X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মহাসড়কের মহাদুর্ভোগ কাটবে কি?

শান্তনু চৌধুরী
০৫ জুন ২০১৮, ১৫:৫৩আপডেট : ০৫ জুন ২০১৮, ১৫:৫৫

শান্তনু চৌধুরী প্রতিবছরের মতো এবারো ঈদের আগে আগে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ছুটছেন এখানে-সেখানে। ভাঙাচোরা সড়ক মেরামতের জন্য তদারকি করছেন। কারো ছুটি বাতিল হচ্ছে, কোথাও ধমক, ভয় বা শাসানিও চলছে। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমগুলোকেও অনুরোধ জানিয়েছেন, নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করে যাতে কারো মনে ভয়ভীতি সৃষ্টি না করে। এবার সড়ক পথে যাত্রা নির্বিঘ্ন হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এই যে ছোটাছুটি, বিশেষ করে ঈদ যাত্রার আগে, এর সবই কিন্তু সাধারণ মানুষ যাতে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদটা আনন্দের সঙ্গে কাটাতে পারে সে কারণে। কিন্তু মহাসড়কের যে মহাদুর্ভোগ সেটা কি এই কয়দিনে কাটবে? কারণ এই দুর্ভোগ তো আর একদিনের নয়।
আমরা উৎসবপ্রিয় জাতি। যেকোনও উৎসবে পরিবার-পরিজন নিয়ে মেতে উঠতে ভালোবাসি। তাই নাগরিক জীবনে যাদের ব্যস্ততা, সময় বার করার মতো সুযোগ যাদের হয় না তারা অন্তত ছুটির সময়গুলোতো ফিরে যেতে চাই আপন আলয়ে। শেকড়ের কাছে, নাড়ির টানে। সেটাও বলা হয় ঈদযাত্রায় ‘নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা’। তাই এই সময়টা এলেই সড়ক-মহাসড়কের ভোগান্তির কথাগুলো বেশি করে আলোচনায় আসে। অন্য সময়েও যে সড়ক মহাসড়কে যাত্রা খুব একটা ঝঞ্ঝাটহীন হয় তা নয়। কিন্তু ঈদের ছুটি সবার, উৎসবের ছুটি, দীর্ঘ ছুটি। সে কারণে মহাসড়কে যাত্রীর চাপ থাকে বেশি। তাড়া থাকে বেশি। আর এতে করে যদি যাত্রাপথে বাধাবিঘ্ন আসে সে যাত্রার ধকল সওয়া প্রায় অসম্ভব-ই হয়ে ওঠে। খুশির সেই যাত্রা হয়ে ওঠে বিষময়। মন্ত্রী, সচিব বা রাস্তায় নিয়োজিত ঠিকাদাররা যতই বলুন না কেন যাত্রা নিব্রিঘ্নে হবে, কিন্তু বাস্তবে তেমন নমুনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিকের রিপোর্ট বলছে, এশিয়ায় দ্বিতীয় নিকৃষ্ট সড়ক বাংলাদেশে। নেপালের অবস্থা শুধু আমাদের চেয়ে খারাপ। সড়ক উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও ১ হাজার ৬০ কিলোমিটার মহাসড়কের অর্ধেকই বেহাল। আর এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে রাজনৈতিক ঠিকাদার, অতিরিক্ত মালবাহী যান ও দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাবে। সড়ক ও জনপথের অধীনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এগুলো জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক-এই তিন ভাগে ভাগ করা আছে। এরমধ্যে জাতীয় মহাসড়ক তিন হাজার ৮১৩ কিলোমিটার। এর বাইরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) অধীন সড়ক আছে তিন লাখ কিলোমিটারের বেশি; যার সবই গ্রামীণ সড়ক। বাংলাদেশে মানুষ মূলত মোট যাতায়াতের ৮৮ শতাংশই করে সড়কপথে। বাকিটা রেল, নৌ ও আকাশপথে হয়ে থাকে। তার মানে সড়কপথের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। ইতোমধ্যে সড়ক, নৌ ও রেলপথের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। ঈদ মৌসুমে রাজধানী ছাড়ে আনুমানিক এক কোটি মানুষ, যার বড় একটি অংশ ভ্রমণ করেন সড়ক পথে। কিন্তু গেলো কয়েকদিনের সংবাদমাধ্যম যেসব রিপোর্ট প্রচার বা পরিবেশন করেছে, তাতে যাত্রীদের জন্য তেমন সুখবর নেই বললেই চলে। এরমধ্যে আবার বৃষ্টির মৌসুম। টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিবেদনে দেখলাম, কয়েকজন চালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ‘সড়ক নয়, মনে হচ্ছে কৃষি জমির ওপর দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছি।’ তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা থেকে রংপুর পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৩০৭ কিলোমিটার। যমুনা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে রংপুরের দিকে যাত্রা করলে ২১৫ কিলোমিটার পথই দুর্ভোগ। প্রায় তিন বছর ধরে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। সিরাজগঞ্জের নলকা থেকে চান্দাইকোনা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলায় পড়েছে ৯৭ কিলোমিটার সড়ক। এর পুরোটাই খানাখন্দে ভরা। বিশেষ করে গাইবান্ধা অংশের অবস্থা খুবই খারাপ। দৌলতদিয়া থেকে খুলনা পর্যন্ত মহাসড়কের অবস্থাও ভালো না। ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব ২৪৪ কিলোমিটার। এরমধ্যে প্রায় ৯০ কিলোমিটার অংশ ভাঙাচোরা। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার অংশে বেশি দুরবস্থা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে গত বছর। ২৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়কে এখন খানাখন্দ নেই। তবে মেঘনা ও গোমতী সেতু দুটি দুই লেনের এবং দুই পাশের সড়ক চার লেনের বলে যানজট সেখানে নিত্যদিনের। এছাড়া কুমিল্লা ও ফেনী অংশে দীর্ঘ যানজট লেগেই থাকে। সীতাকুণ্ড ও মীরসরাইয়েও রয়েছে খানাখন্দ। কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের বেহাল অবস্থার কারণে যানবাহন চলাচলে অযোগ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্ট বলছে, খুলনা অঞ্চলের সব সড়ক ও মহাসড়কের বেহাল দশা। নিয়মিত সংস্কার না হওয়ায় মাগুরা-ঝিনাইদহ-যশোর-খুলনা মহাসড়ক, যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক ও খুলনা-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কে খানাখন্দ ও গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এসব সড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। এ কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। খানাখন্দে ভরা এসব সড়কে ঈদযাত্রায় ভোগান্তি আরো বাড়বে। তার মানে এই মহাসড়কগুলোতে কোথাও যে নির্বিঘ্নে গাড়ি চলবে সেটা আপাতত বলা যাচ্ছে না। কোথাও উঠে গেছে পিচ। কোথাও হয়ে গেছে বড় বড় গর্ত। সব মিলিয়ে মহাসড়কের বেহাল অবস্থায় কেবল যে দুর্ভোগই সঙ্গী তা নয়, এর ফলে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে বেশি, যানবাহনের আয়ু কমছে, ঘটছে দুর্ঘটনা। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব পড়ছে সার্বিক অর্থনীতিতেও। যেটা মাত্র কয়েকদিন আগে ফেনীর দীর্ঘ যানজটের কারণে সমস্যায় পড়েছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা।

তাহলে এতো এতোর টাকার সড়ক উন্নয়নের বরাদ্দ, মন্ত্রীর পরিদর্শনের পাশাপাশি হুমকি ধমকিতেও কেন কাজ হচ্ছে না? এর সঙ্গে আমাদের অনৈতিক মানসিকতারও যোগসাজশ রয়েছে। যেহেতু সড়কপথে মানুষ বেশি যাবে সে কারণে প্রায় দশ-বিশ বছরের পুরনো গাড়িকে মেরামত করা হচ্ছে রাস্তায় নামাতে। সম্প্রতি বিআরটিএ এসব গাড়ির কারখানায় গিয়ে অভিযান চালিয়েছে। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী নিজে এই অভিযানে থেকে বলেছেন, নিয়মিতভাবে তদারকি করা হবে। ফিটনেসবিহীন কোনও গাড়ি নামতে দেওয়া হবে না। কিন্তু চোর কি ধর্মের কাহিনি শুনবে। তাই নজরদারি দিতে হবে, হতে হবে কঠোর। সেটা আইন প্রয়োগ থেকে শুরু করে যান-মালের নিরাপত্তার প্রতিও। তাহলে হয়তো কিছুটা স্বস্তির হবে ঈদযাত্রা। লক্কড় -ঝক্কর মার্কা ও নছিমন করিমন মহাসড়কে না চলার কথা কিতাবে লেখা থাকলেও বাস্তবে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে এসব গাড়ি। ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ হয় না প্রায় ক্ষেত্রেই। অর্থের বিনিময়ে পরের গাড়িকে আগে বা ট্রাফিক সিস্টেম না মানার অভিযোগও রয়েছে। যেহেতু গাড়ির চাহিদা বেশি তাই অদক্ষ চালকও গাড়ি চালান। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকেই যায়। ঈদের আগে যে কয়দিন সময় রয়েছে এরমধ্যে যতটুকু সম্ভব মেরামত করে ঈদযাত্রার সময় হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা যাতে কাজ করতে পারে সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সড়ক দখলমুক্ত রাখতে হবে। সড়কে চাপ কমানোর জন্য পোশাক কারখানাগুলোতে ধাপে ধাপে ছুটি দেওয়া যেতে পারে। মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে ভোগান্তি এড়াতে। অতিরিক্ত টাকার লোভে যেখানে সেখানে যেন গাড়িগুলো যাত্রী উঠাতে না পারে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। বারবার সড়ক নির্মাণ বা ত্রুটি সারানোর পরও যেহেতু সমস্যা থেকে যাচ্ছে, এর কারণ নিশ্চয়ই রয়েছে। সড়ক নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদার, উপকরণ ও নজরদারিতে ঘাটতির কারণে কোনও সড়কই সুস্থ থাকছে না। দ্রুত সড়ক ভেঙে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে অপেশাদার ঠিকাদারেরা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক নির্মাণ বা মেরামতের কাজ পেয়ে যাচ্ছেন। সড়কে পুরনো উপকরণ-প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও তা ভারি যানবাহনের চাপ নিতে পারে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সবকিছুর আগে যেটা বেশি জরুরি সেটা হলো কঠোর নজরদারি। মহাসড়কের মহাদুর্ভোগ হয়তো সহসাই কাটবে না। কিন্তু ভোগান্তি কিছুটা কমাতে হলে এই বিষয়গুলোতে আপাতত কঠোর হতে হবে। তাহলে অন্তত ঈদযাত্রা কিছুটা নির্বিঘ্নে হতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক   

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পেছন থেকে মোটরসাইকেলে ধাক্কা, ছিটকে পড়ে কাভার্ডভ্যানের চাপায় চালক নিহত
পেছন থেকে মোটরসাইকেলে ধাক্কা, ছিটকে পড়ে কাভার্ডভ্যানের চাপায় চালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ