X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

আড়ালেই থাকছে ছেলেশিশু নির্যাতন

শান্তনু চৌধুরী
০৬ এপ্রিল ২০১৮, ১১:৫০আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০১৮, ১২:০৩

শান্তনু চৌধুরী যে এলাকায় আমি জন্মেছি চট্টগ্রামের সেই এলাকায় ছেলেবেলায় প্রায় সময় ওয়াজসহ নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান লেগে থাকতো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধর্মীয় বক্তারা যেতেন সেখানে। আমি যেহেতু লুঙ্গি পরার অভ্যাস করিনি এবং বলা বাহুল্য হাফপ্যান্ট পরতাম সে কারণে উরুর একটা বৃহৎ অংশই অনাবৃত থাকতো। প্রায় সময় দেখতাম স্কুলের শিক্ষকরা ফার্স্ট বয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর মৌলভী বা হুজুর শ্রেণির লোকেরা চাইতেন আমি তাদের সঙ্গ দেই। অনেকে রাতের খাবারের পর তাদের সঙ্গে দেখা করতে বলতেন। শিশুর সারল্য ছিল বলেই বিষয়টা বুঝতাম না। কিন্তু আমার সেই সারল্য ভেঙে দিয়েছিলেন তখনকার বন্ধুরা। তারা বলতো, ‘খবরদার হুজুররা ডাকলে যাবি না!’ আমি অবাক হলে তারা হাসতো। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি অনেক সম্ভাব্য ট্রমা থেকে তখন বেঁচে গিয়েছিলাম। এই কথাটি কিছুদিন আগে অফিসের ডেস্কে বসে নিউজ করতে করতে হঠাৎ মনে এলো এই কারণে যে গেলো কয়েক মাসে দেশের বেশ কয়েক জায়গায় ছেলেশিশু বলাৎকারের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। তেমন কয়েকটি উদাহরণ দেই। ‘গাজীপুরের শ্রীপুরে মোহাম্মদিয়া আরাবিয়া নুরানী হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার আট বছরের শিশু ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে ফোরকান আহমেদ নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ’। নেত্রকোনায় শিশু বলাৎকারের সময় হাতেনাতে ধরা পড়ার পর স্থানীয়রা লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের রামপুর জামে মসজিদের ইমামকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে। রাজধানীর সবুজবাগ থানার বাসাবো এলাকার একটি মাদ্রাসায় আট বছরের এক ছাত্রকে মুখে স্কচটেপ, হাত ও পা বেঁধে বলাৎকারের অভিযোগে মাদ্রাসার একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। ঘটনার পর ওই শিক্ষক পালিয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীতে একটি হেফজখানার শিক্ষার্থী এক ছেলেশিশুকে বলাৎকারের অভিযোগে সেখানকার এক শিক্ষককে আটক করেছে পুলিশ।
প্রায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে মাদ্রাসাগুলোতে বা আবাসিক মাদ্রাসায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এর কিছু কিছু যখন মাত্রা ছাড়ায়, শিশুটির কোনো ক্ষত হয় বা মরণাপন্ন হয় তখন প্রকাশ হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চেপে যায় পরিবার এই কারণে যে সেখানে লোকলজ্জার ভয় থাকে। সমাজে হেয় হওয়ার একটা বিষয় থাকে। তবে এর সঙ্গে ধর্ম বা ধর্মীয় শিক্ষার কোনো প্রভাব নেই বলে আমি মনে করি। এটি সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তির নিজস্ব বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু সমস্যাটা অন্যখানে। বাংলাদেশে যে সংখ্যক ছেলেশিশু যৌন নির্যাতন বা যৌন বিকৃতির শিকার হয়, প্রচার যেমন কম হয় তেমনি এটি যে কোনও অপরাধ হতে পারে তাই যেন অনেকে মনে করেন না। শিশু অধিকার সংগঠনগুলো বলছে এই তথ্য। তাদের মতে, প্রচার হওয়া যৌন নির্যাতনের চেয়ে প্রচার না হওয়া শিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনা আরও বেশি। কিন্তু ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতনের বিষয়টি বাংলাদেশের সমাজে বা দেশের আইনে একেবারেই গুরুত্ব পাচ্ছে না। বাংলাদেশে শিশুদের প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধে যে আইন রয়েছে তার নাম ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’। সেখানে শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনের শিকার হিসেবে শুধু কন্যাশিশুর কথাই বলা হয়েছে। আমাদের সমাজের লোকজন বা বিশেষ করে শিশু বা কিশোরদের মন ছেলেবেলা থেকে এই ধারণা নিয়ে বড় হয় যে নির্যাতন মানে মেয়ে শিশুকে নির্যাতন। ছেলেরা নয়। এই ধারণা কারো মধ্যে থাকে না যে ছেলে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। একমাত্র যে নির্যাতনের শিকার হয় সেই-ই বুঝতে পারে এর ভয়াবহতা কতটুকু। আমাদের সমাজে শিশুবেলায় মায়েরা বা অভিভাবকরা মেয়েদের যেমন শেখায় কোনটা খারাপ স্পর্শ, কিন্তু ছেলেটাকে কেউ শেখায় না। এই জায়গাটা ভাঙার মনে হয় সময় এসেছে। ছেলে শিশু হোক বা মেয়ে শিশুসহ দুজনেই কিন্তু যৌন হয়রানি, যৌন-বিকৃতির শিকার হতে পারে। সবাইকে একথা বলা উচিত যে মেয়েশিশুকে রক্ষা করা জরুরি তো বটেই কিন্তু এর ফাঁকে ছেলেটি কোনো সমকামী বা বিকৃত মানসিকতার শিকার হচ্ছে কিনা সেটির দিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি। বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষকদের যৌন অপরাধ নতুন নয়। ঐতিহাসিকভাবেই এই প্রবণতা লক্ষণীয়। তারা কখনও সমকামীরূপে, কখনও ধর্ষকরূপে, কখনও বহুগামী, কখনও বিকৃত যৌনাচারী হিসেবে সমাজের সামনে নিজেদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। সেটা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এখন পর্যন্ত। শিশু অধিকার ফোরাম তথ্য দিচ্ছে, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ১৪টি ছেলে শিশু ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে বেশিরভাগই অভিযুক্ত মাদ্রাসার শিক্ষক। তবে আবার একথা বলাও ঠিক হবে না যে শুধুমাত্র মাদ্রাসার কতিপয় শিক্ষক দোষী। এই তালিকায় আরো পাওয়া যাবে, পরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউ। যিনি পরিবারের সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্কের সূত্র ধরে মুখোশ এঁটে থাকেন। গৃহশিক্ষক রয়েছে এই তালিকায়। যার কথা ছেলেশিশু বলতেই পারে না পাছে অভিভাবকরা মনে করেন, না পড়ার জন্য বাহানা ধরেছে ছেলে। চায়ের দোকান, রেস্টুরেন্ট বা রিকশার গ্যারেজে বিশেষ করে অনেক লোক গাদাগাদি করে যেখানে বসবাস করেন সেখানে এ ধরনের বিকৃত যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে থাকে। পথশিশু, বাস, ট্রেন বা লঞ্চ টার্মিনালে যারা কাজ করে এমন সব ছেলেশিশু এই ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বেশি। সমাজের একশ্রেণির বিত্তবানদের মধ্যেও এই ‘রোগ’ রয়েছে কিন্তু। হুমায়ূন আহমেদ তার ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ ছবিতে সেটা দেখিয়েছেন ভালো করে। আমাদের গল্প-উপন্যাস বা সাহিত্যে এর ছড়াছড়ি রয়েছে। এতেই বোঝা যায় এটি আমাদের সমাজের কতটা নির্মম বাস্তবতা। তবে একথাও ঠিক যে, বিকৃত যৌনতা বা ছেলে শিশুর ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা পৃথিবীর অনেক সভ্য দেশেও রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার চার্চগুলোর যাজকদের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিশুকে যৌন নির্যাতন করার প্রমাণ মিলেছে এক সমীক্ষায়। এতে বলা হচ্ছে, গত ছয় দশকে শিশুকামী যাজকদের হাতে দেশটিতে ৪ হাজার ৪৪০ জন শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। জার্মানির এক বিশ্বখ্যাত গানের স্কুলের ওপর চালানো এক তদন্তে দেখা গেছে, গত ৫০ বছরে পাঁচশোরও বেশি শিক্ষার্থী বালকের ওপর শারীরিক কিংবা যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে। যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর ৭২ হাজার পুরুষ বলাৎকার ও যৌন হয়রানির শিকার হয়। সে অনুযায়ী, প্রতি ১০ জন পুরুষের মধ্যে একজন এ ঘটনার শিকার হয়। আর প্রতিবেশী ভারত বা পাকিস্তানের অবস্থাও তথৈবচ। মাদ্রাসাগুলোতে ছেলেশিশুর সমানুপাতিক হারে বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে বেশি কিন্তু মেয়ে শিশুও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গেলো এক সপ্তাহে বরিশাল, রংপুর, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইলসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় এ ধরনের ঘটনার খবর পত্রিকায় এসেছে। কিন্তু মাদ্রাসাগুলোতে দেখা যাচ্ছে শাসন ব্যবস্থা বেশ কড়া। বিশেষ করে পড়া না পারলে বা কোনো নিয়ম না মানলে। তেমন একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে গেলো ১৩ মার্চ নারায়ণগঞ্জের। সেখানে বন্দর উপজেলার মুছাপুর দারুল সুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসায় পাঞ্জাবির সঙ্গে প্যান্ট পরে আসায় এক মাদ্রাসাছাত্রকে মারধরের অভিযোগ ওঠে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এই মারধরের প্রতিবাদ করায় ৩০ শিক্ষার্থীকে মাদ্রাসার মাঠে দাঁড় করিয়ে জুতাপেটা করার অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানের সভাপতির বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে অবশ্য শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে পরে তাদের শান্ত করা হয় একই সঙ্গে জুতাপেটার মতো অপরাধের শাস্তির আশ্বাস দেয়া হয়। এই ঘটনার পরবর্তীতে কী হয়েছে জানা না গেলেও এটা ঠিক যে এমন সব কঠোর শাসন চলে মাদ্রাসাগুলোতে। যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মারধর বলতে গেলে উঠেই গেছে সেখানে মাদ্রাসাগুলোতে তা বহাল তবিয়তে রয়েছে। যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু আমার এক সহকর্মীর জিজ্ঞাসা ছিল, যেসব ইমাম বা মাদ্রাসা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ রয়েছে তাদের কি ঘরে স্ত্রী বা সন্তান নেই বা ‘মেয়েমানুষের’ অভাব? বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করলে এমন দাঁড়ায়। তারা সমাজে এমন একটি মুখোশ এঁটে থাকেন যাতে এলাকায় তারা গণ্যমান্য হিসেবে সম্মান পান। মুরগির ভালো মাংস, খাসির রেজেলা, গরুর কলিজা খান খাবার হিসেবে কোনও অনুষ্ঠানে। খাতির যত্নে কোনও অভাব হয় না মেহমান হিসেবে কোথাও গেলে। যে কোনও বিষয়ে তাদের পরামর্শও নেয়া হয়। আবার অনেকের সংসারও থাকে দূরে। সে হিসেবে ইচ্ছে থাকার পরও যৌন চাহিদা তারা মেটাতে পারে না সহজে। সেই অবদমিত যৌনচর্চার ফলস্বরূপ তারা নির্যাতন করে কোমলমতি ছেলে শিশু বা মেয়ে শিশুদের। কারণ সেখানে সহজলভ্য প্রাপ্তি। এমন অনেক ঘটনা অগোচরেই থেকে যায়। কিন্তু এখন অনেকে সাহসী হয়েছে, সে কারণেই খুলে পড়ছে মুখোশ। সেটি আরও যত দ্রুত করা যায় ততই মঙ্গল। অন্তত নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচবে শিশুরা।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ