X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বেটার লেট, দ্যান নেভার মি. নওয়াজ শরিফ

নাদীম কাদির
১২ জানুয়ারি ২০১৮, ১৭:০০আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০১৮, ১৭:০৬

পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে একটি মন্তব্য করেছেন, যা ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। তিনি বলেছেন, বাঙালিদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয়নি, আর বাংলাদেশের জাতির জনক জন্মগত বিদ্রোহী ছিলেন না।

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পাকিস্তানি নেতা বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী ছিলেন না, তাকে সেদিকেই ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।’  কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালিদের কেন্দ্রীয় ভূমিকা থাকার পরও আমরা তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করিনি এবং আমরাই তাদের বিচ্ছিন্ন করেছি।’

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নওয়াজ শরিফের প্রথম মন্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। কিন্তু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে একমত না হয়ে উপায় নেই যে, বাঙালিদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয়নি শুধু  তা-ই নয়, তারা বাঙালিদের ক্ষমতাসীন পাঞ্জাবিদের তুলনায় নিকৃষ্ট জাতি হিসেবে বিবেচনা করতো।  পাকিস্তানের অনেক সেনা কর্মকর্তা  ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হত্যা-ধর্ষণ ও নিপীড়ণ চালিয়েছে।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিদ্রোহী ছিলেন না এটা বলা সঠিক নয়।

বঙ্গবন্ধু তার দেশকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন তার জনগণকে। কৈশোর থেকেই তিনি অনুভব করতেন, পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের কিভাবে মূল্যায়ন করে এবং এ অবস্থার পরিবর্তন চাইতেন তিনি। নিজে স্বপ্ন ঠিক করেছিলেন পাকিস্তানিদের শাসন থেকে বাঙালিদের মুক্ত করবার।

এই বাঙালি নেতা ধীরে ধীরে উদিত হয়ে পুরো পাকিস্তানে সুপরিচিতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানির মতো নেতাদের ছাপিয়ে গেলেন। আমার বাবার মতো সেনা কর্মকর্তাদের কাছে সাহস আর শক্তির প্রতীক হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু, যারা পাঞ্জাবিদের শোষণের  বিরুদ্ধে নিজেদের মতো করে লড়াই চালাচ্ছিলেন।

পাঞ্জাবি কর্তৃত্বের বিপরীতে স্বাধীন দেশের পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত ছয় দফা দাবিতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যাতে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণবিরোধী তৎপরতার ইতি টানতে চেয়েছিলেন।

জনগণের প্রিয় এই নেতাকে ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেছিলেন। আমার শহীদ বাবা বঙ্গবন্ধুর অধীনে এমন একটি স্বাধীন দেশের কথা বারবার বলেছিলেন। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করার পর বাবা আরও নিশ্চিত হয়েছিলেন। বাবা জানতে পেরেছিলেন, দাবি মানা না হলে এমন দেশ গড়ে তোলা হবে। বাঙালি নেতারা পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা ও সেনাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন, যদি পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায় তাহলে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকতে।

ঐতিহাসিক ছয় দফা’র  দুটির কথা তুলে ধরলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দাবি ছিল, আলাদা মুদ্রা আর পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা বাহিনী গঠন করা।

বাংলাদেশের পর পাঞ্জাবিদের কথা উল্লেখ করতে চাই। বেলুচিস্তানের পাঠান এলাকায় তারা মূল্য চুকাতে শুরু করে।  সেখানকার পার্বত্য এলাকায় সামরিক অভিযান চালিয়ে স্বাধীনতার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন দমন করা হয়। লন্ডনে এক পাখতুন বন্ধু জানিয়েছিল, গিলগিট এখনও পাঞ্জাবিদের সহিংসতা আর নিষ্ঠুরতার চিহ্ন বহন করছে।

এক বালুচ আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা যদি তোমাদের মতো পাকিস্তান থেকে দূরের কোনও এলাকার হতাম তাহলে, এতদিনে আমরাও স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম’। তিনি অভিযোগ করেন, বেলুচিস্তানের বিদ্রোহ দমনে ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে ঢাকায় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে এনটিভির জন্য একটি অনুষ্ঠান (রোড টু ঢাকা) ধারণ করতে ইসলামাবাদে গিয়ে সেখানে এক বেলুচ ট্যাক্সিচালকের মুখেও একই কথার প্রতিধ্বনি পেয়েছিলাম।

নিজে বিপাকে পড়ে ৪৭ বছর ধরে পাকিস্তানের অস্বীকার করে আসার বিষয়টি শরিফ স্বীকার করেছেন। যা উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু  প্রশ্ন থেকে যায়, তিনি কি একমত হবেন যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানো হয়েছিল?

আরেকটি হলো, এই গণহত্যার জন্য দায়ী কে? এই গণহত্যা এড়ানো যেত, যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জনগণের দেওয়া রায় মেনে নেওয়া হতো। আর  পাঞ্জাবিদের তুলনায় বাঙালিদের নিকৃষ্ট ও ভীতু হিসেবে বিবেচনা না করা হতো।

১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ই বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা পাঞ্জাবিদের এই মিথকে ভেঙে দিয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের লাহোরে প্রবেশের চেষ্টা করলে আত্মঘাতী মিশন নিয়ে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা তা প্রতিহত করেছিলেন।

আমি আমার শহীদ কর্নেল বাবার দুটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ‘ইউ বাঙালি’ বলে গালি দেওয়ায় এক পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তাকে সজোরে চড় মেরেছিলেন তিনি। কোর্ট মার্শালে তার বিচার হয়। সদ্য বিভক্ত উপমহাদেশে ব্রিটিশ কর্মকর্তার সেই কোর্ট তাকে সাধুবাদ জানিয়েছিল। বলা হয়েছিল, কাউকে তার জাতিগত পরিচয় নিয়ে উপহাস করা ছিল অপমানজনক।

আরেকটি ঘটনা ছিল এরকম- পাঞ্জাবিরা বাঙালি সেনা সদস্যদের জোর করে রুটি খেতে বাধ্য করতো। ১৯৬৬ সালে বাঙালি সেনা সদস্যরা আমার বাবার কাছে অনুরোধ করলেন, যাতে তাদের যেন অন্তত একবেলা ভাত খেতে দেওয়া হয়। কারণ, রুটি তাদের প্রধান খাবার নয়। কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হওয়ার ভয় থাকার পরও বাঙালি সেনা সদস্যদের জন্য একবেলা ভাতের ব্যবস্থা করা উচিত বলে সেনা সদর দফতরে চিঠি লিখেছিলেন আমার বাবা। রাওয়াল পিন্ডি থেকে ফেরত আসা চিঠিতে একবেলা ভাত খাওয়ার বিষয়ে সম্মতি ছিল। ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। পরবর্তীতে যিনি বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য ‘বাংলার কসাই’ পরিচিতি পেয়েছিলেন।

নওয়াজ শরিফকে আরেকটি রাজনৈতিক কৌশলের কারণে এটা স্বীকার করার আগে, অবশ্যই তাকে বাংলাদেশে গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো  জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

 

/জেজে/এপিএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ