X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং মুখস্থ-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা

দিলশানা পারুল
২৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:৩৯আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:০৪

দিলশানা পারুল শিক্ষাখাতে অসংখ্য অনিয়ম, দুর্নীতির মধ্যে এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস। সবশেষ ফাঁস হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির প্রশ্নপত্র । দ্বিতীয় শ্রেণিতে যে শিশুটি পড়ে তার বয়স সাত। এখন এই সাত বছরের শিশুটির কি আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁস এই বিষয়টি সম্পর্কে কোনোরকম ধারণা থাকার কথা? না আসলেই নেই। তার মানে শিশুর অভিভাবক এবং একদল ব্যবসায়ী পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অনৈতিক যে বিষয়টা আছে সেইটা নিয়ে অসংখ্য কথা হয়েছে। আমি আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে এই অনৈতিক অবস্থানকে উৎসাহিত করে সেই দিকে একটু দৃষ্টি দিতে চাই।
সাজেশন এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস এই দুইটার মধ্যে কিন্তু ধারণাগত ছাড়া মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই। সাজেশন মানে আপনি জানেন না যে আসলেই এইটা আগামী কালের প্রশ্নপত্র আর ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র মানে আপনি জানেন যে এইটা আগামীকালের প্রশ্নপত্র। ধরেন একজন ছাত্র অথবা ছাত্রী একটি সাজেশন হাতে পেলেন অথবা একটি প্রশ্নপত্র হাতে পেলেন তারপর সেই শিক্ষার্থী কী করে? সবগুলো উত্তর ঝারা মুখস্থ করে ফেলে। তারপর পরীক্ষা হলে গিয়ে মাথায় করে নিয়ে আসা যা মুখস্থ করেছে সব উগরে দেয় এবং উগরে দেওয়া বা বমি করে দেওয়া শব্দ এবং অক্ষরগুলোর বিনিময়ে খাতায় একগাদা নম্বর পায়। ফলাফলে জিপিএ ফাইভ। যে ভালো সাজেশন তৈরি করতে পারে সে একটু কম মুখস্থ করে আর যে সাজেশন পায় না সে একটু বেশি মুখস্থ করে। একই প্রক্রিয়ায় পিইসি, জিএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি প্রত্যেকটা পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করে স্রেফ মুখস্থবিদ্যা আয়ত্ত্ব করে। স্কুল জীবনের পর আসে উচ্চশিক্ষা। প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি গাইড পাওয়া যায়। এই ভর্তি গাইড হুবহু মুখস্থ করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায় এবং ভর্তি হয়। তারপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে শিক্ষার্থীরা আবারো গাইড বই মুখস্থ করা শুরু করে, আর পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় শিক্ষার্থীরা বড় ভাইদের নোট মুখস্থ করে পরিক্ষায় পাস করে অথবা ভালো ফলাফল করে। যে শিক্ষার্থী যত ভালো মুখস্থ করতে পারে তার রেজাল্ট ততো ভালো। এইটা ধ্রুব সত্যির মতো। এইবার আসেন মুখস্থ করে আমাদের সমস্ত শিক্ষা জীবনতো পার হলো, চাকরির বাজারের কী অবস্থা? বিসিএস থেকে শুরু করে ব্যাংকের চাকরি, নীলখেতে প্রত্যেকটা সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য গাইড পাওয়া যায়। সরকারি বাদ দেন এমন কী বেসরকারি শিক্ষকতা চাকরির জন্যও গাইড বই কিনতে পাওয়া যায়। বিসিএস এ যেই শিক্ষার্থী পুরো গাইড বই মুখস্থ, কণ্ঠস্থ করে ফেলতে পারবে তার বিসিএস-এ চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা মোটামুটি ৯০ ভাগ। ওই জন্য অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের দেখবেন ১ম বর্ষ থেকেই বিসিএসএর গাইড বই মুখস্থ করা শুরু করে দেয়। এই মুখস্থ নির্ভর ভালো ফলাফলের চক্র চলতে থাকে শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে জীবনধারণের জন্য একটা চাকরি জোগানো পর্যন্ত।  

এখন আপনার মনে হতেই পারে মুখস্থ করার মধ্যে সমস্যা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমি আরেকটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে। শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? ছাত্র অবস্থায় বেশিরভাগই বলবে শিক্ষক হবো, ডাক্তার হবো অথবা ইঞ্জিনিয়ার হবো। বাবা-মায়েরা এই ভাবেই ভাবেন এবং সন্তানকেও এই ভাবেই ভাবান। তার মানে শিক্ষার উদ্দেশ্যের সঙ্গে ভালো জীবিকা সরাসরি যুক্ত এবং পরম্পরার পর পরম্পরা আমরা এভাবে ভাবছি। তার মানে এইটা এখন আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। ধরেন খুব নীতিবান বাবা-মা বা শিক্ষার্থী বলবেন শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষের মতো মানুষ হওয়া। এখন আমার পরের প্রশ্ন মানুষের মতো মানুষ হওয়া বলতে আসলে আপনি কী বোঝেন? মোটামুটিভাবে বর্তমানে মানুষের মতো মানুষ বলতে আসলে আমরা নীতিবান মানুষই বুঝি। কিন্তু বর্তমানে ডক্টরেট করা লোকও আমাদের দেশে বিরাট মাপের চোর হয় তার শিক্ষা তাকে চুরি করা থেকে আটকাতে পারে না। বিসিএস পাস করার পর একটা বিশাল অংশের সরকারি কর্মকর্তা আসলে মনেই করেন চুরি করার পারমিট পেয়ে গেলেন। যেই কারণে উচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষ লোহার পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করার মধ্যে কোনও সমস্যা দেখেন না। এসবের মধ্যে প্রমাণিত যে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষের মতো মানুষ বা নীতিবান মানুষ তৈরি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ?

এখন তাহলে শিক্ষার্থীদের মানুষের মতো মানুষ বা নীতিবান মানুষ বানাতে হলে আসলে কী করতে হবে? এই জায়গা থেকেই আপনার মনে হবে বা অনেক বোদ্ধা ব্যক্তিও বলে থাকেন স্কুল পর্যায় থেকে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। অন্য বিষয়ের মতোই ছাত্ররা যদি নৈতিক শিক্ষাও মুখস্থ করে পরীক্ষায় একশতে নব্বই পেয়ে পাস করে তাহলে? নৈতিক শিক্ষাও যদি ছাত্ররা কোনও কিছু না বুঝে স্রেফ মুখস্থ করেই পাস করে তাহলে সেই শিক্ষার্থীরওতো চোর হওয়ার সম্ভাবনাই থেকে যায়, নাকি? তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

এখন মুখস্থ করার মধ্যে সমস্যা কোথায়? এবং শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কী? এই দুটি প্রশ্নের উত্তর আসলে একই সূত্রে গাঁথা। শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং মুখস্থ-র্নিভর শিক্ষা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি অবস্থান। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইন্ডিপেনডেন্ট লার্নার তৈরি করা বাংলা করলে যেটা দাঁড়ায় স্বাধীন শিখিয়ে। মানে সেটা কী রকম? মানে নিচু শ্রেণিতে যোগ শিখলেন বিয়োগ শিখলেন, আরেকটু উঁচু শ্রেণিতে ওঠার পর সরলটা যেন আপনি নিজেই করতে পারেন। মানে শিক্ষা হচ্ছে এমন একটা টুলস বা মেকানিজম যেটা আপনাকে জীবন ভর সহযোগিতা করবে নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে। আপনার একটা ধাপের শিক্ষা আপনাকে সহযোগিতা করবে পরের ধাপে স্বাধীনভাবে অন্য কিছু শিখতে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব সভ্যতার জ্ঞান জগতের বিভিন্ন স্তরে আপনি যেন স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারেন আপনাকে সেই দক্ষতাটা দিয়ে দেওয়া। এবং এই ধাপে ধাপে আগানোর মধ্যে দিয়েই ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নিশ্চিত হয়। এখন একজন শিক্ষার্থী যখনই শুধু মুখস্থ করার মধ্যে আটকে থাকে তখন তার অন্য সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ( কগনেটিভ ডেভেলপমেন্ট) আটকে যায়। শিক্ষা বিজ্ঞানে ব্লুমস বলে একজন ভদ্রলোকের কগনেটিভ ডোমেইনের ছয়টি ভাগের কথা মোটামুটি শুনে থাকবেন। সেটা কী রকম? প্রথমে একজন শিক্ষার্থী কোনও একটি বিষয় পড়লেন মানে প্রাপ্ত তথ্যগুলো মনে রাখলেন (Remembering ), পরের ধাপে শিক্ষার্থী যেটুকু পড়লেন সেটুকু বুঝবেন (Understanding), তারপরের ধাপে গিয়ে শিক্ষার্থী যেটুকু পড়লেন সেইটা সে বাস্তাব জীবনে প্রয়োগ করতে পারার দক্ষতা অর্জন করবে ( Applying), এর পরের ধাপে গিয়ে শিক্ষার্থী সেই যে পঠিত বিষয়বস্তু বা একই ধরনের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করতে পারবে (Analysing), তারও পরের ধাপে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করতে পারবে ( Evaluating) এবং সর্বোচ্চ ধাপে গিয়ে শিক্ষার মধ্যে দিয়ে একজন শিক্ষার্থী নতুন কিছু সৃষ্টি করার দক্ষতা অর্জন করবে (Creating)।  

শিক্ষা বিজ্ঞান অনুযায়ী শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে সরল থেকে জটিলে ভাবতে সাহায্য করবে। সহজ থেকে কঠিনে বুঝতে সাহায্য করবে। মনে রাখা, মেমোরাইজেশন বা মুখস্থ বিদ্যা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের একদম প্রথম এবং নিম্নতর স্তর। এরপর আরো পাঁচটি স্তর রয়ে যাচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের। আমাদের সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থা বছরের পর বছর ধরে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সবচেয়ে নিম্নস্তরকে এবং প্রাথমিক স্তর মানে মুখস্থ বিদ্যাকেই ক্রমাগত প্রমোট করে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে কগনেটিভ ডেভেলপমেন্টের উচ্চতর সবগুলো স্তর রয়ে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই যখন একটা অ্যাডুকেশন সিস্টেমের অবস্থা তখন সেই সিস্টেমের ভেতর থেকে চিন্তাশীল মানুষ বের হবে এইটা আমরা আশা করি কিভাবে?              

লেখক: শিক্ষা গবেষণা এবং বাস্তবায়ন প্রফেশনাল

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রেলের প্রতিটি টিকিটের জন্য গড়ে হিট পড়েছে ৫ শতাধিক
রেলের প্রতিটি টিকিটের জন্য গড়ে হিট পড়েছে ৫ শতাধিক
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ