X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদা জিয়ার রায় পরবর্তী বিদেশি বার্তা

মাসুদা ভাট্টি
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৭:০৮আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৭:১১

মাসুদা ভাট্টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদেশিদের কাছে অন্যতম প্রিয় দল হিসেবে বিএনপিকে ধরে নেওয়া যায়। অন্তত দলটি গঠিত হওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বিএনপির যেকোনও নেতিবাচক পদক্ষেপেও বিদেশিদের সমর্থন তাদের পক্ষে থেকেছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিএনপির পক্ষে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে দুতিয়ালি করায়, এতদিন যাবত বিএনপি এই বিশেষ সুবিধাটুকু পেয়ে আসছিল। এমনকী ২০০৮ সালের নির্বাচনে চরমভাবে পরাজিত হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে যখন আওয়ামী লীগ এগোতে শুরু করে, তখনও মানবাধিকার, বিচার ব্যবস্থা, মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের পাশে পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো একযোগে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে কাজ করে গেছে। একসময় এরকমও মনে করা গিয়েছিল যে, এরপরে হয়তো শেখ হাসিনার পক্ষে আর চাপ সামলানো সম্ভব হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা সে চাপ সামলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পন্ন করে আরেকটি মেয়াদ পূর্ণ করতে চলেছেন।
আন্তর্জাতিক কমিউনিটি বাংলাদেশকে এখন কোন দৃষ্টিতে দেখছে, তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। বিশেষ করে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে দুর্নীতির দায়ে সাজা লাভের পর দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষের তুলনায় বিদেশিদের চিন্তাও যে কম নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদীয় প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফরোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য প্রকাশের পর। প্রতিনিধি দলটি এদেশে এসেছিল মূলত রোহিঙ্গা ইস্যুটি পর্যবেক্ষণ করতে এবং আগামী মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে অনুষ্ঠেয় রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠানের আগে সরেজমিনে পরিস্থিতি যাচাই-বাছাই করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮) সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের প্রধান মিস ল্যাম্বরাল যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোনও কথাই ছিল না, অন্তত আমার নজরে পড়েনি। তিনি মূলত বক্তব্য রেখেছেন  খালেদা জিয়ার রায় পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে এবং এবছরের শেষ নাগাদ অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিষয়ে। মজার ব্যাপার হলো, এদেশের সুশীল সমাজ এবং বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তাদের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানেও তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনও আলোচনা করেননি। তার মানে এদেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা ইস্যুকে কোনও ইস্যুই মনে করছেন না, আর বিএনপিতো এই ইস্যুতে রাজনীতি করা ছাড়া, আর কিছুই করেনি এপর্যন্ত এবং এখন তাদের নেত্রী যেহেতু দুর্নীতির দায়ে কারাগারে, সেহেতু আর কোনও কিছুই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদিও একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের জন্য দেশের জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে দূরে ঠেলে রেখে কেবল নেত্রী ও ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেওয়া মূলত আত্মহত্যার সামিল। কিন্তু কোন কারণে বাংলাদেশের কথিত সুশীল সমাজের কাছে রোহিঙ্গা ইস্যু প্রাধান্য লাভ করে না, তা এক বিস্ময় বটে!

যা-ই হোক ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের প্রধান সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, তিনি বা তারা  জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া দুর্নীতির রায় নিয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না। কারণ, এটি আদালতের এখতিয়ারাধীন। তবে তিনি বিএনপিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তিনি এও বলেছেন যে, নির্বাচন কমিশন তাদেরকে নিশ্চিত করেছে যে, তাদের (ইসি) ওপর সরকারের কোনও চাপ নেই এবং নির্বাচন কমিশনের এ যাবৎ ভূমিকায় তারা সন্তুষ্ট। বেগম জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে নির্বাচনের ওপর কোনও ধরনের প্রভাব পড়ছে কিনা সে বিষয়ে তারা দৃষ্টি রাখবেন। ধারণা করা যায় যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন খালেদা জিয়ার রায় পরবর্তী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও বিশ্লেষণগুলো বেশ ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করেছে। প্রত্যেকটি সংবাদ বা বিশ্লেষণেই একথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, খালেদা জিয়া ও তার দল দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এই দুর্নীতির মামলাটিকে থামিয়ে দেওয়ার বা এর থেকে পরিত্রাণের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। একাধিকবার আদালত পরিবর্তন করেও কোনও সুরাহা করতে পারেননি। বিশেষ করে বিএনপির দ্বিতীয় শাসনামলে বাংলাদেশ পাঁচ-পাঁচ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কারণে বেগম জিয়ার ওপর দুর্নীতি দমন কমিশনের যেসব অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে, সেগুলোকে কেউই উড়িয়ে দিতে পারেননি। এমনকি দ্য ইকনোমিস্টের মতো পত্রিকা—যারা এদেশের সুশীল-সামরিক সরকারের আন্তর্জাতিক মুখপত্র হিসেবে কাজ করে, একসময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে ‘দুই বেগমের যুদ্ধ’ বলে চরম ন্যাক্কারজনক বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিল, সেই তারা এখনও মনে করে যে, এদেশের মূল সমস্যা এই ‘দুই বেগম’ (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া)। কিন্তু এক বেগমের পতনঘণ্টা যে এই রায়ের মধ্যদিয়ে ঘটে গেল, তা তারা স্পষ্ট করেই বলছে। কিন্তু এজন্য ইকনোমিস্ট পরোক্ষভাবে শেখ হাসিনাকে দায়ী করলেও তারা একথা অস্বীকার করছে না যে, এই দুর্নীতির ঘটনা বেগম জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে ঘটেছে এবং পরবর্তীতে তার ছেলের কারণে তা দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছিল। অতএব, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভয়ঙ্কর দুর্নীতিরোধে এই রায় হয়তো কার্যকর ভূমিকা রাখলেও রাখতে পারে, তবে এর ফলে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতার কাল শুরু হলো বলেও পত্রিকাটি মনে করে। আমার ধারণা, ইকনোমিস্টসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত রায়-পরবর্তী বিশ্লেষণ বাংলাদেশকে বুঝতে আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে বড় ধরনের সাহায্য করেছে। ফলে কেউই খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও কথা বলছে না, বা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে না।

কিন্তু সরকার কি একেবারেই চাপমুক্ত? আমি সেটা মনে করছি না। ব্যক্তিগত ও অন্যান্য যোগাযোগ থেকে যতটুকু জানা ও শোনা যায়, তাতে রায়-পরবর্তী কিছু বিষয় এদেশের কূটনীতিক সমাজে বহুবিধ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। রায়ের আগে সরকারি ও সরকারের নিজস্ব বিরোধী দলের নেতারা যেভাবে রায়ের বিষয়ে আগাম মন্তব্য করেছেন, তা অনেকের কাছেই পরিষ্কার করেছে যে, রায় সম্পর্কে সরকার আগে থেকেই জানতো। সে বিষয়টি অবশ্য একথা বলে পার পাওয়া গেছে যে, আইন বিষয়ে যার সামান্য ধারণা রয়েছে তারাই জানতেন যে, রায় কী হতে পারে। সুতরাং বেগম জিয়ার রায় সম্পর্কে আগাম বলা যেতেই পারে। কিন্তু রায় পরবর্তী বিএনপি নেতাদের হরে-দরে গ্রেফতার সরকারকে সমালোচনার মুখোমুখি করেছে। যদিও ব্যক্তিগত আলোচনায় ক্ষমতাসীন দলের  অনেক নেতাই বলেছেন যে, বিএনপি নেতাদের একটি বিরাট অংশ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন— তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য, যাতে রায়-পরবর্তী কোনও ধরনের আয়োজনে তাদেরকে অংশ নিতে না হয়। কিন্তু এর কোনও ভিত্তি আছে কিনা, সেটা নিশ্চিত না হয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিদেশি কূটনীতিকদেরতো একথা বোঝানো যাবে না, তারা বুঝতেই চাইবেন না যে, কোনও রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয় নেতারা নিজেদের গা বাঁচাতে এরকম অনুরোধ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, বেগম জিয়াকে কেন ডিভিশন দেওয়া হয়নি সে প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। এর উত্তরও সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি যে, বেগম জিয়ার আইনজীবীদের কেউই ডিভিশনের আবেদন করেননি। ফলে আবেদন না করলে কাউকে ডিভিশন দেওয়া যায় না। এরপর বেগম জিয়ার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমাকে কেন জেল খাটতে হবে, এ প্রশ্ন বিদেশিদের পক্ষ থেকে তুললেও বেগম জিয়ার বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিচারে ফাতেমাকেও কয়েদি হিসেবে তার সঙ্গে কারাবাস করার বিষয়টি কেউ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। যদিও মানবাধিকারবাদীদের এ বিষয়টি আলোচনায় তোলা উচিত। কিন্তু মামলার রায়ের সার্টিফায়েড কপি কেন এতদিনেও বেগম জিয়ার আইনজীবীদের হাতে দেওয়া হলো না, সে প্রশ্ন অনেক বিদেশি কূটনীতিকই তুলেছেন এবং যা কোনোভাবেই ন্যায়বিচারকে নিশ্চিত করে না, সরকার এ বিষয়ে যে কথাই বলুক না কেন, তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সর্বোপরি রায়-পরবর্তী বিএনপি’র শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে এদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে ইতিবাচক মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এবং এ কারণে বিএনপিকে দেশবাসীও অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে  আরেকজন দুর্নীতিবাজ ও পলাতক আসামিকে দলটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার পক্ষে কেউই বলেননি। বরং প্রকাশ্যে ও গোপনে এই মেসেজ বিএনপিকে দিয়েছে যে, তারা বিষয়টিকে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি এবং অবিলম্বে এই ভুল সংশোধন না করলে, ভবিষ্যতে দলটির জন্য তা আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াবে।

মোটকথা, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া কারাদণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন পথে হাঁটছে। একথা দেশে যতটুকু আলোচিত হচ্ছে বিদেশেও হচ্ছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ বিষয়ে যেসব দেশের আগ্রহ রয়েছে, সেসব দেশেই। নিশ্চিতভাবেই একে কেউ বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট হিসেবে দেখছে না, কারণ কোনও ব্যক্তির ওপর একটি দেশের বা জাতির ভবিষ্যৎকে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে কেউ নয়। যে কারণে বিদেশিদের পক্ষ থেকে বিএনপিকে অনুরোধ করা হয়েছে— নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে। তবে রায় পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ চাপমুক্ত রাখার পরামর্শ দিয়েছে তারা। আদালতকে আদালতের জায়গায় ছেড়ে দিয়ে সরকারের শরীরেও যে দুর্নীতির গন্ধ লেগেছে, তা অবিলম্বে মুছে ফেলার ব্যাপারে যে জোর পরামর্শ সরকারকে তারা দিয়েছে, সেটি যদি সরকার পালন না করে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি প্রভাবে অতীতে যে খেলা চলেছে, তার যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে সেটা বোঝার জন্য চাণক্য পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

 

/এসএএস/এপিএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ছেলেকে প্রার্থী করায় এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি
ছেলেকে প্রার্থী করায় এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ