X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইন্টারনেটের দাম কমানো নিয়ে তামাশা

রেজা সেলিম
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:২০আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:০৪

রেজা সেলিম গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম কমানো নিয়ে আমাদের দেশে নিত্য-নতুন তামাশা চলছে! দেখে শুনে মনে হচ্ছে ‘ইন্টারনেট’ আর ‘ব্যান্ডউইথ’ কোনটা কী এই নিয়েও একটা শব্দার্থ অভিধান লেখা দরকার। যারা এই নিয়ে উপরমহলে কাজ করেন তারা ভাবেন দেশের মানুষ এসব কিছু বুঝে-টুঝে না, আর যারা নীতির চেয়ারে বসে আছেন তারাই সম্যক জ্ঞানী! কথায় কথায় তারা বলেন অমুক সময় ইন্টারনেট ছিল ৭০ হাজার টাকা, আমরা তার দাম ৫০০ টাকা করে দিয়েছি। কিন্তু এর ফলে লাভ হয়েছে কার? লাভ হয়েছে যারা ইন্টারনেট-কে মোড়কজাত করে নানা নামে বাজারে বেচতে বসেছেন তাদের, যারা কেনেন তাদের কোনও লাভ হয়নি।
উপযোগিতা কার বেশি, যিনি বিক্রি করেন নাকি যিনি কেনেন তার? বেচনেওয়ালীদের সংখ্যা কম এটা সবাই জানেন, ক্রেতার সংখ্যাই বেশি। যদি বেশি মানুষ কেনেন তার মানে কী? ভোক্তার সংখ্যা বেশি। তাহলে জানা দরকার এই ইন্টারনেট কিনে নিয়ে ভোক্তা কী করে থাকেন আর যিনি বেচেন তিনি তাঁর লাভ-লোকসান হিসাব করে দেশের উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখেন। আর ভোক্তার জন্যে যেটুকু অধিকার রক্ষিত থাকা দরকার তা আমরা রেখেছি কী না।

দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হিসাবটা কখনই করা হয় না। আমাদের দেশের ইন্টারনেট বেচা-কেনা আর ব্যবহারের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নানা দেশের লোকজন বা গবেষক প্রতিষ্ঠানগুলো অঙ্ক করে প্রতিবেদন তৈরি করেন, যার সবক’টিই হয় একপেশে, খণ্ডিত বা বিভ্রান্তিকর। এর প্রধান কারণ, আমরা এসব তথ্য-উপাত্তের কোনও সর্বজনগ্রাহ্য পরিসংখ্যান সংরক্ষণ ও সরবরাহ করতে জানি না (যেমন মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট গ্রাহক ও ব্যবহারকারীদের এক কাতারে ফেলে বাহবা পেতে লম্বা একটা হিসাব দিয়ে ফেলি, যেটা ভুল!)।  

এখন পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম এক টাকাও কমেনি। খোঁজ নিলে তা দেখা যাবে ঢাকা থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত। এখানে প্রশ্ন হলো গ্রাহক কে? বাংলা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে দেখলাম ‘ব্যবসায়ী গ্রাহক’ শব্দটি কটাক্ষসূচক শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে, যা দেখে আমার বিশ্বাস পাঠককুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে অন্তত কোনও কোনও সংবাদ মাধ্যম এটা বুঝতে পারছে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে সরকারের মাননীয় মন্ত্রী যেভাবে ইন্টারনেট-এর দাম কমিয়েছেন বলে সম্প্রতি জনপ্রিয় সংলাপ প্রক্ষেপণ করে ক্রমাগত ‘ব্যবসায়ী গ্রাহকদের’ খুশি করছেন তাতে বেশিরভাগ গ্রাহক যারা আমাদের মতো ভোক্তা তারা অতিশয় কনফিউজড হয়ে পড়েছেন এবং বুঝতে পারছেন না সরকার এমনতর কথার দায় কেন নিচ্ছে।

পাঠকের সুবিধার্থে বলছি, ‘ব্যান্ডউইথ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় একটি নির্ধারিত সময়ে (যেমন প্রতি সেকেন্ডে) কী পরিমাণ ডেটার ইউনিট পাঠানো হবে তার পরিমাপ করতে। এটি একটি সম্পূর্ণ ব্যবসায়ী কাজ। বস্তা ভরে যেমন আমরা মাল কিনে গুদামে রাখি এও তেমন, কোনও একখানে একে রেখে বা যেখানে তা পাওয়া যায় সেখান থেকে পাইকারি দরে কিনে নিয়ে ‘ইন্টারনেট’ বা জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে একে সারাদেশে বিলি করা হয়। আদতে কথা ছিল আমাদের দেশের টেলিফোন লাইনের সাথে একে জুড়ে দেওয়া হবে, কারণ দেশের প্রায় সবক’টি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ যখন ডিজিটাল সিস্টেমে উন্নীত হলো তখন সেরকমই কথা ছিল। জাপানের এনইসি কোম্পানি এই কাজটি আমাদের গুছিয়ে দেয় যাতে আমরা একই সাথে ডিশ সংযোগ ও ইন্টারনেট সংযোগ পাই। কিন্তু এটা না করে আশির দশকে রাস্তাঘাটজুড়ে ডিশের লাইন টেনে বাড়ি বাড়ি বিদেশি টেলিভিশন দেখার এক অভিনব সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। আর ইন্টারনেটের জন্যে একটি ব্যয়বহুল ব্যবসা খুলে দেওয়া হয় সেটাও ডিশ এন্টেনার মাধ্যমেই। আজকের তরুণেরা হয়তো অনেকেই এ সম্পর্কে জানে না যে, বছর দশক আগেও আমরা ইন্টারনেট পেতাম ডিশের মাধ্যমে, যাকে বলা হতো ‘ভি-স্যাট’, আর তার দাম ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে।

আমাদের দেশের ইন্টারনেট ইতিহাসের বিশদ আলোচনায় না গিয়েও এ কথা এখন আলোচনা করা দরকার কেমন করে একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী এই পথে নেমে গেলো! ২০০০ সালের মে মাসে পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর সংগঠন জি-৮ জাপানের অকিনাওয়া সামিটে এই বিষয়টিই আলোচনা করেছিলেন, এই যে পরাক্রমশালী ইন্টারনেট সন্ধান আমরা পেয়ে গেছি তা কেমন করে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বা উত্তর-দিক্ষিণের বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে তা নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার। বাংলাদেশে একমাত্র ‘প্রশিকা’ নামের একটি উন্নয়ন সংস্থা এই আহ্বানের সম্পূরক কাজ আগে থেকেই করে যাচ্ছিলো (যার প্রাণপুরুষ ছিলেন তরুণ তথ্য প্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন)। বলা বাহুল্য, জি-৮ এর সেই আহ্বানের ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বা ডিজিটাল প্রযুক্তির বৈষম্য কমাতে জাতিসংঘ পর্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়, যার ফলে ‘ইনফরমেশন সোসাইটি’র শীর্ষ সম্মেলনে (২০০৩ ও ২০০৫) সদস্য দেশগুলোর জন্যে ঘোষণাপত্র প্রণীত হয়। বাংলাদেশ সে ঘোষণাপত্র মেনে চলতে প্রতিশ্রুত এবং সেই সামিটের দেড়যুগ পরেও সরকারি প্রতিনিধিত্ব এর ফলোআপ সভায় উপস্থিত থাকে।

এখন প্রশ্ন হলো যে প্রতিশ্রুতি মেনে চলার কথা তার কতখানি বাংলাদেশ অনুসরণ করছে? ইনফরমেশন সোসাইটি ঘোষণাপত্র মেনে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা (এমন কী ভুটানও) তাদের দেশে জাতীয় ব্রডব্যান্ড নীতিমালা তৈরি করে নিয়েছে ও প্রতি বছর ইনফরমেশন সোসাইটি ফলোআপ ফোরামে জেনেভা যাওয়ার আগে তা হালনাগাদ করে নেয়। আমাদের ব্রডব্যান্ড নীতি হয়েছিল ২০০৯ সালে আর তা তামাদি হয়ে গেছে ২০১৫ সালে। আর বলাই বাহুল্য যে সেই ব্রডব্যান্ড নীতিমালায় যেসব অনুসরণীয় নির্দেশনা ছিল তার বাস্তবায়ন হয়েছে সামান্যই। আমাদের ব্রডব্যান্ড মজুত করতে একটি জাতীয় কোম্পানি (বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড বা বিএসসিসিএল) আছে, সে শত শত কোটি টাকা ঋণ করে বা খরচ করে বিদেশ থেকে ব্যান্ডউইথ সংগ্রহ করে কিন্তু তা দেশের মানুষের কাছে বিলি-বিক্রি করে না। সে বিক্রি করে পাইকারদের কাছে। এই পাইকারদের লাইসেন্স নিতে হয় বিটিআরসি বা বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশনের কাছ থেকে। পাইকারেরা যা করে, বিএসসিসিএল থেকে ব্যান্ডউইথ কিনে দেশের নানা প্রান্তে অফিস খুলে কয়েক ধাপের মাধ্যমে হয় তার দিয়ে বাড়ি বাড়ি  বা মোবাইল ফোনওয়ালারা যেমন ২-জি বা ৩-জি নামে আপনার-আমার কাছে ইন্টারনেট বিক্রি করে সেভাবে পৌঁছে দেয়।

এবারে আসি খরচের বেলায়, যার কথা মন্ত্রী মহোদয় বলে আমাদের রাগিয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রী বলছেন ২০০৯ সালের তুলনায় ইন্টারনেটের দাম অনেক কমেছে। আমরাও তা স্বীকার করি, কারণ এটা ধ্রুব সত্য। কিন্তু কোথায় কমেছে? কমেছে তো পাইকারি বাজারে ওই যে বিএসসিসিএল-এর কাছে। মজার বিষয় হলো, পাইকারবাবু সস্তায় কিনে এনে আমার কেছে যে বিক্রি করে সেটা গত কয়েক বছরে একবিন্দু কমায়নি! সে যুক্তি দেয়, আমরা তার টেনে বাড়ি বাড়ি দেই, আমাদের তো তাতে খরচ হয়! সম্প্রতি আমাদের মন্ত্রী সে সুর সমর্থন করে বললেন, এটা আমরা খোঁজ-খবর নিয়ে বুঝতে পেরেছি!

না, মন্ত্রী সাহেব বুঝেননি! কোনও খোঁজ খবরও নতুন করে নেননি। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলে ফেলেছেন, কারণ তিনি পাইকারি ব্যবসায়ীদের ‘লোক’ হয়ে গেছেন। না হলে এই দেশের বিচক্ষণমাত্র জানেন, ইন্টারনেট নিতে গেলে প্রথমেই পাইকার বা তাদের এজেন্টের কাছে কী কী টাকা আগে দিয়ে নিতে হয়–রেজিস্ট্রেশন বা কনফিগেরশন ফি, তারের টাকা, একটি জে বক্স, কোনও কোনও ক্ষেত্রে মডেম বা মিডিয়া কনভার্টার, সব মিলিয়ে ১০০০ থেকে ২৫০০ টাকা। সাথে শুরু থেকে কত নেবেন সেই অনুযায়ী মাসের অগ্রিম বিলের টাকা। ৯ বছর আগে একটা পাড়ায় তো কানেকশন নিতে এই টাকাই লাগতো, লাইনের টাকা লাগতো গড়ে ১০০০-১২০০ টাকা, খোঁজ নিয়ে দেখুন এখনও তা-ই লাগে। তাহলে দাম কমেছে কার জন্যে? আর মন্ত্রী কেন তাদের হয়ে বলবেন? দেশের বেশিরভাগ কি পাইকার? না কি বেশিরভাগ ভোক্তা? ভোট বেশি দেয় কে?

আরও আছে। মন্ত্রী বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে ইন্টারনেট নিরাপত্তা বিষয়টি দেখতে বলেছেন। এটা দেখতে হলে প্রতি সংযোগে আইপি দরকার। সেটা দেওয়া হয় না কেন? আইপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক না হলে ইন্টারনেট নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না, এটা আশা করি মাননীয় মন্ত্রী আমাদের চেয়ে ভালো বোঝেন।

লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্য প্রযুক্তি প্রকল্প

[email protected]

/এসএএস/ওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ