X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা গানের নানা বাঁকে

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
২৬ মে ২০১৮, ১৪:০৯আপডেট : ২৬ মে ২০১৮, ১৬:৫১

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান শুরু করবো ভেবেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ দিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রমানস বোঝার প্রয়োজনে কিছু ভিন্ন বিষয় আবশ্যিকভাবে এসে পড়ে। আমরা চর্যাপদে দেখেছি এমন এক সান্ধ্যভাষা, যার আড়াল দিয়ে সাধক তার সাধনতত্ত্ব প্রকাশ করতেন। তারই এক বিশাল বিপুল রূপ আমরা দেখতে পেলাম বাউল-ফকিরি গানে। বৈষ্ণব বাউল অথবা সুফি ফকির সাধকদের সাধনতত্ত্ব আমরা বহু উপমা-রূপকের আড়ালে প্রকাশ করতে দেখি। এই ভাষা ও এর মূল অর্থ দীক্ষা নেওয়া বাউল বা ফকির ছাড়া আর কারও কাছেই খুব সহজবোধ্য নয়। এসব গানে ব্যবহৃত বহু শব্দই তার আভিধানিক অর্থের অনুরূপ নয়। এর মূল কারণ ছিল, তারা আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব ও মানবধর্ম বলতে যা বুঝতেন এবং বোঝাতে চাইতেন, তা ছিল সব প্রচলিত ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাদের ‘ওজুদে মজুদ সবই’, অর্থাৎ মানবদেহের মধ্যেই সারাবিশ্ব রহস্য, স্রষ্টা-সৃষ্টি সম্পর্ক সবই বিদ্যমান, এটা কোনও ধর্মশাস্ত্রই মেনে নেয়নি। ফলে এই সহজিয়া সাধকেরা সব ধর্মীয় শাস্ত্রবাদীদের দ্বারা লাঞ্ছিত, এমনকী নিহতও হয়েছেন।
ফার্সি সুফিবাদী সাধকেরা যেমন, শরিয়তি হিংস্রতা থেকে বাঁচার জন্যে প্রতীকী ভাষার আশ্রয় নিয়েছিলেন, বাংলার বাউল-ফকিরদেরও তাই করতে হয়েছে সংঘাত এড়ানোর জন্যে। সুফিবাদের জন্ম খিলাফতের সময় থেকেই, অর্থাৎ অন্তত তেরো শ’ বছর আগে। আমাদের চর্যাপদের জন্ম তার শ’ দুয়েক বছর পরেই। এ থেকে এটাই বোঝা যায় যে, ভাববাদী সাধকদের সঙ্গে, বিশাল বস্তুবাদী সমাজের সংঘর্ষ চিরকালীন। মানুষকে একটি শৃঙ্খলা অথবা শৃঙ্খলে বাঁধার প্রচেষ্টায় যত কড়াকড়ি আরোপিত হয়েছে, ভিন্নমতের সাধকদের ততবেশি গোপনীয়তার আশ্রয় নিতে হয়েছে।

লালন সাঁইজিকে সাধারণভাবে বাউল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাউল ও বৈষ্ণব যে এক নয়, তা বোঝাতে, দুদ্দুশাহকে গানের ভেতর দিয়ে তা প্রকাশ করতে হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, লালন সাঁইজি তার সমগ্র রচনার ভণিতায় একবারও নিজেকে বাউল বলে উল্লেখ করেননি। বরং বহু গানের ভণিতায়, ফকির লালন অথবা লালন ফকির হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তা হলে কি বাউল ও ফকির এক নয়? আসলে, লালন সাঁইজি প্রচলিত ধর্মভেদ, জাতপাতের বিচার, আশরাফ, আতরাফ ইত্যাদি সব মুছে দিয়ে, মানুষমাত্রেই এক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।  আর বলতে চেয়েছেন, এই মানুষেই সব বর্তমান। তাহলে কি তিনি ধর্মদ্রোহী ছিলেন? তাই যদি হবেন তবে—আল্লাহতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্ব, গৌরতত্ত্ব কেন আসবে তাঁর গানে? তবু সবকিছু ছাড়িয়ে, আত্মতত্ত্বই তাঁর গানের অথবা সাধনের প্রধান বিষয়।

‘আপন ঘরের খবর নে না’, বা ‘আপনারে চিনতে পারলে রে, যাবে অচেনারে চেনা’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ এই সব অতিপ্রচলিত গানগুলো বিশ্লেষণ করলেই, আত্মা ও পরমাত্মার মিলনের যে পথ অনুসরণ করেছেন, তা অনেকাংশে বোঝা যাবে। তার সাধনপদ্ধতি আমার আলোচ্য বিষয় নয়। আমার আলোচ্য বিষয় সেই লালন সাঁইজিকে নিয়ে, যার গানের বাণী শুনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলে উঠেছিলেন, ‘কে এই নিরক্ষর মহাকবি?’

রবীন্দ্রনাথের ওপর লালনের প্রভাব পড়েছিল, এ কথা অনেক বিজ্ঞজন আলোচনা করেছেন। হয়তো বা ছিলও। কিন্তু আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের গভীর গোপনে আজন্ম এক বাউলচেতনা সুপ্ত ছিল। এটা নিয়েই পরের পর্বে লিখতে চাই।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ