X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট ও এসডিজি লক্ষ্য ‘নাইন-সি’ অর্জন

রেজা সেলিম
০৬ জুন ২০১৮, ১৭:৫১আপডেট : ০৬ জুন ২০১৮, ১৭:৫৩

রেজা সেলিম বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত আমাদের দেশের ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৮৬ মিলিয়ন (৮৫.৯১) যার মধ্যে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা হলো ৮০.১৫ মিলিয়ন, ওয়াইম্যাক্স গ্রাহক ০.০৮৭ মিলিয়ন, আইএসপি/পিএসটিএন গ্রাহক ৫.৬৮ মিলিয়ন। বিটিআরসি’র দেওয়া ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘গ্রাহক’ তারাই, যারা বিগত ৯০ দিনের মধ্যে অন্তত একবার ইন্টারনেট ‘এক্সেস’ করেছেন।
বিটিআরসি’র এই তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৫৪ ভাগ মানুষের এখন ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ আছে। দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর প্রকৃত সংখ্যা জানা না থাকলেও পূর্বোক্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে এটা এমনিতেই স্পষ্ট যে বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ চাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। একটা বিতর্ক হতে পারে এই নিয়ে যে যেহেতু প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮০.১৫ মিলিয়ন বা মোট জনসংখ্যার ৫০ ভাগই মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী, ফলে একাধিক সিমকার্ডের গ্রাহক হলে ও বিগত ৯০ দিনে একবার ‘এক্সেস’ নিয়ে থাকলে ইন্টারনেট গ্রাহকদের মধ্যে প্রকৃত ব্যবহারকারীর সংখ্যা কিছুটা কম হতে পারে। অপরদিকে আমাদের জানা বা বুঝা দরকার তাহলে কি মোবাইল ফোনের ইন্টারনেটের বাইরে মাত্র ৫.৭৬ মিলিয়ন (দেশের মোট জনসংখ্যার ৩.৫ শতাংশ) গ্রাহক, যারা ব্রডব্যান্ড বা মোবাইল ফোনের তুলনায় কিছুটা নির্ভার ও ভালো গতির ইন্টারনেট গ্রাহক? তাহলে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা নিয়ে আপাত আমরা কিছুটা সন্তুষ্ট হলেও প্রকৃত ব্যবহারকারীর সংখ্যা আমাদের জানা দরকার ও এর বাইরে দেখা যাচ্ছে ওয়াইম্যাক্স-সহ ভালো গতির নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সেবার আওতায় আছে খুবই কম ব্যবহারকারী, যা আমাদের জন্যে বিশেষ সুখবর নয়। তারপরও এসব মিলিয়ে যে গ্রাহক সংখ্যা আমরা পাচ্ছি বৈশ্বিক পটভূমিতে উপস্থাপিত পরিসংখ্যান হিসেবে তা একেবারে মন্দ নয়, কিন্তু তথ্যের ‘গ্রাহক’ থেকে ‘প্রকৃত ব্যবহারকারী’ বের করে নিলে সে হিসাবটা বাংলাদেশের জন্যে আশাব্যাঞ্জক নয়। কিন্তু এসডিজি লক্ষ্য ‘নাইন-সি’ অর্জনে আমাদের উপায় আছে, সে আলোচনায় পরে আসছি।  

২০১০ সালে জাতিসংঘের গড়া ‘ব্রডব্যান্ড কমিশন ফর সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’, যার ব্যবস্থাপনা করে আইটিইউ ও ইউনেস্কো, সেপ্টেম্বর ২০১৭ মাসে তাদের বিশ্ব ইন্টারনেট পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে একটি উদ্বেগের কথা আছে, যা বাংলাদেশের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেদনের ৭’র পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ২০১৬ সালের মোবাইল বা ব্যক্তিপর্যায়ের ইন্টারনেট ব্যবহার এসব দেশের জনসংখ্যার ৩৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৭ সালের শেষে এসে ৪১.৩ শতাংশ হওয়ার প্রক্ষেপণ রয়েছে, কিন্তু তার অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ অর্জনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অন্য এক অংশে উল্লেখ আছে, সে তুলনায় সামর্থ্যমূল্যে ভালো গতির নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট বৃদ্ধিও ঘটছে না, যা ব্যক্তিপর্যায়ের মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিসংখ্যানকে সমৃদ্ধ করতে পারে। ফলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই শ্লথ হারে যদি ইন্টারনেট সেবা সম্প্রসারণ ঘটে তা হলে ২০২০ সালের মধ্যে এসডিজি-র লক্ষ্য নাইন-সি (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা এবং ২০২০ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ইন্টারনেটে সর্বজনীন ও মূল্যসাশ্রয়ী প্রবেশাধিকার প্রদানে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হওয়া) অর্জন করা সম্ভব হবে না।

কেন হবে না এই নিয়ে আমরা চিন্তা করতেই পারি। কিন্তু আমাদের দেশের পরিসংখ্যান যদি বলে ব্যক্তি বা মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা বেশি বা এর বাজার অন্যরকম ইন্টারনেট সেবা থেকে অনেক বেশি ছাড়িয়েছে, তাহলে এই নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার কেমন করে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করে নিতে পারি। সবগুলো দেশের তুলনায় বা গড় হারে আমরা তো এগিয়েই আছি, তাহলে আমাদের অর্জনের দুর্বলতা কোথায়? একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব সংযোগ-পরিসংখ্যান আমাদের সঠিক নির্দেশনা দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার আর ভোক্তার সামর্থ্য দুটোই যেন অনলাইন অভিজ্ঞতাকে চরমে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

২০১৬ সালে ফেসবুক ব্রিটিশ সংস্থা ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)’-কে কমিশন করে ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে ৪৬টি সূচক পরিমাপ গবেষণা করেছে। বিশ্বের ৭৫টি দেশে পরিচালিত এই গবেষণার ফলাফল আমলে নিয়ে ব্রডব্যান্ড কমিশন প্রতিবেদন বলছে, এই ৭৫ দেশের ৯৪ শতাংশ মানুষ টুজি সিগন্যাল রেঞ্জের মধ্যে আছে, যার মাধ্যমে কার্যকর ইন্টারনেট সুবিধা বলতে যা বুঝায় তা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বিশ্বের ৭৬ শতাংশ মানুষ এখন থ্রিজি আওতায় আছে ও ৪৩ শতাংশ মানুষ ফোরজি সুবিধার আওতায় এসেছে। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে কানেক্টেড বা সংযুক্ত দেশগুলোরই একটি বড় জনগোষ্ঠী এখনও নিম্নমানের ইন্টারনেট ব্যবহারের আওতায় রয়েছে। এর পরিধি না বাড়াতে পারলে বা ক্রমান্বয়ে টুজি থেকে থ্রিজি-ফোরজি সম্প্রসারণ না হলে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোই উপযুক্ত সংযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবে। 

বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছায় ইতোমধ্যে দেশে ফোরজি চালু হলেও আমরা সবাই জানি এর সেবা এখনও সীমিত ও নিশ্চিত মানসম্পন্ন নয়। বিটিআরসি ফোরজি গতিকে কী মাত্রায় রাখা বেঁধে দিয়েছে বা মোবাইল কোম্পানিগুলো সে নির্দেশনা স্বচ্ছভাবে মেনে চলছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়।

আইটিইউ-র যে পরিসীমা তা অনুসরণ করে বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেট যদি যথাযথ গতির ফোরজি ইন্টারনেট নিশ্চিত করে তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিটিআরসি এই গতি পরিসীমা বেঁধে দিয়ে দেশের প্রকৃত গ্রাহকদের কখন নিশ্চিত করবে? ঘরে ঘরে ভালো গতির ইন্টারনেট এখনই নিশ্চিত করা সম্ভব যদি আমরা একটা ফোরজি/জিএসএম রাউটার লাগিয়ে নেই, বাড়িসুদ্ধ সবাই তা ব্যবহার করতে পারে। প্রান্তিক পর্যায়ের স্কুলগুলো, কলেজগুলো, হাসপাতালের সব ক’টি বিভাগ বা যারা ঘরে বসে আয় করতে চান সে সব কাজই তো সম্ভব। খুঁজে পেতে দেখলাম মোবাইল কোম্পানিগুলো এসব কাজে তেমন একটা মার্কেটিং করছে না। এক বাড়িতে ৫ জন মানুষ থাকলে তাদের প্রত্যকের কাছে সিমকার্ডের সঙ্গে ডাটা/ইন্টারনেট বিক্রি করাই এদের উদ্দেশ্য, আমাদের তারা বুঝতেই দিচ্ছে না যে একজনের সিমকার্ডে ডাটা কিনলে বাড়িসুদ্ধ সকলের তা কাজে লাগবে। পথে-ঘাটে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে যাদের দরকার হবে, ছোট একটা ডাটা প্যাকেজ কিনে রাখলেই হলো, প্রয়োজন মতো সেটা ব্যবহার করা যাবে। কে বলেছে আমাদের কোনও উপায় নেই!   

ফলে আমরা বুঝতে পারছি ডিজিটাল বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার যে সরকারি অঙ্গীকার তা কিন্তু আমাদের দুয়ারে পৌঁছেই আছে। এদের যে ইন্টারনেট তা তো খুচরা দোকানির মতো, সরকারের কাছ থেকে পাইকারি দরে কিনে সে দেশের নানান জায়গায় তা প্যাকেজ করে খুচরো দামে বাজারে বিক্রি করছে। যেমন সরকার নিজে বা অন্য আমদানিকারকদের দিয়ে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে আর তা পরিবেশক নিয়োগ করে দেশের নানা প্রান্তে বিক্রি করে। এখানেও তো তাই-ই হচ্ছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ, যেমন সরকার সেসব পণ্যের গুণাগুণ দেখে, মাপে কম দিচ্ছে কিনা তা দেখে বা ভেজাল দিচ্ছে কিনা তা-ও দেখে, ইন্টারনেটের বাজারে বিশেষ করে মোবাইল ইন্টারনেটের বেলায় সে কাজটা হচ্ছে না। ফলে সে আমাকে মাপে কম দিয়ে, বা ঠিকমতো গতি না দিয়ে বা ফাঁকিঝুকি করে কী করছে তা ভালো করে না দেখলে আমরা কেমন করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবো? ‘প্রকৃত গ্রাহক’ পেতে হলে আমাদের তো একটা কার্যকর পথ খুঁজে বের করে নিতেই হবে, আর তা তো তৈরি হয়েই আছে। এসডিজি-তে আমরা প্রায় সবক্ষেত্রে অনেক ভালো করেছি কিন্তু এরকম কাজে আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো?

গ্রামে গ্রামে ব্রডব্যান্ড পেতে আমরা অনেকদিন যাবৎ দেনদরবার করেছি। লেখালেখি করেছি, এখানে ওখানে ধরনা দিয়েছি। তদবির করে করে আমরা যখন ক্লান্ত তখন দেখলাম সরকার সাহস করে ফোরজি পর্যন্ত এনে দিয়েছে, কিন্তু তার সুবিধা ওই কয়েকটি খুচরো বিক্রেতা কেন নিজেদের বাণিজ্যের স্বার্থে শুধু ব্যবহার করবে? তাদের তো কোন-ই কৃতিত্ব নেই। ইন্টারনেট তো এনেছে সরকার, মোবাইল কোম্পানি শুধু বিক্রি করে দেবে, এতে তাকে কেন আমরা বাহবা দিচ্ছি। এটা আমাদের ভুল।

এটা খুব করে ভালো করে বুঝে নিতে হবে আমাদের কিন্তু ঘরে ঘরে এখন ইন্টারনেট আছে। তাকে সক্রিয় করতে হবে। বড় বড় প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে হোক কিন্তু সেগুলো অনেক ব্যয়বহুল ফলে সরকারের কষ্ট হচ্ছে। সেসবের পূর্ণ সুবিধা আমাদের ঘরে না আসা পর্যন্ত, এখন যদি আমরা সারা দেশে ফোরজি’র প্রকৃত সেবা নিশ্চিত না করি আমরা যেটুকু পিছিয়ে থাকবো শেষে শুরু করতে হবে ওখান থেকে। তখন ব্রডব্যান্ড কমিশন বা দুনিয়ার নানা উন্নতির সূচকের গবেষণায় দেখবো আমরা অন্যদের পেছনেই পড়ে আছি। 

লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
ঝুঁকি নিয়ে পজিশন বদলে সব আলো কেড়ে নিলেন রাফায়েল
ঝুঁকি নিয়ে পজিশন বদলে সব আলো কেড়ে নিলেন রাফায়েল
স্টয়নিস ঝড়ে পাত্তা পেলো না মোস্তাফিজরা
স্টয়নিস ঝড়ে পাত্তা পেলো না মোস্তাফিজরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ