X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিত্যপণ্য মজুত স্বাভাবিক, বিক্রি অস্বাভাবিক

শান্তনু চৌধুরী
০৯ মে ২০১৮, ১৪:২৯আপডেট : ০৯ মে ২০১৮, ১৪:৩২

শান্তনু চৌধুরী প্রতিবার রমজান মাস এলেই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে যেন এক অজানা আতঙ্ক ভর করে। একদিকে সিয়াম সাধনার মাসে নিজেকে পরিবর্তন করার একটা অঙ্গীকার অনেকের থাকে, কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সেই আনন্দটাকে অনেকটাই ম্লান করে দেয় বৈকি! প্রতিবার রোজার আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর একটা হিড়িক পড়ে যায়। সে কারণে অনেকে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারেন না। অনেক সময় কিনে রাখেন বেশি পণ্যও। এবার অবশ্য শুরু থেকে এমন কোনও আভাস ছিল না। কিন্তু সময় যতো যাচ্ছে, রোজা রাখার দিন যতই ঘনিয়ে আসছে পরিস্থিতি একটু বোধহয় পাল্টাচ্ছে। আর সেটাই আতঙ্কের কারণ।
গেলো বছরের শবে বরাতের পর প্রথম দশ দিন অস্থির ছিল ছোলা ও ডালের বাজার। পাইকারি ও খুচরা বাজারে দফায় দফায় দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছিলেন ক্রেতারা। কিন্তু এবারের চিত্রটা একটু ভিন্ন। সংবাদ মাধ্যম বলছে, চট্টগ্রামের বিখ্যাত পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে থেকে গিয়েছিল বেশ কিছু অবিক্রীত ছোলাসহ রমজান মাসে বেশি প্রয়োজন এমন পণ্য। চলতি বছরও আমদানি হয়েছে বিপুল পরিমাণ পণ্য। রাজধানীর অদূরে সাভারের পাইকারি বাজারেরও একই অবস্থা। রমজানে পণ্যের দাম যাতে না বাড়ে সে কারণে বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এবং সরকারের ঊর্ধ্বতনরা দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। সেখানেও যে বিষয়টি উঠে এসেছে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ ও খেজুরের কোনও সংকট হবে না। কেউ যাতে মজুত না করেন সেজন্যও বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, মজুত করলে তা রমজানের পর নদীতে ফেলে দিতে হবে। কারণ, চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি। কিন্তু চোরে কি কখনও ধর্মের কাহিনি শুনে। সেটি ভালোই জানেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তাই তিনি গেলো মাসে এক সভায় অনুরোধ করেছেন বেশ সহৃদয়ে। বলেছেন, ‘সরকার ও ব্যবসায়ী একই পরিবারের সদস্য। আমরা একে অপরের ভাই। রোজার মাসে যেন কোনও দুর্নাম না হয়। সুনাম অর্জন করতে পারি। সেই বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করুন।’ এখন পর্যন্ত অবশ্য সহযোগিতা কিছুটা হলেও অব্যাহত রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে বৈঠকেও ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত করেছেন রমজানে দ্রব্যমূল্য বাড়বে না এবং সংকট সৃষ্টি হবে না। সে হিসেবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাজারদরটা ছিল এমন—কেজি প্রতি ছোলা ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। মসুর দেশি ৭৩ টাকা, নেপালি ৮০ টাকা, ভারতীয় ৪৮ টাকা। ডাবালি ৩৩ ও খেসারি ৪৫ টাকা। কিন্তু ব্যবসায়ীদের আশ্বাসের সঙ্গে যে বাস্তবতার বেশ ফারাক তা যারা নিত্যপণ্য কিনতে যান তারা মাত্রই জানেন। ব্যবসায়ীদের ভাষায় সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ বলছে, গেলোবারের মতো না হলেও বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এমনতিই জিনিসের দাম বেশি, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু রোজা সামনে রেখে সেটা আরো বাড়ছে এবং তা আকস্মিকভাবেই। তার মানে ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিলেও কথা রাখছেন না। একটি জাতীয় দৈনিকে (৮ মে) প্রকাশিত এক রিপোর্টে সেটির সত্যতাও পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটির তথ্য মতে, চিনির দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ২৪০ টাকা, ভোজ্যতেল মণপ্রতি বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ টাকা, রোজা শুরুর আনুমানিক এক সপ্তাহ বাকি থাকলেও চড়া পেঁয়াজের দাম। কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা করে। রসুনও বাড়তি, ছোলার দাম মণপ্রতি বেড়েছে ১৫০ টাকা। এছাড়া বেড়েছে ডাল জাতীয় পণ্যের দামও। ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরের দামও বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। তার মানে হচ্ছে ব্যবসায়ীরা যতোই মন্ত্রী বা মেয়রের সামনে প্রতিশ্রুতির বুলি আওড়াক না কেন, বাস্তবে তারা কথা রাখেননি বা রাখছেন না। আমাদের দেশে যেন এটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, রমজান এলেই পণ্যের দাম বাড়ে। কিন্তু যারা দেশের বাইরে থাকেন তারা মাত্রই জানেন বা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমেও জানা সহজ, পৃথিবীর অনেক দেশে এসব উৎসবে পণ্যের দাম কমে শুধু মানুষের জীবনযাত্রার মান সহজ করতে। সাধারণ মানুষ যাতে ইবাদতের পাশাপাশি উৎসবটা ঠিকমতো পালন করতে পারেন সে চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে উল্টো। অবশ্য সব সময় ব্যবসায়ীদের নানা যুক্তি থাকে। এসব যুক্তিও যে ফেলনা তা নয়। যেমন বন্দরগুলোতে কন্টেনার জট বা লাইটারেজ জাহাজ সংকট ও পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। রমজানে যে পণ্য প্রয়োজন বিশ্ববাজারে সেসব পণ্য স্থিতিশীল থাকলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় পণ্যের দাম বাড়ে।

এসব অভিযোগের সত্যতা থাকলেও একথা ঠিক যে, আমাদের দেশে অতি মুনাফালোভী ও মজুতদার ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি। এদের কারণেও অনেক সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। ব্যবসায়ীরা যে কথা রাখছেন না সেটি হয়তো সরকার ইতোমধ্যে আঁচ করতে পেরেছে। সে কারণে ১৩ মে বাণিজ্যমন্ত্রী আবারো ডেকেছেন ব্যবসায়ীদের। সে বৈঠকের আগে বা পরে কিছু সিদ্ধান্ত অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে যদি রমজানে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে চান। কারণ এসব পণ্যের পাশাপাশি প্রতিদিনের কাঁচাবাজারেও উত্তাপ ছড়াচ্ছে দাম। যেসব পণ্য মজুত রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা বলেছেন তার দাম কেন বাড়ছে তা দ্রুত অনুসন্ধান করে সমাধানে পৌঁছাতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নিত্যদিনকার বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও বাস্তবে সেটি নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে কোনও কোনও টিম হয়তো বাজার পরিদর্শনে যান। কিন্তু সেটি ওই টেলিভিশনে চেহারা দেখানো পর্যন্তই। ব্যবসায়ীরা নিজেদের পরিবর্তন করেন না। মেয়র সাঈদ খোকন ইতোমধ্যে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিংয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। সেই ঘোষণাও যেন ক্ষণিকের না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ হতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা শাস্তি পেলেই অন্যরা সজাগ হবেন। আবার ব্যবসায়ীদের অভিযোগ থাকলে তারও সমাধান করতে হবে। বিশেষ করে স্টোরেজ, বিদ্যুৎ বা গ্যাস সংযোগের মতো বিষয়। এছাড়া পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে জটিলতা থাকলে সেটিও দূর করা উচিত দ্রুত। সেটি নৌপথে, আকাশ পথে আমদানি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আবার চাঁদাবাজি, যেটি কয়েক দফায় হয়ে থাকে।  চাঁদাবাজির অভিযোগও আছে বিস্তর। এসব ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে।

ব্যবসায়ীরা নিজেরাই সহজভাবে পণ্য আনা-নেওয়া করতে পারলে তাদের হয়তো পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রবণতাও কমবে। কারণ, তারা যখন পণ্য বিক্রি করে তখন সমস্ত খরচসহ হিসেব করে বিক্রি করেন। এমনও উদাহরণ দেখা যায়, কোনও কোনও পণ্য উৎপাদিত স্থানে এতই সস্তা যে নষ্ট হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে পরিবহন সংকট, ব্যয় বা যানজট একটি কারণ। সে হিসেবে দেখা যায় ওই পণ্য কিন্তু সেটি শহর এলাকায়, বিশেষ করে ঢাকায় তখনও চড়া দাম। এই বিষয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে। শুধু রমজান এলেই সবকিছু মনিটরিং ব্যবস্থায় আওতায় আনা হবে সেটি বোধহয় ঠিক নয়। কারণ, ১১ মাসের মুনাফা লোভের অভ্যাস একমাসে সহজে পরিবর্তন হবে সেটি ভাবা উচিত হবে না। কাজেই যেকোনও কার্যক্রম, সেটি ভোক্তাদের স্বার্থে হোক ব্যবসায়ীদের স্বার্থে হোক সারা বছরই চালু রাখতে হবে, তবেই সুফল মিলবে। একইসঙ্গে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। পণ্যের দাম নিয়ে বেশি পরিমাণ হতাশ হওয়া থেকে অনেকে পণ্য মজুত করা শুরু করেন। এতে সুযোগ পান কিন্তু ব্যবসায়ীরা। কাজেই সেটি করা যাবে না। একইসঙ্গে বাজার মনিটরিংয়ের কথা, যেটি বারবার বলা হচ্ছে, সেটি যাতে জোরালোভাবে এবং কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে দ্রুত। রমজান এলো বলে। সেই সময় কিন্তু লাগাম টেনে ধরা মুশকিল হবে। মুশকিল হবে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণও। কাজেই যা করার এখনই। সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত। বাস্তবায়নও করতে হবে দ্রুত। তবেই না মিলবে সুফল। 

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ