X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

আগুনে সুখ, আগুনে দুঃখ

শান্তনু চৌধুরী
২৭ জানুয়ারি ২০১৮, ১৯:১৬আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০১৮, ১৯:২০

শান্তনু চৌধুরী সংবাদটি শোনার পর চুপ হয়ে গেলাম। এটি একটি মর্মান্তিক মৃত্যু এবং তা আগুনে পুড়ে। কিন্তু গণমাধ্যমে কাজ যারা করেন, তারা বা যারা করেন না তারাও জানেন, যেকোনও সংবাদ বিবেচনা করা হয় তার গুরুত্ব বুঝে। সে ক্ষেত্রে প্রথমত কারও অপমৃত্যুর সংবাদ এলেই সাংবাদিক মাত্রই জিজ্ঞাসা করেন, ‘কতজন মারা গেলেন বা কে মারা গেলেন’। মৃতের সংখ্যা ও মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিচয়ের ওপরই নির্ভর করে ওই ঘটনার সংবাদমূল্য। যাক সে কথা। এবারের সংবাদটি ছিল রংপুরে শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু। শহুরে হাওয়ায় বড় হওয়া মনে ভেবেছিলাম, ‘আচ্ছা আগুন পোহাতে গিয়ে মারা যায় কেমন করে?’ পুরো ঘটনাই একের পর এক এমনভাবে ঘটতে লাগলো, বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়ার পর রংপুর মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। এখনও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন অন্তত ৫৬ জন। এর মধ্যে ১১ জন শিশু ও ৩৩ জন নারী রয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে। যার মধ্যে ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন। এই যখন পরিসংখ্যানের অবস্থা তখন বিষয়টি সত্যিই ভাবিয়ে তোলে। ভাবছি সারাদেশের অবস্থাটা তাহলে কী দাঁড়ায়?

যারা মারা গেছেন এবং যারা হাসপাতালে দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন, তাদের বেশিরভাগই নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের প্রায় সবাই দিনমজুর, খেটে খাওয়া ও নিম্নবিত্তের। এসব বলার কারণ হচ্ছে, যেকোনও দৈব দুর্বিপাক কিন্তু প্রথমেই গ্রাস করে নিম্নবিত্ত আর অসহায় মানুষকে। সেটা পোশাক কারখানা হোক, বস্তি হোক–মরছে কিন্তু গরিবরাই। এর কারণ কী? গেলো পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এবার দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পড়েছে পঞ্চগড় বা চুয়াডাঙ্গা এলাকার দিকে। দুই দশমিক ছয় ডিগ্রি। নীলফামারী, সৈয়দপুর, পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুরসহ পুরো রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের লোকজন শীতে জবুথবু। প্রকৃতপক্ষে দেশের অন্যান্য এলাকায়ও কনকনে শীত ও ঠাণ্ডা হাওয়ায় বিপর্যস্ত জনজীবন। এখনও এর রেশ কাটেনি। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, এই মাসের শেষের দিকে বা আগামী মাসের শুরুতে ফের শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে পারে। এখন এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক শীতে আগুন পোহানোর বিষয়টি। অনেকে এলাকায় আইল্যা কোলে নিয়ে আগুন পোহানো রীতিমতো ঐতিহ্য। প্রতিবছরই আগুন পোহাতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে কিন্তু এবার যেহেতু শীত বেশি পড়েছে তাই আগুন পোহানোও বেড়েছে। শীতে স্নায়ুও যেহেতু সজীব থাকে না কাজেই আগুন ধরে যাওয়ার বিষয়টি টের পেতে পেতে কিছুই করার থাকে না। সংবাদমাধ্যমের সংবাদ দেখে তেমনটিই মনে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এক শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে কেন এত মানুষ মরবে?

প্রতিবছর শীত এলেই কাপড় সংগ্রহের ধুম পড়ে যায়। এখানে-সেখানে শীতবস্ত্র বিতরণ। সরকারি-বেসরকারিভাবে কম্বল বিতরণ করা হয়। শীতপীড়িত অঞ্চলেও নিশ্চয়ই বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, গরিব মানুষের কাছে এসবের কিছুই পৌঁছেনি। তাহলে কারা পেলো এসব শীতবস্ত্র, সেটিও খবর নেওয়া জরুরি। যেগুলো সরকারিভাবে পৌঁছেছে, সেগুলো নিয়ে কোনও অনিময় হয়েছে কিনা–তাও তদন্ত হওয়া দরকার। কারণ শীতবস্ত্রের অভাবেই তো মানুষ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। শীত নিবারণের জন্যই তো আগুনের কাছে যাওয়া আর দুর্ঘটনার শিকার হওয়া। কিন্তু কথা হচ্ছে, এবার যে শীত বেশি পড়বে, সেটার সংকেত তো আগে থেকে পাওয়া গেছে। তাহলে উত্তরবঙ্গের এলাকাগুলোতে তেমন প্রস্তুতি রাখা উচিত ছিল। আর একটি বিষয় বেশ অবাক লেগেছে, শীতে আগুন পোহানো বা মৃতের ঘটনা কিন্তু একসঙ্গে ঘটেনি। ধীরে ধীরে ঘটেছে। সেক্ষেত্রে রংপুর মেডিক্যালেও যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া যেতো। কারণ আমাদের দেশে এমনিতে ঢাকা মেডিক্যাল ছাড়া অন্যান্য বার্ন ইউনিটগুলো খুব একটা সমৃদ্ধ নয়। এসব বিষয়গুলো ভাবনায় আনা উচিত। এখনও সময় আছে ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনাগুলো যেন এড়ানো যায়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে এত প্রাণহানি ঘটবে না। আর একটি বিষয় রয়েছে,  কারও বিপদে এগিয়ে না আসা। খোদ ঢাকায়ও সিলিন্ডার বিস্ফোরণে গায়ে আগুন লাগার পর অসহায় এক নারী নিচতলা, ওপরতলায় দৌড়েছেন শুধু একটু পানি বা ভেজা কিছু গায়ে জড়ানোর জন্য। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। আবার রংপুর বা এসব এলাকার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যেহেতু এরা নিম্নবিত্ত বা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, তাই এরা জানেই না কিভাবে দ্রুত আগুন নেভাতে হয় বা আগুন লাগলে কী করা উচিত। সে কারণেও অনেক সময় দগ্ধ হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। ডাক্তাররা বলছেন, দগ্ধের পরিমাণ বেশি হলে বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে শ্বাসনালী দগ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটলে সমস্যায় পড়তে হয় বেশি।

সম্প্রতি শপথ নিলেন রংপুর সিটির নবনির্বাচিত মেয়র। সেই শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে এক সময়ের মঙ্গার কারণে মানুষকে ভুগতে হতো, অভাবক্লিষ্ট মানুষের জন্য লঙ্গরখানা খুলতে হতো, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘এখন আর মঙ্গা নেই, মঙ্গা আমরা দূর করতে পেরেছি। এখনও অনেক কাজ বাকি, কোনও মানুষ গরিব থাকবে না। কোনও মানুষ গৃহহীন থাকবে না।’ কথাটি বেশ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। শুধু সরকার প্রধান নন, এই বিষয়ে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে স্থানীয় ধনিকশ্রেণি আর প্রশাসনেরও শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ মানুষ গরিব না থাকলেই ভালো। তবেই আর শীতবস্ত্রের সন্ধানে বের হবে না কেউ। যাবে না সুখের সন্ধানে, আরামের আশায় আগুনের কাছে। যে আগুন সুখের পাশাপাশি ডেকে আনছে দুঃখও।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের বিষয় যুক্ত করা হবে: পরিবেশমন্ত্রী
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের বিষয় যুক্ত করা হবে: পরিবেশমন্ত্রী
সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি বিরোধী দলীয় নেতার
সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি বিরোধী দলীয় নেতার
বিকেএসপির দুই ম্যাচেও বৃষ্টির হানা, জিতলো গাজী গ্রুপ ও রূপগঞ্জ
বিকেএসপির দুই ম্যাচেও বৃষ্টির হানা, জিতলো গাজী গ্রুপ ও রূপগঞ্জ
আদালত থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে যা বললেন ড. ইউনূস
আদালত থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে যা বললেন ড. ইউনূস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ