X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘বোগাস-রাবিশ’

গোলাম মোর্তোজা
০৯ আগস্ট ২০১৭, ১৬:২৩আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০১৭, ১৭:০৪

গোলাম মোর্তোজা একথা সত্যি যে, অধিকাংশ পত্রিকা ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী সংবাদকর্মীদের বেতন দিতে পারে না, দেয় না। কেন দেয় না, কেন পারে না—সেটা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হওয়া দরকার। নতুন ওয়েজবোর্ড দেওয়ার আগে সরকার বিষয়টি নিয়ে মালিক-সম্পাদক-সাংবাদিকদের সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। পত্রিকার মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন অর্থমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী। সেই আলোচনায় অর্থমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী যে তথ্যই পেয়ে থাকেন, তার প্রকাশ এমন ক্ষিপ্ততার সঙ্গে কেন? সাংবাদিকদের ওপর এত রাগ-ক্ষোভের কারণ কী? প্রথমে আসি অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে।
১. দায়িত্বশীল পদে থেকে কেউ যখন কোনও কথা বলবেন, প্রত্যাশা করা হয় তিনি জেনে বলবেন, অসত্য বলবেন না। ‘রাবিশ’ এবং ‘বোগাস’ শব্দ দু’টি আভিধানিক অর্থের বাইরে গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই গালিটি অর্থমন্ত্রী প্রতিনিয়ত দিয়ে থাকেন। অর্থমন্ত্রীর গালিবাচক এই শব্দের ভিত্তিতে তার নিজের বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা যাক—
ক. প্রিন্ট মিডিয়ার জন্যে ওয়েজবোর্ড আছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্যও ওয়েজবোর্ড আছে। যা সত্যি নয়। সুতরাং অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য ‘রাবিশ-বোগাস’।
খ. পৃথিবীর আর কোন দেশে এতগুলো চ্যানেল আছে, অর্থমন্ত্রী প্রশ্ন করেছেন। বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৬ কোটি, চ্যানেল চলছে ২৫/২৬ টি। ভারতের লোকসংখ্যা ১২০ কোটি, চ্যানেলের সংখ্যা প্রায় ৯০০। এবার অনুপাতটা হিসেব করে দেখেন। চ্যানেলের সংখ্যা বিষয়ক অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যটিও ‘রাবিশ-বোগাস’।
গ. সরকারি কর্মচারীদের চেয়ে সাংবাদিকরা বেশি টাকা বেতন পায়। কথাটা সম্পূর্ণ অসত্য। এই কথাটিও ‘রাবিশ-বোগাস’। তারপরও এখানে বলে রাখতে চাই, বেতন নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে কোনও রকম তুলনামূলক আলোচনায় যেতে রাজি নই।
ঘ. সাংবাদিকদের সংগঠন কতগুলো, জানতে চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বিভক্তি সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর কথা শুনলে মনে হয় বিভক্তি শুধু সাংবাদিকদের মধ্যেই! এই প্রশ্নগুলো করলে অন্যায় হবে, রাজনীতিবিদরা এতটা নীতিহীন কেন? সামরিক স্বৈরাচারের মন্ত্রিসভায় রাজনীতিবিদরা যোগ দেন কেন? রাজনীতিবিদরা এত ভাগে বিভক্ত কেন?

রাজনীতিবিদদের চেয়ে বিভক্ত আর কেউ আছে এদেশে? নীতিহীনভাবে একবার এই দলে, একবার ওই দলে, ঘোরেন কেন? একবার এর মন্ত্রী, একবার ওর মন্ত্রী কে হন?

একদা স্বৈরাচারের মন্ত্রী, এখন আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর পছন্দের ‘বোগাস-রাবিশ’ শব্দ তো তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য।

২. অর্থমন্ত্রীর কাজ কী? দেশের আর্থিকখাতের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। আর্থিকখাতের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। সেই আর্থিকখাতের উন্নয়নে অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি কী কী অবদান রেখেছেন:

ক. স্বৈরাচার এরশাদ এদেশে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকরণ করেছে। সেই স্বৈরাচারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিশ্চয় এক্ষেত্রে অবদান আছে এই অর্থমন্ত্রীর।

খ. গত আট নয় বছরে তিনি যে সব ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, তার মধ্যে প্রথমেই আসে শেয়ারবাজার প্রসঙ্গ। প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে লুট হয়েছে। কারা লুট করেছে, তদন্ত করিয়েছেন। লুটেরাদের নাম জেনেছেন। অধিকতর তদন্ত করেননি, ব্যবস্থা নেননি। লুটেরাদের নিরাপদে থাকার পেছনে অবদান রেখেছেন।

গ. সোনালী ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ সাংবাদিকরা সামনে এনেছেন। জানাটা দায়িত্ব ছিল অর্থমন্ত্রীর। তিনি জানতেন না। জানার পরও বড় অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি।

ঘ. বেসিক ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক খাতের দুর্নীতিকে তিনি ‘সাগর চুরি’ বলেছেন। কিন্তু শেখ আবদুল হাই বাচ্চুদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি। ‘সাগর চোর’দের নিরাপদে রাখার পেছনেও তার অবদান আছে।

ঙ. দেশ থেকে বছরে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার, সুইস ব্যাংকে দেশের টাকা চলে যাওয়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে টাকা চলে যাওয়া, কোনও কিছুই তিনি ঠেকাতে পারেননি। অথচ ঠেকানোটাই তার দায়িত্ব ছিল। সর্বোপরি টাকা পাচার এবং সুইস ব্যাংকে জমা অর্থ নিয়ে তিনি অসত্য তথ্য দিয়েছেন। এই অসত্য তথ্য পাচারকারীদের পক্ষে গেছে।

৩. অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের আরও দুই/একজন মন্ত্রী প্রতিনিয়তই সাংবাদিকদের অসম্মান-অবজ্ঞা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। সরকার সাংবাদিক নিপীড়নের জন্যে ৫৭ ধারার মতো কুৎসিত কালো আইন করেছেন। সেই আইনে সাংবাদিকদের নিপীড়ন করছেন। কেন সাংবাদিকদের প্রতি এমন আচরণ করছেন বা করা যাচ্ছে:

ক. নিজেদের সম্মান নিজেদের রক্ষা করতে হয়। সাংবাদিকদের বড় একটি অংশ সেই সম্মান রক্ষা করতে পারছেন না। গত কয়েক বছরে দৃষ্টিকটূভাবে সাংবাদিকদের অনেকে দলীয় কর্মীতে পরিণত হয়েছেন। সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশায় তারা সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন এবং টকশোগুলোর আলোচনা তার প্রমাণ বহন করছে। অবশ্যই সবার কথা বলছি না। তবে যাদের কথা বলছি, তাদের সংখ্যা খুব কম নয়।

খ. সরকারের মন্ত্রী, সরকারি দলের নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘দলীয় কর্মী’র মতোই আচরণ করছেন। যখন যে মন্ত্রী তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অসম্মান করছেন, তখন সাংবাদিকরা শুধু তাকে নিয়ে কিছু কথা বলছেন। এটা যে শুধু একজন মন্ত্রীর কথা বা বক্তব্য নয়, সামগ্রিকভাবে সরকারের বক্তব্য বা অবস্থান, তা সাংবাদিকরা বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। করছেন মূলত দলীয় আনুগত্যের কারণে। বাংলাদেশে সাংবাদিকরা বহু বছর ধরে রাজনৈতিক পরিচয়ে বিভক্ত। তবে এখনকার মতো এতটা দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ অতীতে কখনও দেখা যায়নি। ফলে এখন তাদের অসম্মানিত হওয়ার পরিমাণ অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে বেড়েছে।

গ. ৫৭ ধারার মতো ভয়ঙ্কর কালো আইনের বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা যে, জোরালো কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলো না, তারও বড় কারণ দলীয় আনুগত্য। দুই/একজন ছাড়া সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা দলের প্রতি যতটা অনুগত, সাংবাদিকদের প্রতি ততটা নয়। ৫৭ ধারা এখন ১৯, ২০ ধারায় স্থানান্তর হচ্ছে, তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হচ্ছে না সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো। তাও দলীয় আনুগত্যের কারণেই।

৩. অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য এবং পেছনে দাঁড়িয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর তৃপ্তিমূলক হাসির, জোরালো প্রতিবাদ অবশ্যই হওয়া দরকার। ভোট এবং জবাবদিহিতাহীন সরকার এমনই করে, সেটাও সাংবাদিকদের বোঝা দরকার। নতুন ওয়েজবোর্ড চাওয়ার আগে, কেন বিদ্যমান ওয়েজবোর্ড অধিকাংশ পত্রিকা কার্যকর করছে না বা পারছে না, তা সাংবাদিক নেতাদের জানা দরকার, ভূমিকা রাখা দরকার। একথা তো অসত্য নয় যে, নতুন ওয়েজবোর্ডের ঘোষণা দিলে চার পাঁচটি পত্রিকা ছাড়া কেউ কার্যকর করতে পারবে না। তাহলে কেন নতুন ওয়েজবোর্ড, এই প্রশ্ন আসা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফলে শুধু কাগজের ওয়েজবোর্ড নয়, আরও কিছু করার আছে।

‘বোগাস- রাবিশ’, ‘হটকারী’ লোকজন যেন সাংবাদিকদের নিয়ে অসত্য প্রপাগান্ডা চালাতে না পারে, অসম্মান করতে না পারে, জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার সাংবাদিক সংগঠনগুলোর। কিন্তু দলীয় রাজনীতি করে তা কী সম্ভব!

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ