X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুষ্ট মনের অপরাধ

শান্তনু চৌধুরী
২৪ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:০৬আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৫৪

শান্তনু চৌধুরী একথা ধ্রুব সত্য যে, আজকের যারা শিশু-কিশোর তারাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। দেশটা তাদের হাতেই। নবীন এলে পরে প্রবীণ চলে যাবে— এটাই রীতি। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে সবশেষ বেশ কয়েকটি ঘটনা এই কিশোরদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। ভাবতে হচ্ছে এই কারণে যে, এদের হাতেই আমাদের আগামীর স্বদেশ! কেন একথা বলছি, কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
২৭ অক্টোবর রাতে রাজধানীর চকবাজারের এক গলিতে সিনিয়র-জুনিয়র রেষারেষির জেরে খুন হয় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. হাসান। তাকে যে হত্যা করেছে, সেও স্কুলছাত্র। বছরের শুরুটা হয়েছিল উত্তরায় কিশোরদের গ্যাংবাজির শিকার হয়ে খুন হওয়া আদনানের মাধ্যমে। এরপর ১৮ জানুয়ারি তেজকুনিপাড়ায় খুন হয় আবদুল আজিজ নামে এক কিশোর। হত্যাকারী হিসেবে যাকে আটক করা হয়েছে, সেও কিশোর। এছাড়া পল্লবীতে মেহেদী, শেওড়াপাড়ায় মাইদুল, হাজারিবাগে ইরফানকে হত্যা করা হয়। এমন উদাহরণ অনেক। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে নয়, ঢাকার বাইরেও ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। পুরোপুরি হত্যা না হলেও সংঘর্ষ, জখম— এসব তো লেগেই আছে কিশোরদের মধ্যে। এসব ঘটনার বেশিরভাগেরই কারণ হিসেবে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমঘটিত বিষয়, এলাকার আধিপত্য, কার ক্ষমতা কত বেশি, ফেসবুকে মন্তব্য— এমন সব ঘটনার কথা উঠে এসেছে। এখন যে কিশোরদের হাতে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তাদের যদি এই হাল হয় তবে তারা আগামী দিনে দেশ চালাবে কেমন করে!
এক আইনজীবীর কাছ থেকে জানলাম, আইনে ‘মেনস রিয়া’ নামে একটি শব্দ আছে। এর অর্থ ‘দুষ্ট মন’। এ দুষ্ট মনকে অপরাধ সংঘটনের পেছনে অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। এই দুষ্ট মন হচ্ছে অপরাধটি সংঘটনের সময় দায়ী ব্যক্তির ইচ্ছা, অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য। অপরাধীর অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে মনের ইচ্ছে বা অভিপ্রায় কতখানি, তা আইন খুঁজে দেখে। নিছক আবেগের বশে কোনও অপরাধ আর পূর্বপরিকল্পনা করে অপরাধের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ জন্য দণ্ডবিধিতে নরহত্যা এবং খুনের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য টানা হয়েছে।
শুধু আমাদের দেশে নয়, সারাবিশ্বে গেল কয়েক বছরে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে কিশোর অপরাধ। গাড়ি চাপা নিয়ে মানুষ হত্যা বা স্কুলে ঢুকে ব্রাশফায়ার করে হত্যার মতো ঘটনাও তারা ঘটাচ্ছে। এ জন্য কোথাও কোথাও আইনেরও সংশোধন করা হয়েছে। এই যেমন— ভারতে গুরুতর কিশোর অপরাধ যেন হালকাভাবে না নেওয়া হয়, সেজন্য বিল পাস হয়েছে। এর শুরুটা হয় ২০১২ সালে চলন্ত বাসে মেডিক্যাল শিক্ষার্থী ‘নির্ভয়া’ হত্যাকাণ্ডের পর কিশোর বিবেচনায় এক ধর্ষককে তিন বছর সাজা দেওয়ায় সারাদেশ সোচ্চার হওয়ার পর। কিশোর বয়সীদের অপরাধের বিচার করার ব্যবস্থা (জুভেনাইল জাস্টিস) সারা পৃথিবীতেই প্রায়ই একই রকম। কিন্তু এই শতকে এসে সেটা তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
শিশু যখন কিশোরের দিকে উন্নীত হতে থাকে, তখন তার বেশকিছু শারীরিক পরিবর্তন হয়। সে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিবর্তনও হতে থাকে। একটা সময় ছিল যখন এই মানসিক পরিবর্তনটা দেখা যেত শুধু পোশাকে-আচরণে। কিন্তু বর্তমানে কিশোররা দুরন্তপনার চেয়ে দুর্বৃত্তপনার দিকে ঝুঁকছে বেশি। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা আকৃষ্ট হচ্ছে পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে। কিন্তু যেহেতু তারা একটি উন্নয়নশীল দেশে বাস করছে, সেহেতু বিভিন্ন কারণে তারা পুরোটা পশ্চিমাও হতে পারছে না, আবার পুরোটা দেশীয় সংস্কৃতিকেও লালন করতে পারছে না। একইসঙ্গে পারিবারিক অর্থ-বিত্তের ঢেউও এসে লাগছে তাতে।
একটা সময় যখন দেশে হরতাল বা মিছিল মিটিং বেশি হতো, তখন বস্তি থেকে ছেলেদের ভাড়া করা হতো এবং এরাই বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ঘটাত। এখন দেখা যাচ্ছে, পুলিশের খাতায় কিশোর অপরাধী হিসেবে যাদের নাম উঠছে, তাদের বেশিরভাগই উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত সন্তান এবং এদের বয়স ১৪ থেকে ১৮-এর মধ্যে। ঢাকার দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি।
নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশিরভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা। চুরি-ছিনতাই বা ঘর পালানোর মতো অপরাধ একসময় বড় অপরাধ বলে ধরা হতো। আর এখন কিশোরদের খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। এখন কিশোরদের ক্ষেত্রে পারিবারিক শাসনও কমে এসেছে। এমনও হচ্ছে, পরিবার শাসন করতেও ভয় পাচ্ছে। ছেলে কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে জানে না বাবা-মা। আবার উচ্চবিত্ত পরিবারে একই বাসায় থেকেও কেউ কারো খোঁজ রাখছে না। স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা হোক বা পারিবারিক কারণে হোক, সাইবার জগতে ডুব দিয়ে কিশোররা মুক্তার বদলে তুলে আনছে বিষ। প্রযুক্তির খারাপ দিকটা গ্রহণ করার কারণে তাদের প্রতিদিনের ধ্যান-ধারণাও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকাভিত্তিক ক্লাব বা সামাজিক সংগঠন যেখানে আগে খেলাধুলার আসর বসত, সেগুলো কমে গিয়ে এখন গ্যাংবাজি আর পাড়া দখল করে রাখার মতো ঘটনার দিকে ঝুঁকছে কিশোররা।
পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটা স্তরে নীতি নৈতিকতার যে অভাব, তার প্রভাব পড়ছে কিশোরদের ওপরও। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও মূল্যবোধের কারণে দিন দিন বাড়ছে কিশোর অপরাধ। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়া, পরিবারে বিশৃঙ্খলা, হতাশা, অর্থনৈতিক দৈন্য, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি কারণে কিশোর-তরুণেরা বিপথগামী হচ্ছে। এছাড়া আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা কিশোরদের অপরাধপ্রবণ করে তুলছে।
তাহলে উপায় কী? শুরুটা করতে আমরা যে সমাজে বাস করছি, সেখান থেকেই। মানে সামাজিক আন্দোলন। সেটা যে হুট করে হবে, তা নয়। শেখাতে হবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার উপায়। বয়সের যে সৌন্দর্য, সেটা যেন উপভোগ করতে পারে সেই সুযোগ করে দিতে হবে অভিভাবককে। সামাজিক সচেতনতা, অভিভাবকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই পারে কিশোর-কিশোরীকে পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দিতে। কোনও রাজনৈতিক উসকানিতে যেন সে প্রলুব্ধ না হয়, অসৎ সঙ্গেও পাল্লায় না পড়ে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রযুক্তির ভালো দিকের মাধ্যমে যেসব কিশোর-কিশোরীরা বিশ্ব মাতাচ্ছে, তাদের সম্পর্কে জানাতে হবে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যেন স্মার্টফোন ব্যবহার করতে না পারে, সেটাও লক্ষ রাখা যেতে পারে। জীবনের রঙের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে হবে। শুধু একটি ভালো চাকরি, অর্থ-বিত্তই যে জীবনের সব ন,য় সেটাও জানাতে হবে কৌশলে। জীবনকে অর্থপূর্ণ করার মধ্যেই যে সার্থকতা, সেই বীজ রোপণ করতে হবে শিশুকালেই। এসব করলেই এক নিমিষে হয়তো কিশোর অপরাধ দূর করা সম্ভব হবে না, কিন্তু ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবেই প্রবীণরা যে সাজানো বাগান তাদের জন্য রেখে যাবে, সেটাকে ফুলে-ফলে আরও বৃক্ষশোভিত করে তুলতে পারবে আগামীর তারুণ্য। নইলে বাগান হবে তছনছ। জীবন হবে কদর্য।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

/টিআর/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা প্যাকেজ পাস
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা প্যাকেজ পাস
এক্সপ্রেসওয়েতে বাস উল্টে প্রাণ গেলো একজনের, আহত ১০
এক্সপ্রেসওয়েতে বাস উল্টে প্রাণ গেলো একজনের, আহত ১০
বেসিস নির্বাচনে ১১ পদে প্রার্থী ৩৩ জন
বেসিস নির্বাচনে ১১ পদে প্রার্থী ৩৩ জন
সিঙ্গাপুরে রডচাপায় বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যু
সিঙ্গাপুরে রডচাপায় বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ