X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

আলো অন্ধকারে যাই

শান্তনু চৌধুরী
০৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১৭:৫৫আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১৮:০২

শান্তনু চৌধুরী শুরু হলো ইংরেজি নতুন বছর। যারা বেহিসেবি জীবন-যাপন করেন তাদের জন্য নতুন বছর কিছুই নয়, কিন্তু যারা যাপিত জীবনে পরিকল্পনা করেন জীবনকে সাজাতো বা গোছাতে, নতুন করে ভাবতে, তাদের জন্য নতুন বছর মানেই নতুন কিছু। কারণ কোনও একটি বিষয় নিয়ে এগুতেও তাদের একটি উপলক্ষ হয়তো প্রয়োজন হয়। সেই হিসেবে নতুন বছর শুরু একটি উপলক্ষতো বটেই। কারণ সারা পৃথিবীতে এখন এই নববর্ষকেই মডেল হিসেবে ধরে এগিয়ে যাওয়া হয়। দিন-তারিখ-মাসের হিসেব ধরা হয় খ্রিষ্টীয় নববর্ষ ধরেই এবং রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে শিক্ষা কার্যক্রম এবং যাবতীয় বাণিজ্যিক কাজও শুরু হয় খ্রিষ্টীয় নববর্ষকে ঘিরে। আমরা যদিও বাঙালি হিসেবে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নিতে অনেক আয়োজন করে থাকি তেমন আয়োজন হয়তো করা হয় না খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম চায় পুরনো বছরের গ্লানি ঝেড়ে ফেলে নতুন করে নববর্ষে শুরু করতে। আর সে আয়োজনে একটু চমক। কিন্তু কয়েকবছর ধরে সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ। এবারের বছরের শেষ দিনটিতে শীত উপেক্ষা করে বেশ রাতঅব্দি আমি হেঁটেছি ঢাকার পথে পথে। উদযাপন দূরের কথা, চারদিকে দেখেছি একটা ভীতিকর পরিস্থিতি। রাস্তায় যানবাহন কম, মোড়ে মোড়ে র‌্যাব-পুলিশের তল্লাশি। বিভিন্ন বাহিনী এমন অবস্থায় রয়েছে যেন জরুরি কিছু ঘটতে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর। বিষয়টি বেশ ব্যথিত করেছে। এরপরও গেলো কয়েকবছরে আনন্দ উদযাপন করা যেতো বাড়ির ছাদে। এবার সেখানেও বাগড়া দেওয়া হয়েছে। ডিএমপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, বর্ষবরণে একমাত্র চারদেয়ালের মাঝে কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া বাড়ির ছাদেও অনুষ্ঠান করা যাবে না। এরই মধ্যে স্থানীয় থানা থেকে বাড়িওয়ালাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো নিজ নিজ ভবনের ছাদে যাওয়ার দরজায় তালা লাগিয়ে দিতে। যাতে কেউ সেখানে গিয়ে কোনও হুল্লোড় করতে না পারে।

থার্টি ফাস্ট নাইটে রাত ১০টার দিকে নৈশ ভ্রমণ শেষে ফিরে এসেছি বাসায়। না জানি বাইরে কোনও বিপদে পড়ি সেই ভয়ে। পরদিন শুভ সকালে উঠে অন্তর্জালে দেখতে লাগলাম সংবাদপত্র, অনলাইন বা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। আশা কোথাও হয়তো আনন্দ আয়োজনের খবর পাবো। এসব খবর শুনলেও ভালো লাগে। এমনিতে নানা মাধ্যমে তারকা হোটেলগুলোর আয়োজনের খবর জেনেছিলাম। কিন্তু ১ জানুয়ারি ইন্টারনেট দুনিয়া ঘেঁটে হতাশ হতে হলো বাংলাদেশ নিয়ে। পেলাম পৃথিবীর বড় বড় দেশে কতো জমকালো আয়োজন হয়েছে তার স্থির ও ভিডিও চিত্র। আর বাংলাদেশের যে খবরটি পেলাম সেটি হলো, রাতে ঢাকা মহানগরীতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে প্রথমবারের মতো র‌্যাবের হেলিকপ্টারে সার্চ লাইট দিয়ে টহল দিতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ছাত্ররা কিছুটা আনন্দ করতে পারলেও সেখানে ছাত্রীরা বেরুতেই পারেনি, অগত্যা যথারীতি তাদের ভরসা হলো-এর ব্যালকনি। পুলিশ কমিশনার সেখানে ভিসির সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করলেন, নিরপত্তার কারণে উৎসবে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে। তবে তার ভাষ্য, ‘জনস্বার্থের কারণেই এই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘থার্টি ফার্স্ট নাইটে কিছু লোক খামোকাই হৈ চৈ করে। সেটা যাতে করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এসব কথা শুনে রস সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর সেই কথাটি মনে পড়ে গেলো। তিনি লিখেছেন, ‘নতুন বছর, নতুন বছর বলে হৈচৈ করার কিছু নেই, যখনই কোনও নতুন বছর এসেছে, সেটা এক বছরের বেশি টেকেনি!’ তাই তো! এবার বাবা-মায়েরা চেষ্টা করেছেন তরুণ ছেলেটি যাতে বাড়ির বার না হয়। সদা সতর্ক। রাত বাড়ার সাথে সাথে যেহেতু আতঙ্কে বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল সে কারণে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছেন দ্রুত। বলা যেতে পারে, মোটামুটি অবরুদ্ধ একটা পরিবেশেই কেটেছে থার্টি-ফার্স্ট নাইট। যে ধরনের পরিবেশ অন্তত ঢাকা শহরে সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে আনন্দ ঠিক জমে না। আতঙ্কই জমে বেশি। এরপরও পাড়া, মহল্লায় যে বাজি ফোটেনি, ফানুস উড়েনি, আলো জ্বলেনি তা নয়!  কিন্তু সেগুলোতে কোনও উৎসবের সমন্বিত প্রয়াস বা অনাবিল আনন্দ নেই বললেই চলে। কেউ কেউ হয়তো ঘরোয়া আয়োজন করেছে। এসব দেখে বরং বুকের ভেতর থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে এসেছে।

আমার আলোচনায় অনেকের মনে হতে পারে, আমি হয়তো রাত বিরাতে ছেলে-মেয়েদের রাস্তায় উদ্দাম নাচানাচি সমর্থন করছি বা মদ খেয়ে মাতাল হওয়ার কথা বলছি। মোটেই তা নয়। আমি চাই মানুষ যার যার মতো করে বাঁচবে। আনন্দ-উৎসব উদযাপন করবে। অবশ্যই অন্যের ক্ষতি না করে। কেউ সারারাত উচ্চস্বরে গানবাজনা করবে, ওয়াজের নামে হিন্দু সম্প্রদায়কে গালাগাল করবে, মেয়েদের দেহের অশ্লীল বর্ণনা করবে, দেশপ্রেমের নামে এলাকার কমিশনারের গুনগান চলবে সারারাত- এটাও মেনে নেওয়া যায় না। বাইরের দেশগুলোতে যারা ঘুরেছেন তারা দেখেছেন, একটা সময়ের পর সবাই মিলে মেতে উঠেন আনন্দে হুল্লোড়ে। সেখানে পুলিশ পর্যটক থেকে শুরু করে সবাইকে নিরাপত্তা দেয়। আর আমাদের এখানে সবাইকে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সরকার চাইলে একটা নির্দিষ্ট জোন করতে পারে, সেখানেই না হয় আনন্দ উৎসব হবে। এমনিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ার কথা শুনছি সেই কবে থেকে! কোনও কিছুর ওপর অবরোধ আরোপ করে সেটি বন্ধ করা যায় না। যার যেটা অভ্যাস সেটা সে করবেই। হয়তো থার্টি ফার্স্টে চুপ রাখা গেলো, কিন্তু বাকি দিনগুলোতে? মুশকিলটা হচ্ছে, ধীরে ধীরে আমরা যে মধ্যযুগের দিকে এগুচ্ছি সেটা বোধহয় টেরই পাচ্ছি না। এখন চারদিকে যেন মৌলবাদীদের জয়জয়কার।

সম্প্রতি একটা মজার বিষয় পড়লাম। পাঠকদের শেয়ার করছি। হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে বাকপ্রতিবন্ধী হওয়ার ভান করেছিলেন চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের বাসিন্দা জেং। খুন করে পালিয়ে গিয়েছিলেন অন্য জায়গায়। দীর্ঘ ১২ বছর এই ভান ধরে থাকার পর সত্যি সত্যিই কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন জেং। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, জেংকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু জেরায় কোনও কথা বলতে পারেননি তিনি। শেষে নিজের অপরাধের কথা কাগজে লিখে স্বীকার করেছেন। আমরাও হয়তো এক সময় এমন হবো। অবরুদ্ধতার কাল আর পেরুতে পারবো না। চোখে অন্যায় সয়ে যাবে। মুখ বন্ধ থাকবে। গাধার মতো দিনযাপন করবো। কিন্তু এতে যেটা হবে সেটা হলো, একটি উদার রাষ্ট্রের মৃত্যু হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ