X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপরাধ আমানতের খেয়ানত, ‘টাকা মেরে খাওয়া’র নয়

গোলাম মোর্তোজা
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:৩৭আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪:২৩

গোলাম মোর্তোজা লেখাটা শুরু করেছিলাম দক্ষিণ কোরিয়ায় বসে। শেষ করতে পারিনি। শীতকালীন অলিম্পিকের সঙ্গে বাংলাদেশের তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও শীতকালীন অলিম্পিক নিয়ে তেমন কোনও সংবাদ নেই। যদিও আয়োজক এবং সারা পৃথিবী থেকে আমন্ত্রিত অতিথিদের মাঝে ঘুরেফিরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসছে। কারণ, অলিম্পিক কমিটির বিশেষ আমন্ত্রণে অতিথি হয়ে পিয়ংচ্যাংয়ে এসেছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ছিল ওআইসি প্রেসিডেন্টের বিশেষ ডিনার। সেই ডিনারেরও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অতিথি ছিলেন ড. ইউনূস। যদিও অলিম্পিকের যাবতীয় কৌতূহল উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে। দক্ষিণ কোরিয়ান গণমাধ্যমের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিমের বোন। শীতকালীন অলিম্পিক নিয়ে আশা রাখি আগামী সপ্তাহে লিখব।
দক্ষিণ কোরিয়ায় আয়োজিত শীতকালীন অলিম্পিকের চেয়ে বহুগুণ বেশি উত্তেজনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে। বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায়, শাস্তিকে কেন্দ্র করে যে আলোচনা, সেই প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা।

১. খালেদা জিয়াসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ২ কোটি ১০ লাখ টাকা তারা আত্মসাৎ করেছেন। টাকা এসেছিল ১৯৯৩ সালে সৌদি আরব থেকে। পরিমাণ ১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলার, টাকার অঙ্কে ৪ কোটি ৪৪ লাখ। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে আসা সেই টাকা জমা হয়েছিল সোনালী ব্যাংক রমনা শাখায়। পরে জিয়া এতিমখানার নামে ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছিল সোনালী ব্যাংক গুলশান শাখায়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রায় হলো, খালেদা জিয়ার ৫ বছরের জেল।

কয়েকটি প্রশ্ন বড়ভাবে সামনে এসেছে। খালেদা জিয়া এই মামলার আসামি হন কিনা, খালেদা জিয়া ‘এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন’ কিনা, জিয়া এতিমখানা কোথায়?

ক. সৌদি আরব থেকে টাকা যখন বাংলাদেশে এসেছিল, বেগম খালেদা জিয়া তখন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে এসেছিল টাকা। তারপর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করা হয় এবং সেই টাকার অংশ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ফান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা ব্যক্তির নামে করা এতিম স্ট্রাস্টে নিয়ে যাওয়া হয়। যে ট্রাস্টের ঠিকানা প্রধানমন্ত্রী ক্যান্টনমেন্টের তৎকালীন বাসভবন। ট্রাস্টি প্রধানমন্ত্রীর দুই সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান। ট্রাস্টের সদস্য নয়, এমন কয়েকজনের হাতে বেশ কয়েকবার টাকা স্থানান্তর হয়েছে। বেশ কয়েকজনের ব্যক্তিগত হিসাবে টাকা জমা রাখা হয়েছে।

খ. ব্যক্তিদের হাত ঘুরে এই টাকা আবার জিয়া এতিমখানার তহবিলে জমা করা হয়েছে। সেই টাকা বেড়ে এখন প্রায় ৬ কোটি হয়েছে।

গ. জিয়া এতিমখানার নামে বগুড়ায় জায়গা কেনার পেছনে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বগুড়ায় জায়গার অস্তিত্ব থাকলেও এতিমখানার অস্তিত্ব নেই। এই দীর্ঘ সময়ে এতিমখানা নির্মাণ করা হয়নি। টাকা থাকার পরও, এতিমখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

টাকা এতিমখানা ট্রাস্টের হিসাবে, সেখান থেকে কখনও ব্যক্তির হিসাবে, ব্যক্তির হিসাব থেকে আবার ট্রাস্টের হিসাবে এসেছে।

ঘ. নিম্ন আদালতে খালেদা জিয়া দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। ৫ বছরের জেল হয়েছে। উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে, এবং যাবেন।

প্রথমত: এই পর্যায়ে একথা বলার সুযোগ নেই যে, খালেদা জিয়া এই মামলার আসামি হতে পারেন না। উচ্চ আদালতের রায়-পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত: প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের টাকা ব্যক্তির নামে করা ট্রাস্টে স্থানান্তর করা, সাধারণভাবে বোঝা যায়– তা বৈধ কার্যক্রম নয়।

তৃতীয়ত: ট্রাস্টের টাকা ট্রাস্টের সদস্য নয়, এমন ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে। তিনি সেই টাকা তার ব্যক্তিগত হিসেবে জমা রেখেছেন। এটাও বৈধ কার্যক্রম নয়।

চতুর্থত: প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের টাকা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া চুরি বা আত্মসাৎ করেননি। তারেক রহমান বা অন্য কেউও এই টাকা চুরি বা আত্মসাৎ করেননি। বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে টাকা স্থানান্তর হয়ে, কয়েক হাত ঘুরে, আদালতের নির্দেশে আবার এতিমখানার তহবিলে ফিরে এসেছে। মূল টাকা বেড়ে ৬ কোটি হয়েছে। ‘এতিমের টাকা খালেদা জিয়া বা অন্য কেউ মেরে খেয়েছেন’–তথ্য তা প্রমাণ করে না। টাকা উধাও হয়ে যায়নি, ব্যাংকে জমা আছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ টাকা চুরি বা আত্মসাৎ বা ‘মেরে খাওয়া’র নয়। অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় অর্থ সংরক্ষণে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেননি, অবিশ্বস্ত আচরণ করেছেন। আমানতের খেয়ানত করেছেন, চুরি বা আত্মসাৎ করেননি।

২. সাবেক জাঁদরেল আমলা ড. সা’দত হুসাইন বিসিএস দিয়ে চাকরিতে ঢোকা অফিসারদের প্রশিক্ষণ ক্লাসে প্রায়ই একটি কথা বলেন, ‘না করবে না। সব কাজ করবে। তবে আইনে নেই, এমন কোনও কাজ করবে না। আইন না থাকলে আগে একটি আইন বানানোর উদ্যোগ নেবে।’

তার কাছ থেকে বহুবার শোনা গল্পটির অবতারণা এই কারণে যে, প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে আসা টাকা, ব্যক্তির নামে করা এতিম ট্রাস্টে হস্তান্তর বৈধ প্রক্রিয়ায় করার সুযোগ ছিল। আইন না থাকলে একাধিক আইন বানাতে পারতেন সেই সময়ের খালেদা জিয়া সরকার। তা করেননি। এই না করার কারণের নাম–ক্ষমতার দাম্ভিকতা।

এই প্রশ্ন খুব বড়ভাবে সামনে আসে, ‘বৈধ নয়’ এমন প্রক্রিয়ায় টাকা স্থানান্তর, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি কিনা- যেক্ষেত্রে টাকা কেউ চুরি বা আত্মসাৎ করেননি বা ‘মেরে খাননি’।

আইনের দৃষ্টিতে তা নিশ্চয়ই অপরাধ। কিন্তু আইন এবং আইনের প্রয়োগ তো স্থান-দেশ- কালের প্রেক্ষিতেও বিবেচনার বিষয়।

৩. খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো, মন্ত্রী এবং সরকার সংশ্লিষ্ট অনেকেই তা বলছেন। এতে অবাক হচ্ছি না। অবাক হচ্ছি, অর্থনীতি এবং রাজনীতি বোঝা কিছু ব্যক্তি যারা দাবি করেন কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক নন, তাদেরও এমন কথা বলতে-লিখতে দেখছি। তারা আবার বলছেন, খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার সঙ্গে অন্য কোনও দুর্নীতির প্রসঙ্গ আনা যাবে না। এরাই বলেন ‘তবে- যদি- কিন্তু’ শব্দগুলো ব্যবহার করা যাবে না। ‘খালেদা জিয়ার ২ কোটি টাকার বিচার করলেন, এবার তবে বছরে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচারের বিচার করেন’- ‘তবে’ ব্যবহার করে এই দাবি করা যাবে না।

প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৭০ লাখ টাকার বস্তার ‘কালো বিড়াল’ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলা যাবে না। খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় অর্থ কয়েক হাতে যাওয়া-আসার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে, জেল খাটছেন। ফারমার্স ব্যাংকে ধস নামিয়ে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতে বসার সুযোগ পাচ্ছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। খালেদা জিয়ার বিচার করলেন, মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিচারও করেন- একথা বলা যাবে না। খালেদা জিয়ার ২ কোটি টাকার বিচার করছেন, একজন ছাত্রনেতা কী করে একটি ব্যাংকের উদ্যোক্তা হওয়ার মতো অর্থের মালিক হলেন, তা বলা যাবে না। খালেদা জিয়ার ২ কোটি টাকার বিচার করলেন, ড. আতিউর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা চুরির বিচার করছেন না কেন, এই প্রশ্ন তোলা যাবে না। ‘বারাকাতই জনতা ব্যাংক শেষ করে দিয়েছে’– তখন সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয় কী করছিল? খালেদা জিয়ার ২ কোটি টাকার ক্ষেত্রে এত তৎপর, জনতা ব্যাংকের ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ক্ষেত্রে তৎপরতা নেই কেন, এমন প্রশ্ন করা যাবে না। খালেদা জিয়ার মামলার ক্ষেত্রে ঝড়ের গতি, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকের ৭ বা ৮ হাজার কোটি টাকার বিচার নিয়ে এত টালবাহানা করছেন কেন, প্রশ্ন করা যাবে না। খালেদা জিয়ার ২ কোটি টাকা স্থানান্তরের বিচার করলেন, ভালো কথা। কিন্তু শেয়ারবাজারের ৫০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিচার করছেন না কেন, প্রশ্ন করা যাবে না। খালেদা জিয়ার বিচারের মতো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করছেন না কেন, অভিযুক্তদের ধরছেন না কেন, প্রশ্ন করা যাবে না।

শুধু বলতে হবে খালেদা জিয়ার বিচারের মধ্য দিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে!

৪. বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। দেশের প্রতি আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিশ্চয় সহ্য করা হবে না। তবে মত থাকবে, ভিন্ন মত থাকবে। যুক্তি থাকবে, যুক্তি খণ্ডনের যুক্তি থাকবে।‘তবে- যদি- কিন্তু’–ব্যবহার করে অবশ্যই যুক্তি দেওয়া যাবে, যুক্তি খণ্ডন করা যাবে। ভয় দেখিয়ে, জোর করে বা ধমক দিয়ে কোনও মতামত চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আপনি ক্ষিপ্ত হলেও একথা বলার সুযোগ থাকতে হবে, এদেশে রাজনীতিবিদদের নামে মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশেই করা হয়। খালেদা জিয়া সরকারেরও মূল টার্গেট এরশাদের দুর্নীতির বিচার করা ছিল না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রধান থাকায়, এরশাদের প্রকৃত দুর্নীতির সন্ধান বা বিচার করতে পারেনি। শেখ হাসিনা সরকারও এরশাদের দুর্নীতির বিচার করতে চায়নি। দুর্নীতির মামলাগুলোকে পুঁজি করে, এরশাদকে পক্ষে রেখে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার নীতি নিয়েছে। এরশাদের বিরুদ্ধে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এরশাদ এদিক-সেদিক করলে, মামলা সামনে আসবে। যে মামলায় এরশাদের ফাঁসিও হতে পারত বা পারে, যদি সবকিছু আইন অনুযায়ী চলত বা চলে।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধের মামলাও রাজনৈতিকভাবে খালেদা জিয়া তথা বিএনপিকে কোণঠাসা করার জন্যে। এর সঙ্গে দুর্নীতি দমন বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনও সম্পর্ক নেই। আবারও বলছি, খালেদা জিয়ার বিচার করা অন্যায় হয়েছে বা হচ্ছে– তা বলা যাবে না। তবে শত শত বা হাজার হাজার কোটি টাকার চুরি-জালিয়াতি-দুর্নীতির বিচার না করে, ২ কোটি টাকা স্থানান্তরে (চুরি বা আত্মসাৎ বা ‘মেরে খাওয়া’ নয়) অবিশ্বস্ততার দায়ে খালেদা জিয়ার বিচার, বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক না, তা বলার সুযোগ নেই।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বাজেটে শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
বাজেটে শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
ডিএনসিসির কাওরান বাজার আঞ্চলিক অফিস যাচ্ছে মোহাম্মদপুরে
ডিএনসিসির কাওরান বাজার আঞ্চলিক অফিস যাচ্ছে মোহাম্মদপুরে
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ