X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

পদদলিত মানবতা

শান্তনু চৌধুরী
২৪ মে ২০১৮, ১৬:৫১আপডেট : ২৪ মে ২০১৮, ১৬:৫৮

শান্তনু চৌধুরী সম্প্রতি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার গাটিয়াডাঙ্গা এলাকায় যেখানে ইফতার সামগ্রী আনতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ১০ নারীর মৃত্যু হয়েছে, তার পাশের গ্রামটিই আমাদের। কিশোরবেলায় আমরা যখন স্কুলে যেতাম, রমজানের আগে আগে দেখতাম কোনও একটি দিন ওই এলাকার বন্ধুরা স্কুলে আসতো না। পরে জানতাম এলাকায় ধনী বলে পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের বাড়িতে সেদিন ইফতার সামগ্রী বা জাকাত দেওয়া হতো। সেদিন সেখানে অনেক লোকসমাগম হতো।
তিনি নাকি এলাকায় প্রচুর কাজ করতেন। এলাকায় রাস্তাঘাট করে দিতেন। অনেককে প্রতিষ্ঠিতও করে দিয়েছেন বলে শোনা যায়। ছেলেবেলায় এসব গল্প বেশ শুনেছি। কালক্রমে গল্পরা হারিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু ফের ফিরে এলো ইফতার সামগ্রী দিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনায়।
ঘটনার কাছাকাছি ছিল আমার বন্ধু বা স্বজনরা, ছিল এলাকার মানুষও। আসলে কী ঘটেছিল। মুঠোফোনে তারা আমাকে যেটি জানিয়েছেন, কয়েকদিন আগে সেই এলাকায় মেজবানের আয়োজন করেছিলেন উক্ত ব্যক্তি। এরপর রমজানের আগে এক শুক্রবারে জুমার নামাজের সময় প্রতিটি মসজিদে মাইকিং করে জানানো হয়– ১৪ মে ইফতার সামগ্রী, নগদ টাকা ও কাপড় দেওয়া হবে। এতেই বাড়তে থাকে লোকসমাগম। একই সঙ্গে পশ্চিম গাটিয়াডাঙ্গা গ্রামের কাদেরীয়া মুঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার যে মাঠটি, আমার দেখা সেখানে ১০ হাজারের বেশি লোকসমাগম হওয়ার কথা নয়। একই কথা বলেছেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারও। কিন্তু ১৪ মে ইফতার সামগ্রী বিতরণের সময় সেখানে লোকসমাগম হয়েছে ২০ হাজারেরও বেশি। এরপরও আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, সবার জন্যই ইফতার সামগ্রীর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে ছিল নগদ টাকাও। কিন্তু এদের শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়ানোর যে ব্যবস্থা সেটা কেন করা হয়নি তা একটি বড় প্রশ্ন। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যখনই গেট খুলে দেওয়া হয় তখনই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে যায় লোকজন। কারো বাধা তারা মানেনি। যারা গরিব, জাকাত বা ইফতার সামগ্রী নিতে আসবে তারা নিয়ম মানবে না, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, তাদের হয়তো মনে হবে, দ্রুত বুঝি দানসামগ্রী ফুরিয়ে যাবে। আবার আরেকটি বিষয়ও ঠিক, অপ্রাপ্তির বেদনা থেকে এদের মধ্যে লোভ-লালসাও একটু বেশি। সে কারণে টাকা নিয়ে আয়োজকরা মসজিদে ঢুকে গেলে সেখানকার কাচও ভেঙে ফেলেন অনেকে। তাছাড়া এসব আয়োজনে যেটি হয়, দুই বা তিনবার লাইনে দাঁড়িয়ে নেওয়ার প্রবণতা থাকে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যেটি সত্য হয়ে ওঠে সেটি হলো মৃত্যু। এতো বড় আয়োজন, অথচ প্রশাসন বা স্থানীয় কোনও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তারা তৈরি করলো না কেন? যদিও ওই প্রতিষ্ঠানটির সিইও গণমাধ্যমে দাবি করেছেন, তাদের একশ’জন নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী এবং ৭০-৮০ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছিলেন। ছিল একটা মেডিক্যাল টিমও। একই সঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রশাসন সেটা বলছে না। প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের গাফিলতির জন্যই ইফতার সামগ্রী নিতে এসে অসহায় মানুষগুলোকে প্রাণ দিতে হয়েছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এমনকি প্রাণহানির ঘটনার পরও তারা ইফতার সামগ্রী বিতরণ বন্ধ করেনি। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গিয়ে এই কার্যক্রম বন্ধ করার আদেশ দেন। এই বর্ণনা প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাকে জানিয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমগুলোও তা-ই বলছে। সাতকানিয়ার ইউএনও মোহাম্মদ মোবারক হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, আয়োজক প্রতিষ্ঠান এত বড় একটি আয়োজনের খবর তাদের অবহিত করেনি। তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু ২০১৫ সালে রমজানে ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ২৭ জনের মৃত্যুর পর পুলিশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাকাত বা ইফতার দেওয়ার ক্ষেত্রে বা এ ধরনের আয়োজনের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে।

এরই মধ্যে সাতকানিয়ার ঘটনায় মানুষ আরো ক্ষিপ্ত এই কারণে, প্রথমে তারা ঘটনাটি নিয়ে লুকোছাপা করেছে, একই সঙ্গে হাজির করেছে ‘হিটস্ট্রোক’ তত্ত্ব। এটা ঠিক যে মানুষগুলো ১৩ মে রাত থেকে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতালের কোনও ডাক্তারও বলেননি যে হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন তারা। তাহলে এই তত্ত্বের মানে কী? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার রয়েছে, এরা নাকি পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও ‘ম্যানেজ’ করার তালে ছিল।

বাংলাদেশে কিন্তু এমন জাকাত বা ইফতার আনতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। চট্টগ্রামে রোজা ও ঈদের আগে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উপলক্ষে আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে দুস্থদের মধ্যে দানের টাকা ও বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণের রেওয়াজ রয়েছে ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে। এছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে মেজবানে দাওয়াত দিয়ে পুরো গ্রামের মানুষকে খাওয়ানোর রেওয়াজও পুরনো।  এই আয়োজক প্রতিষ্ঠানটির জাকাত নিতে এসে ২০০৫ সালের অক্টোবরে সাতকানিয়ায় পদদলনে আটজনের মৃত্যু হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ১৯৯০ সালে জাকাত নিতে গিয়ে পাহাড়তলীতে একটি বিড়ির গুদামে দম বন্ধ হয়ে ৩৫ জন মারা গিয়েছিল, আহত হয়েছিল শতাধিক। ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনার মতো আরো একটি ঘটনা ঘটেছিল নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী পুণ্যস্নানে। সেই সময় পদদলিত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়। ১৯৮৯ সালের ৫ মে চাঁদপুরে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা যান ১৪ জন। ১৯৮৭ সালের ২৩ মে ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় সরকারিভাবে জাকাত দেওয়ার সময় ব্যাপক লোকসমাগম হয়। একপর্যায়ে জনগণ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এ সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় মধ্যে পড়ে ৪ জন মারা যান। ১৯৮৩ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জাকাতের টাকা নিতে গিয়ে ভিড়ের চাপে পড়ে ৩ শিশু মারা যায়। ১৯৮০ সালে ঢাকার জুরাইনে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। রাজধানীর ফকিরাপুলে একটি ভবনে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে চার নারী মারা যান। গত বছর ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানির মেজবানে ভিড়ের মধ্যে পদদলিত হয়ে মারা যান ১০ জন।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমাদের দেশ। মধ্যম আয়ের দেশ। উন্নয়নশীল দেশ। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান সংকট নেই বলে প্রচার করে থাকেন সরকারের হর্তাকর্তারা। এরপরও কেন ক্ষুধা বা পরার জন্য এতো হুড়োহুড়ি। এতো এতো মৃত্যু। তারপরও কেন আমরা শিক্ষা নেইনি। আমি গরিব মানুষগুলোর দোষ দেখি না। নিশ্চয় অভাব তাদের গ্রাস করেছে বলেই না স্বভাব খারাপ হয়েছে। জীবন বাজি রেখে দুমুঠো আহারের সন্ধানে ছুটছেন। একটু ভালোভাবে বাঁচার আশায় বুক বাঁধছেন। কিন্তু যারা তাদের সেই মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছেন তাদের কি বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে? ইতিহাস বলছে, একটি বিড়ির ফ্যাক্টরিতে ৩৫ মানুষ হত্যাকাণ্ডসহ এমন মৃত্যুর কোনোটিরই বিচার হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যে আমাদের পেয়ে বসেছে সেখান থেকে বেরুতে পারছি না আমরা।  তাই এভাবে মানুষ মারতে কেউ ভয় পায় না। জানে, ওদের রক্ষার জন্য ওপরতলার মানুষ আছে। মানুষ মারা গেলে তার মূল্য নির্ধারণ হয়ে যায় হাজার বা লাখ টাকা। আহতরা ক্ষতিপূরণ পান আবার কারো কারো চাকরির আশ্বাসও থাকে। কিন্তু দায়ীদের কিছুই হয় না। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়, কঠোর হতে হবে প্রশাসনকে। রমজানে আরো অনেক অনেক ইফতার সামগ্রী বা জাকাত দেওয়ার আয়োজন হবে। সেটি হতেই পারে, কিন্তু এর কারণে যেন নিরীহ ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে মরতে না হয় সেদিকে কঠোর নজর রাখতে হবে। গরিব মানুষ আইনকানুন বা লাইন ধরার শৃঙ্খলা বুঝবে না। তাদের নিরাপত্তার জন্য সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে বা যারা এই ধরনের আয়োজন করবেন, তাদেরকে। পুণ্য অর্জন বলি আর প্রচারের তরিকা যাই বলি না, কোনও সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি যেন আর খেলা না হয়। এই বিষয়ে বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে বেশি। এই বছর ভোটের বছর। রমজানজুড়ে বা ঈদের সময় বড় বড় নেতারা চাইবেন এলাকার জনগণের কাছাকাছি থাকতে। তাদের জন্য জাকাত বা ইফতারের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সেটি যাতে সুষ্ঠুভাবে বিলি-বণ্টন হয় সে দায়িত্বও কিন্তু তাদের নিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করতে হবে সবার আগে। প্রয়োজনে প্রশাসনের সহায়তা চাইতে পারে অথবা অনুমতি সাপেক্ষে নিজেদের স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে কাজটি করাতে পারেন। মহৎ উদ্দেশ্যে দেওয়া জাকাত বা ইফতার সামগ্রী যেন অন্যের সারা জীবনের কান্নায় পরিণত না হয় সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। নইলে সুনামের চেয়ে দুর্নাম হবে বেশি। ভালো করতে গিয়ে মন্দ বয়ে বেড়ানোর কী প্রয়োজন। নিয়ম মেনে সুচারুরূপে সম্পন্ন করার মাঝেই মহত্ত্ব। মানবতা পদদলিত হওয়ার পর সেটিকে অর্থমূল্যে কিনতে চাওয়ার মধ্যে কোনও মহত্ত্ব নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ