X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কওমি শিক্ষাধারাও আধুনিক

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
২০ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:১৯আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৭:০৩

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে—কওমি মাদ্রাসার কোনও শিক্ষার্থীকে কখনও কোচিং, টিউশন বা প্রাইভেট পড়তে হয় না। মাদ্রাসার প্রতিটি ক্লাসে শিক্ষকরা যে পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করেন এবং আবাসিক ছাত্ররা অবসরে শিক্ষকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে যে পরিমাণ পড়াশোনা করে থাকেন—প্রাইভেট, কোচিং বা আলাদা কোনও টিউটরের প্রয়োজন পড়ে না।
বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষার যে প্রবল বাণিজ্যিকীকরণ চলছে, সে বিবেচনায় কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থার এই স্বপ্রণোদনা নিঃসন্দেহে অনুকরণযোগ্য।
সন্তানকে সুশিক্ষিত করতে প্রতিজন মা-বাবা যে শ্রম, অর্থ, সময় ও দুশ্চিন্তা ব্যয় করেন, কওমি শিক্ষার্থীদের পেছনে তার সিকিভাগও ব্যয় করতে হয় না। কওমি মাদ্রাসার পড়াশোনার এটা অনেক বড় অ্যাডভান্টেজ। একই সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্রগঠনেরও সম্যক প্রতিষ্ঠান; যেখানে ধর্মবোধ, দেশপ্রেম, পারস্পরিক সম্মান, সামাজিক নৈতিকতা সেই ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দেওয়া হয়।  যা আমাদের কোচিংনির্ভর সাধারণ শিক্ষায় অনেকাংশে অনুপস্থিত।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি।  সেদিন গ্রামের বাজার থেকে অটোভ্যানে বাড়ি ফিরছিলাম।  আমাদের গ্রামের পুঁচকে একটা মেয়ে, বয়স বড়জোর ছয়-সাত হবে, আমার সঙ্গে ভ্যানে চড়লো।  গায়ে স্কুলের ইউনিফর্ম, কাঁধে তার মস্ত বড় স্কুলব্যাগ। ভ্যানে চড়েই সে ভ্যানচালককে বললো, ‘আঙ্কেল, তাড়াতাড়ি চলেন। আমার টিউশনিতে দেরি হয়ে যাবে।’
আমি কৌতূহলী হয়েই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আম্মু, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?’
‘ক্লাস টু-তে।’
‘ক্লাস টু-তে পড়েও টিউটরের কাছে পড়া লাগে?’
‘হুমম, আমি তিনজন টিউটরের কাছে পড়ি। সকালে এক টিউটরের কাছে বাংলা পড়ে এসেছি। এখন গিয়ে কোচিংয়ে অংক পড়বো আর বিকেলে ইংরেজি টিচার আসেন।’
আমি মোটামুটি বিষম খেলাম! ক্লাস টু-এর বাচ্চার জন্য যদি তিনজন আলাদা টিউটর প্রয়োজন হয় তাহলে স্কুলের টিচাররা তাকে কী পড়ান? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষা তাদের দিতে পারছে না? প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়—সকল মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের একাধিক বাড়তি কোচিংয়ের প্রয়োজন হয়।  তার মানে কি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে পারছে না?
অথচ যেখানে একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর একাধারে দশ থেকে বারো বছর শিক্ষাকালীন সময়ে এক পৃষ্ঠার বাড়তি কোচিংয়ের প্রয়োজন হয় না, সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি ক্লাসে একাধিক সাবজেক্টের জন্য একাধিক টিউটর বা কোচিংয়ের প্রয়োজন হচ্ছে। একই দেশে দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার এমন দুই মেরুর পার্থক্য, এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর বৈকি।
যদি কোচিং বা প্রাইভেট পড়ার দ্বারা উন্নত শিক্ষা অর্জিত হয়, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হতে পারে- উন্নত বিশ্বে কি প্রাইভেট বা কোচিংয়ের ব্যবস্থা আছে? কোনও দেশেই সম্ভবত এমন বাণিজ্যিক কোচিংয়ের ব্যবস্থা নেই। তাহলে এই কোচিং বাণিজ্যের নামে সত্যিকার অর্থে আমরা আসলে শিক্ষার কি সোনার পাথরবাটি অর্জন করছি?
দুই
এখন তো ক্লাস ওয়ান-টুতে ভর্তি হলেই সন্তানের জন্য হাজার টাকার প্রাইভেট টিউটর জোগাড় করতে হয়। তাছাড়া ভালো স্কুলে ভর্তি করাটা একটা সামাজিক স্ট্যাটাসে পরিণত হয়েছে। বাচ্চা কী পড়তে চায় বা কী শিখতে চায়, কিংবা সে এতোগুলো বই পড়তে পারছে কি-না; সেদিকে থোড়াই কেয়ার করা হয়। তাকে মেরে-পিটিয়ে ভারি ভারি বই গেলানো হয়। এই গেলানো চলতে থাকে অনার্স-মাস্টার্স পর্যন্ত। ফলশ্রুতিতে অনার্স বা মাস্টার্স পাস একজন শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশনের পর কমপ্লিট একজন ‘চাকরিযোগ্য’ রোবটে পরিণত হন।
দিনশেষে সব মা-বাবা চান তার সন্তান একজন ভালো মানুষ হোক, ভালোভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকুক, তাদের বাধ্য হোক, সমাজে তাদের নাম উজ্জ্বল করুক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সন্তানকে উন্নত শিক্ষার নামে যে পরিমাণে ‘জ্ঞান’ গলাধঃকরণ করা হচ্ছে, তার সামান্য পরিমাণ নৈতিকতার তালিম তাকে দেওয়া হয় না। ফলে দেখা যায়, সন্তান ‘জ্ঞানসাগর’ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ‘বিদ্যাসাগর’ হচ্ছে না।  সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য হন্যে হয়ে আমরা তার পেছনে লেগে থাকছি। ভালো টিচার, ভালো স্কুল, ভালো কোচিংয়ের পেছনে আমরা যে পরিমাণ অর্থ ও সময় ব্যয় করি, এর চেয়ে অনেক কম সময় খরচ করে যদি তার নৈতিকতা, উন্নত চরিত্র গঠন, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের পেছনে ব্যয় করতাম, তাহলে খুব সহজেই আমরা সুখের সহজ ফর্মুলা হস্তগত করতে পারতাম।
অঢেল টাকা খরচ করে পড়ালেখা আর ভালো বেতনের চাকরি কিংবা মোটা অংকের রোজগার মোটেও সুখী জীবনের শেষকথা নয়। প্রতিটি শিশুর ভালো মানুষ হওয়ার সবচেয়ে কার্যকর পাঠশালা হলো তার পরিবার। এখান থেকে শিক্ষা না পেলে, কেতাবি ‘জ্ঞান’ দিয়ে ভালো মানুষ হওয়ার আশা করা বৃথা।
কওমি মাদ্রাসা একদিকে যেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় স্বপ্রণোদনায় বিশ্বাসী, তেমনি নৈতিকতা, উত্তম চারিত্রিক উৎকর্ষ, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেমেরও অন্যতম সূতিকাগার। এ কারণেই কওমি মাদ্রাসা হাজার বছরের সনাতনী শিক্ষাধারা হয়েও আজ  পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে স্বমহিমায় টিকে আছে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার উচিত, কওমি মাদ্রাসার এই সর্বজনীন শিক্ষাধারা থেকে কিছুটা হলেও শিক্ষা গ্রহণ করা।
লেখক : তরুণ আলেম, কবি ও কথাসাহিত্যিক

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ