X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাফের জলে ভাসে ‘শিশু অধিকার সনদ’

সাদিয়া নাসরিন
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৫:৪৮আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:০১

সাদিয়া নাসরিন পাঁচ-ছয় বছরের সেই কন্যাশিশু, ভেসে এসেছিলো নাফের নীল জলে। ভেসেছিলো আকাশের দিকে মুখ করে। তারপর অনেক দিন ভেসে ভেসে বেড়িয়েছে ফেসবুকের টাইমলাইনে। আইলান কুর্দীর নাম আমরা জানতে পেরেছিলাম গণমাধ্যমের কল্যাণে। কিন্তু নাফ নদীর তীরের এঁটেল মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ছোট্ট দুই নিথর শিশুর নামও আমরা জানতে পারিনি। জানতে পারিনি জলে ভাসা পদ্মের মতো সেই মেয়েটির নামও। ওদের চামড়া সাদা নয় বলেই হয়তো বিশ্বনেতাদের বুক কাঁপেনি। কিন্তু আমি ঘুমাতে পারিনি অনেক রাত, এখনও পারি না। ঘুমঘোরে আমার সন্তানদের আঁকড়ে ধরে রাখি। জেগে থাকি সামরিক জান্তার ভয়ে। দস্যু এসে না কেড়ে নিতে পারে আমার বুকের মানিককে।
ছয় বছর বয়সের রোহিঙ্গা শিশু উসমান। সে বলছিলো কিভাবে তার মাকে তার চোখের সামনেই হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। বাবার খোঁজও জানে না ওসমান। নানীর সঙ্গে টানা ১০ দিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ। টেকনাফের একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় হয়েছে তার। স্বামীর আগুনে পোড়া লাশ ডিঙ্গিয়ে ছয়দিনের কন্যাশিশু বুকে করে পালিয়ে এসেছে মোহসেনা। সেই শিশু কোনদিন জানবে না বাবা কেমন ছিলো দেখতে। এমন অসংখ্য শিশুর জীবনের ঋণ জমে আছে আমাদের ওপর। সে ঋণ শোধ করতে হবে আমাদেরই।
মিয়ানমারে সামরিক জান্তার সহিংসতার সবচেয়ে নির্মম শিকার শিশুরা। শিশু নির্যাতন এখানে ইতিহাসের সব নির্মম হত্যাযজ্ঞকে হার মানিয়েছে, ভয়াবহতার নতুন মাত্রা হাজির করেছে। কেটে ফেলা হচ্ছে শিশুদের গলা, টুকরো টুকরো করে কেটে হাত, পা, মাথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রেখেছে, পা ধরে ঝুলিয়ে ঘুরিয়ে আগুনের কুণ্ডলিতে নিক্ষেপ করছে দুধের শিশুদের। পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে উড়ে যাচ্ছে শিশুদের দেহ। শুধু নাফ নদীতেই ভেসে এসেছে ৯৩ জন শিশুর লাশ। আরাকানে কতজন শিশু মারা গেছে সে হিসেব তো পাওয়াই যায়নি।

গত ২৫ অগাস্ট থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে দুই লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। রোহিঙ্গাবিষয়ক ইউরোপীয় সংস্থা জানায়, গত কয়েক দিনে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সৈন্যদের আক্রমণে প্রায় তিন হাজার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতিটি পরিবারে গড়ে ছয়জন করে সন্তান। এই হিসেব থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি কত সংখ্যক শিশু এই আন্তর্জাতিক রাজনীতির বলি হয়েছে এবং হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য মতে শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আসতে পারা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৪৬ হাজার শিশু রয়েছে যারা স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি।

এই শিশুরা ক্ষুধার্ত, নিউমোনিয়া আর ঠাণ্ডাজনিত রোগের শিকার। চোখের সামনে নিজের পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে মারা যেতে দেখা এসব শিশুরা ভয়ঙ্কর ট্রমার মধ্যে আছে। এই শিশুরা রাজনীতি বুঝতে চায়নি, কূটনীতিও বুঝতে চায়নি। অধিকারও চায়নি গলা ফাটিয়ে। শুধু মানুষের গড়া এই সভ্যতার প্রতি তীব্র ঘৃণাটুকু জানিয়ে ওরা মরে গেলো চুপচাপ। যারা বেঁচে আছে তাদের অভিশাপে জ্বলবে এই বিশ্বগ্রামের বাসিন্দারা।

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক মতভেদ আছে, আছে বিতর্ক। মুসলিম-অমুসলিম বিতর্ক তো আছেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও ‘রোহিঙ্গাদের পক্ষে বলবে নাকি বিপক্ষে’ এই বিষয় নিয়ে সংশয় লক্ষণীয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন ভিন্ন মতামতও আছে। আমি নিজে এতসব জাতি-তত্ত্ব, জঙ্গিদমন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রাজনীতি-কূটনীতির সমীকরণ ভালো বুঝি না। আমি শুধু বুঝতে চাই মানবতা। আমি জেনে যেতে চাই শিশুর কোন বর্ডার নেই। শিশুর কোন গোত্র, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্মিয়, রাজনৈতিক, জাতীয়তা, শ্রেণি, জন্মসূত্র কিংবা অন্যকোন পরিচয় নেই। শিশুর একমাত্র পরিচয় শিশু। ওরা আমাদের সন্তান, এই মানব সভ্যতার উত্তরাধিকার, বিশ্বগ্রামের সবচেয়ে মূল্যবান সদস্য।

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ নামে একটি শিশু সুরক্ষা দলিল আছে। এই সনদের শুরুতেই পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অনুযায়ী গোত্র, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক অথবা ভিন্নমত, জাতীয়তা কিংবা সামাজিক পরিচয়, শ্রেণী, জন্মসূত্র কিংবা অন্যকোনও মর্যাদা নির্বিশেষে প্রতিটি শিশু কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়াই প্রতিটি শিশুর বিশেষ যত্ন ও সহায়তা প্রাপ্য অধিকারের কথা।

এই সনদের ছয় নম্বর অনুচ্ছেদে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ প্রতিটি শিশুর বেঁচে থাকার অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান এবং উন্নয়নের জন্য যথাসম্ভব সর্বাধিক নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করার বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রতিটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য উন্নত জীবনমানের ব্যবস্থা এবং ৩১ অনুচ্ছেদে সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর অথবা শিশুর শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটায় অথবা বিপদ আশংকা করে এমন কাজ যেন না হয় তার ব্যবস্থা গ্রহনের প্রতি অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে।

রোহিঙ্গা শিশুদের উপর ঘটনা ভয়াবহ নির্মমতা কি এই সনদে উল্লেখিত শিশু সুরক্ষা ও অধিকারকে লঙ্ঘণ করে না? রোহিঙ্গা শিশুর অধিকারের সনদ কেন ভেসে যায় নাফ নাদীর জলে? রোহিঙ্গা, সিরিয়ান, ফিলিস্তিনি, বসনিয় এবং বিশ্বব্যাপী অস্ত্র রাজনীতির বলি হতে থাকা শিশুরা কি এই সনদের বাইরে? জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ কেন শিশুদের রক্ষা করতে পারছে না এসব আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনৈতিক সহিংসতা থেকে? বিশ্ব মোড়লরা শিশুদের অধিকার সুরক্ষার জন্য যে আন্তর্জাতিক সনদ বানিয়েছেন, সেই সনদ কার স্বার্থ সুরক্ষা করছে, সেই প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।

শিশু অধিকার সনদের দ্বিতীয় পর্বের ৪৫ নম্বর অনুচ্ছেদে এই সনদের আওতাধীন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে জোরদার করার জন্য জাতিসংঘ শিশু তহবিল এবং জাতিসংঘের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এই সনদের বিধি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারী হিসাবে বিবেচিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে কেন মিয়ানমারকে শিশু হত্যার জন্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করা হবে না? কেন রোহিঙ্গা শিশুর ছিন্ন ভিন্ন লাশের হিসেব দিতে বাধ্য করা হবে না জাতিসংঘ নামক প্রহসনের রাষ্ট্রপুঞ্জের ইট-পাথরের ওই আন্তর্জাতিক আদালতে? রোহিঙ্গা শিশুদের টুকরো লাশের হিসেব মেলাতে কিসের রাজনীতি করে বিশ্ব মোড়লেরা? শিশুই যদি না বাঁচে তবে কাকে নিয়ে এই মানবসভ্যতা সাজাবে ওরা? কার জন্য এই অস্ত্রের ঝনঝনানি আর ক্ষমতার রাজনীতি?

দ্রোহের কবি সুকান্ত উচ্চারণ করেছিলেন, এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার এক নিস্ফল অঙ্গীকার। সুকান্ত বেঁচে থাকলে দেখতে পেতেন, নবজাতকের কাছে দেওয়া সে অঙ্গীকার রাখতে পারিনি আমরা। আমাদের বিশ্বনেতারা এই মানব সভ্যতা বারবার কলঙ্কিত করেছে শিশু হত্যার দায়ে। আমাদের শিশুরা শিশু অধিকার সনদের তামাশায় পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে সিরিয়ার বালুচরে, নাফ নদীর তীরে এঁটেল মাটিতে। মানবতা ভেসে যেতে থাকে নাফ নদীর জলে।

লেখক: নারীবাদী লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এমও/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ