X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শবে বরাত হোক বাড়াবাড়িমুক্ত

জহির উদ্দিন বাবর
০১ মে ২০১৮, ১৩:৩৬আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৭:০০

জহির উদ্দিন বাবর চন্দ্রবর্ষের অষ্টম মাস শাবান।  পবিত্র রমজানের প্রস্তুতির মাস হিসেবে এই মাসের একটি বিশেষ ফজিলত আছে।  তবে এই মাসের মাঝামাঝি তথা ১৪ তারিখ দিবাগত রাতটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।  পবিত্র হাদিসে ‘লাইলাতু নিসফি মিন শাবান’ বা মধ্যশাবানের রাত হিসেবে এটাকে উল্লেখ করা হয়েছে।  বছরে যে পাঁচটি রাত ফজিলতপূর্ণ এর মধ্যে এই রাতটি অন্যতম।  এই উপমহাদেশে রাতটি ‘শবে বরাত’ ও ‘লাইলাতুল বরাত’ নামে পরিচিত।  অনেক গুরুত্ব ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে রাতটি পালিত হয়। আমাদের মসজিদগুলো এই রাতে কানায় কানায় ভরে যায়।  বছরের অন্যান্য সময় ধর্মকর্ম তেমন না করলেও অনেকে এই রাতে ইবাদতে নিমগ্ন হন।  আবহমান কাল থেকে আমরা পবিত্র আবহে, উৎসবের আমেজে শবে বরাত পালন করতে দেখে এসেছি।
ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় শবে বরাতকে কেন্দ্র করে একটি বিতর্ক লক্ষ্য করা যায়।  এক পক্ষ মনে করেন, এই রাতের বিশেষ কোনও গুরুত্ব নেই। এই রাতে উৎসব করে নফল ইবাদতের কোনও মানে হয় না।  বরং কেউ কেউ এটাকে ‘ইসলামে নতুন আবিষ্কার’ বা বিদাত হিসেবে মনে করেন।  বিশেষত যারা সহিহ হাদিসকে বেশি গুরুত্ব দেন এবং মধ্যপ্রাচ্যকে অনুসরণ করেন তারা এই রাতের ঘোর বিরোধী।  তাদের বক্তব্য হলো, কোরআনের কোথাও এই রাতের কথা উল্লেখ নেই।  সহিহ হাদিস সূত্রেও এই রাতের ফজিলতের কথা জানা যায়নি।  যে হাদিস দ্বারা এই রাতকে ফজিলতপূর্ণ মনে করা হয় সেই হাদিসের সূত্র খুবই দুর্বল।

আবার আমাদের সমাজে আরেকটি শ্রেণি আছে যারা এই শবে বরাতকে ‘মুক্তির মহা উপলক্ষ্য’ হিসেবে মনে করে থাকেন।  সারা বছর ধর্মকর্মের কোনও ধার না ধারলেও এই রাতে পাক্কা মুসল্লি হয়ে যান, নফল ইবাদতে সারা রাত কাটান। আবার এই রাতের পরও তাদের মধ্যে থাকে না ধর্মের কোনও ছাপ।  এই রাতকে তারা ‘বরাত’ বা মুক্তির রাত হিসেবে জানে।  তাদের ধারণা, এই রাতে আল্লাহ ভাগ্য লিখেন।  এই রাতে ইবাদত করলে সব গুনাহ থেকে মুক্তি মিলবে, খুলে যাবে ভাগ্যের দুয়ার।  এজন্য সারা বছর যাই করুক এই রাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে সাধারণ মুসলমানরা।  অনেকে এই রাতের নাম দিয়েছে ‘নামাজের রাত’।  প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হলেও সেগুলো পালনে তাদের মধ্যে তেমন আন্তরিকতা চোখে পড়ে না।  অথচ এই রাতের নফল ইবাদত নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়।  

মূলত আমাদের সমাজে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি উভয়টাই হচ্ছে।  যারা বলছেন ইসলামে শবে বরাতের অস্তিত্ব নেই তারা হাদিসের সূত্রের দুর্বলতার দোহাই দিচ্ছেন।  অথচ হাদিসের মূলনীতি হলো, হাদিস দুর্বল হলেও তা ফজিলতসংক্রান্ত বিষয়ে গ্রহণযোগ্য।  দুর্বল হাদিস দ্বারা শুধু কোনও বিধান আরোপ করা যায় না।  শবে বরাতে যারা ইবাদত বন্দেগি করেন তারা তা ফরজ-ওয়াজিব হিসেবে করেন না, নফল হিসেবেই করেন। তিরমিজি শরিফ ও ইবনে মাজাহ শরিফসহ যেসব কিতাবে এই রাতের ফজিলতসংক্রান্ত একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর সূত্র দুর্বল হতে পারে, তা অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই।  ফজিলতের ক্ষেত্রে হাদিসের সূত্রটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না।  এজন্য শবে বরাতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হঠকারিতা ও ইসলাম সম্পর্কে অযাচিত বাড়াবাড়ি বৈ কিছু নয়।  এ রাতের প্রতি মুসলমানদের যে আবেগ ও বিশ্বাস তার মূল্য দেওয়া উচিত।  অন্তত এই রাতকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় আবেগ কাজ করে।  এই রাতের উছিলায় অনেকে সঠিক পথের দিশা লাভ করেন।

তবে এ কথা সত্য, আমাদের সমাজে শবে বরাত উপলক্ষে অতিরিক্ত ও ইসলামবিবর্জিত যে মাতামাতি করা হয় তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য না। যে আমলের গুরুত্ব যতটুকু সেটা সেই পর্যায়েই রাখা উচিত।  আমাদের সমাজের অবস্থা হলো কেউ ফরজ নামাজ পড়ছে না, প্রকাশ্যে ইসলামবিরোধী কোনও কাজ করছে তাকে খুব খারাপ চোখে দেখা হয় না।  অথচ কেউ শবে বরাতে মসজিদে গেলো না, নফল রোজা রাখল না তাকে অনেক খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয়।  এটা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি।  এই রাতের ইবাদত ঐচ্ছিক বিষয়।  কেউ পারলে করবে না পারলে করবে না।  নফল কোনও ইবাদতকে বাধ্যবাধকতা মনে করা শরিয়তের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়।  আর নফল ইবাদত হবে ব্যক্তিগতভাবে। আনুষ্ঠানিকতা ও হাঁকডাক করে নফল ইবাদতের কোনও মানে হয় না।  এর দ্বারা উপকারের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

শবে বরাতকে কেন্দ্র করে কিছু অযাচিত কর্মকাণ্ডও আমাদের সমাজে ঘটে থাকে। এই রাতে অহেতুক আলোকসজ্জা করা, তারাবাতি জ্বালানো, আতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফোটানো প্রভৃতি গর্হিত কাজ।  এতে অপসংস্কৃতির সঙ্গে যেমন সাদৃশ্য তৈরি হয়, তেমনি ইবাদতেও যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটে।  শবে বরাতের আতশবাজি ও অসংলগ্ন কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বড় দুর্ঘটনাও ঘটে থাকে।  কয়েক বছর আগে রাজধানীর উপকণ্ঠে আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা এবং মিরপুরে বিহারি ক্যাম্পে আগুন দিয়ে দশজনকে পুড়ে মারার ঘটনা এর জ্বলন্ত উদাহরণ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আতশবাজিসহ সবধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা নিষিদ্ধ হলেও প্রতি বছরই কিছু না কিছু ঘটে।  এ ব্যাপারে সবার সতর্ক থাকা উচিত।

শবে বরাতকে কেন্দ্র করে হালুয়া-রুটির একটি প্রচলন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজে চলে আসছে।  এর সঙ্গে ইসলামের কোনও যোগসূত্র নেই।  আপনি চাইলে যেকোনও সময় হালুয়া-রুটি খেতে পারেন, গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করতে পারেন।  কিন্তু এটা শবে বরাতকে কেন্দ্র করে হলে সওয়াব তো হবেই না বরং গোনাহ হবে।  কারণ ইসলাম যা সমর্থন করে না এমন কোনও কাজ সওয়াবের নিয়তে করা গোনাহ।  সওয়াবের নামে নতুন কিছুর প্রচলন করাকে ইসলামের পরিভাষায় বিদাত ও রুসুমাত বলা হয়।  এটা জঘন্য গোনাহের কাজ।  অনেকে না বুঝেই এসব করে গোনাহের ভাগীদার হচ্ছেন।

ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম।  এখানে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি কোনোটাই কাম্য নয়।  শরিয়তে ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের ব্যাখ্যা রয়েছে। ইসলামি পন্ডিতরা সেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন।  স্বাভাবিকভাবেই ইসলামি পন্ডিতদের পরস্পরের মধ্যে মতপার্থক্য ও ভাবনার অমিল থাকতেই পারে।  এটা ইসলামের অন্যতম বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য।  ইসলামে এটাকে দুষণীয় কোনও বিষয় মনে করা হয় না।  এজন্য চার মাজহাবের অনুসারী পাওয়া যায়।  এমনকি এই চার মাজহাবের বাইরে অসংখ্য মুসলমান আছেন।  প্রকৃত অর্থে সবাই উম্মতে মোহাম্মদির অনুসারী।

মূলত ইসলামের মৌলিক কোনও বিষয়ে আলেম-উলামা এবং ইসলামি পন্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য নেই।  সবাই এক আল্লাহ’য় বিশ্বাসী, মোহাম্মদ (সা.)-কে সবাই নবি হিসেবে মানেন; সবার আদর্শ কোরআন ও হাদিস। ইসলামের মৌলিক বিধানের ব্যাপারেও কোনও দ্বিমত নেই।  পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা, হজ-জাকাত এসব ফরজ হওয়ার ব্যাপারে কারও কোনও ভিন্নমত নেই।  তবে এসব বিধান পালনের প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ছোটখাট মতপার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক।  কারণ সবার ভাবনা একরকম নয়।  সবার জ্ঞানের পরিধিও সমান না।  সুতরাং এই মতপার্থক্যকে বড় করে উপস্থাপন করা, নিজের মতকেই একমাত্র সঠিক আর অন্যের মতকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। 

আমাদের সমাজে বহুকাল ধরে শবে বরাত পালিত হয়ে আসছে।  এটা মুসলিম সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  এতকাল পরে এসে এখানে হাদিসের বিশুদ্ধতার মাত্রা খোঁজা অযাচিত বিতর্কের সৃষ্টি করবে।  যারা এটাকে ফজিলতপূর্ণ মনে করবে তারা তাদের মতো করে পালন করবেন।  তবে অবশ্যই শরিয়তের গন্ডির ভেতরে থেকে করতে হবে। আর যারা মনে করছেন এটা গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা উচিত নয় তারা এটা পালন থেকে বিরত থাকতে পারেন।  নফল এই ইবাদত কেউ না করলে কোনও ক্ষতি নেই। তবে এটাকে ইস্যু করে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করা, অনৈক্য ও দলাদলি উসকে দেওয়া কোনও প্রকৃত মুসলমানের কাজ নয়।  কারণ পবিত্র কোরআনে ফিতনা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ঘৃণা করা হয়েছে। এটা জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ আমাদেরকে সবধরনের ফিতনা থেকে রক্ষা করুন।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ