি তাদের অনেকের বিল আটকে দেন। উন্নয়নকাজের প্রায় কোটি টাকা ফেরত পাঠান। যা প্রভাবশারীরা লুটেপুটে খেতে চেয়েছিলেন।

২. ডিগ্রি পরীক্ষায় নকল করার অপরাধে এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার পুত্রকে তিনি বহিষ্কার করেন। সেই প্রভাবশালী পুত্র ইউএনও’র সঙ্গে বেয়াদবি করলে তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে ছয় মাসের জেল দেন।

৩. তিনি নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেন। আর নতুন কোনও অবৈধ স্থাপনা বসতে দেননি।
তার এই কাজ থেকে বোঝা যায়, তিনি একজন সৎ কর্মকর্তা। আর সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করলেও একজন সৎ ও নিরপেক্ষ পেশাদার সাংবাদিক হতেন; এটা ধরে নেওয়া যায়। তিনি আগৈঝাড়ায় ইউএনও হিসেবে যেসব কাজ করেছেন, একজন পেশাদার সাংবাদিকের জন্য ওই কাজগুলোও খুবই আকর্ষণীয় হতো। সাংবাদিক হিসেবে তার কাজগুলোর শিরোনাম যে রকম হতে পারতো-

১. রাস্তা নির্মাণের নামে সরকারি টাকার হরিলুট, নেপথ্যে শাসক দলের প্রভাবশালী নেতারা

২. সরকারি জায়গা দখল করে সরকার দলীয় নেতার মার্কেট নির্মাণ

৩. নেতার ছেলের পরীক্ষা তাই পুরো কেন্দ্রে নকলের স্বাধীনতা

এ রকম আরও অনকে প্রতিবেদন হতে পারতো। শিরোনাম আর না বাড়িয়ে আসল কথায় আসি। এই তিনটি প্রতিবেদনের জন্য সাধারণভাবে সাংবাদিক হিসেবে তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে মোট ছয়টি মামলা হতে পারতো। প্রত্যেক প্রতিবেদনের জন্য একটি মানহানি কাম ক্ষতিপূরণের এবং প্রত্যেক প্রতিবেদনের জন্য একটি করে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মামলা।

এখানেই শেষ নয়, যেহেতু তারা প্রভাবশারী রাজনৈতিক নেতা, তাই এরপর তারা ওসি এবং ইউএনওকে হাত করে আরও অনেক মামলা ঠুকে দিত। তার মধ্যে চাঁদাবাজি তো কমন, এমকি ধর্ষণ ও হত্যা মামলাও থাকতে পারতো। ওসি সাহেব পুরনো মামলায়ও ঢুকিয়ে দিতেন। তারপর কী হতো?

তারপর সাংবাদিক গ্রেফতার হতেন। অথবা আদালতে জামিনের জন্য হাজির হলে তাকে জামিন নামঞ্জুর করে জেলে পাঠান হতো। তাকে জোরে হাতধরে জেলে পাঠানো নয়, হাতকড়া পরিয়ে এমনকি কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে পাঠানো হতো। আর এই মামলা হওয়ার আগে সাংবাদিককে কয়েক দফা পেটানো হতো। কিন্তু সাংবাদিকের কোনও মামলা নিতো না থানা। প্রশাসন বলতো ‘হলুদ সাংবাদিক’।

সাংবাদিকদের একাংশ প্রতিবাদ জানাতো আর আরেক অংশ নীরব থাকতো। উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেব বলতেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে।’ ওসি সাহেব বলতেন, ‘তদন্তের পর দেখা যাবে। তার আগ পর্যন্ত জেলেই থাকবে সাংবাদিক। আর আদালত তো আইনের বাইরে যায় না।’

এমনকি এই সাংবাদিক দেশের উন্নয়নকাজে বাধা দিচ্ছেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে বাধা দিচ্ছেন, এমন অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামিও হতে পারতেন।

এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতো, তা আমি কিসের ভিত্তিতে বলছি? দু’একটি উদাহরণ না দিলে মনে হবে আমি গল্প লিখছি।

এক. ২০১৫ সালের মে মাসে মুন্সীগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম হাসান বাদল স্থানীয় আটটি পত্রিকার ডিক্লেয়ারেশন বাতিল করে দেন। আর ১১ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেন। বিষয়টি ছিল প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সের অনুষ্ঠানে ডিসির আমন্ত্রণ রক্ষা করেননি সাংবাদিকদের একাংশ। এটাই তাদের অপরাধ।

দুই. ২০১৫ অক্টোবরে খুলনার বটিয়াঘাটার ইউএনও বিল্লাল হোসেন স্থানীয় সাংবাদিক শাহীন বিশ্বাসকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১৩ মাস জেল দেন। জেল দেওয়ার পর ইউএনও নথিপত্রও নিজের কাছে রেখে দেন, যেন শাহীন বিশ্বাস জামিনের আবেদন না করতে পারেন। দুই মাস কারাগারে থাকার পর উচ্চআদালত নথি তলব করে তাকে জামিন দেন। বটিয়াখাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি শেখ আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে ইউএনও দু’টি মামলা করেন বলেও অভিযোগ আছে। স্থানীয় সাংবাদিকরা দুর্নীতি-অনিয়মের খবর প্রকাশ করায় এই ব্যবস্থা নেন ইউএনও।

তিন. ২০১৩ সালের মে মাসে অনিয়ম আর দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করায় রাজশাহীর পুঠিয়া’র ইউএনও লুৎফর রহমান দৈনিক সমকালের স্থানীয় সাংবাদিক সৌরভ হাবিবের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করান এক সহকারী তহশিলদারকে দিয়ে। মামলায় সরকারি কাজে বাধা দান, চাঁদা দাবি, ভয়ভীতি দেখানো ও মানহানিকর সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়।

চার. ২০১৫ সালে পুলিশের বিরুদ্ধে সংবাদ করায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বাংলা ট্রিবিউনের মৌলভীবাজারের প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম। ‘শ্রীমঙ্গল থানার ওসির বিরুদ্ধে হয়রানি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ’ শিরোনামে সংবাদ করায় ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে সাদা পোশাকে থাকা পুলিশের একটি দল তাকে আটক করে। পরদিন ২৪ এপ্রিল বিকালে গাড়িতে পেট্রোল হামলা ও পুলিশকে আক্রমণের দুই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। ৩৮ দিন কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্ত হন।

পাঁচ. এই বছরের জুন মাসে খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সময়ের খবরের স্টাফ রিপোর্টার সোহাগ দেওয়ান ও পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী মোতাহার রহমানের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা তপন কুমার সাহা। যথাযথ তথ্য না নিয়ে মিথ্যা ও মনগড়া সংবাদ প্রকাশের অভিযোগের এই মামলা দায়ের করা হয়।

এই উদাহরণ আরও বাড়ানো যায়। কিন্তু তা না বাড়িয়ে উদাহরণ থেকে স্পষ্ট যে ডিসি, ইউএনও, ওসি, আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা; কেউই সাংবাদিকে রেহাই দেন না। আর প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের উদাহরণ দিয়ে আপনাদের আর সময় নষ্ট করতে চাই না।

ইউএনও গাজী তারিক সালমনকে কিন্তু এত সহজে কিছু করতে পারেননি প্রভাবশালীরা। কারণ তিনিও প্রশাসনের লোক, তারও প্রভাব আছে। তাই কৌশলে ধরেছে। শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে কার্ড ছাপানোয় ‘বিকৃতি ও অসম্মানকে’ ইস্যু করেছে। তবে এই ইস্যুতে টিএনওকে কিন্তু মামলার আগে শোকজ করা হয়েছে। বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশে জেলা প্রশাসক শোকজ করেন তারিককে। আর তারিক তার জবাবও দেন। কিন্তু কমিশনারের কাছে জবাব সন্তোষজনক মনে হয়নি। তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানোও হয়েছে। আমার মনে হয়, প্রভাবশালীরা প্রশাসন দিয়েই ইউএনওকে এক দফা ঘায়েল করেছে। তারপর মামলার দিকে এগিয়েছে। মানহানি ও ক্ষতিপূরণের মামলায় আদালত জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ওই দিনই পরে তার জামিন হয়। এরমধ্যে তাকে দু’ঘণ্টা কোর্ট হাজতে থাকতে হয়।

আর এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হয়। অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। সাংবাদিকরা প্রশ্ন তোলেন, ‘শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে কার্ড বানানো কি অপরাধ?’

ফলাফল ইতিবাচক। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে। তারপর উল্টে যায় প্রভাবশালী নেতাদের ছক।

কিন্তু গাজী তারিক সালমান সাংবাদিক হলে কী এমন হতো? আমার তা মনে হয় না। কারণ প্রশাসন বলতো, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। পুলিশ বলতো, প্রভাবশালীরা বলতেন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। সংবাদ মাধ্যম সোচ্চার হওয়ার আগে প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের এই ইউএনওকেই ছাড়েনি। তারা প্রভাবশালীদের কথায়ই কাজ করেছেন। আর এখন ইতিবাচক যা হচ্ছে, তা প্রধানমন্ত্রী ছাড়া হয়নি। ঠেলার নাম বাবাজি!

গাজী তারিক সালমন আপনাকে বলছি, আপনি যদি সাংবাদিক হতেন, আর ওই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন লিখতেন, তাহলে আপনাকে জেলেই যেতে হতো। আপনাকে হাতকড়াই পরানো হতো। আর এই সাধারণ মামলা নয়। আপনি আরও কঠিক কঠিন মামলার আসামি হতেন। মামলা প্রত্যাহার তো দূরের কথা, কবে জেল থেকে ছাড়া পেতেন, তার কোনও নিশ্চয়তা থাকতো না। এমনকি চাকরিও হারাতে পারতেন। কারণ ওই প্রভাবশালীরা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের ওপরও কখনও কখনও প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখেন।

তারপরও আপনাকে বলি, আশা করি প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা হলেও আপনি নিজের হয়রানি দিয়ে সাংবাদিক হয়রানির বিষয়টি অনুধাবন করবেন প্লিজ।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ