X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা-হাসপাতাল-রাজনীতি: কোনটি মুখ্য?

মাসুদা ভাট্টি
১২ জুন ২০১৮, ১৩:২৪আপডেট : ১২ জুন ২০১৮, ১৪:০০

মাসুদা ভাট্টি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে অসুস্থ। একথা কেউই অবিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। কারণ, তার যে বয়স এবং যে শারীরিক অবস্থার সঙ্গে কারাগারে যাওয়ার আগেই মানুষের পরিচয় ছিল– তা কারাভোগে আরো খারাপ হবে সেটাই স্বাভাবিক। ফলে তার চিকিৎসা একটি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী ও একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও পক্ষেরই রাজনীতি বা হেলাফেলার সুযোগ নেই। কিন্তু কার্যত আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস শুরুর পর থেকেই তার স্বাস্থ্য নিয়েই মূলত দু’পক্ষের দড়ি টানাটানি চলছে। মাঝখান থেকে অসুস্থ ব্যক্তি খালেদা জিয়ার অবস্থা কী হচ্ছে তা কোনও পক্ষকেই বিচলিত করতে পারছে বলে মনে হয় না।
দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি আছেন প্রায় চার মাস হতে চললো। বিএনপিকে এখন বহু ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তার মধ্যে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণটি হওয়ার কথা ছিল বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি। কিন্তু লক্ষ  করলে দেখা যাবে, বিএনপি আসলে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিকে বেছে নিয়েছে সরকারের সঙ্গে দরকষাকষির ঘুঁটি হিসেবে। এই জটিল পরিস্থিতিতে বিএনপি’র গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ তারেক জিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী ভারতও সফর করছে আগামী নির্বাচনে ভারতের সমর্থন লাভের আশায়। কিন্তু তারা দেশের মানুষকে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এক করতে পারছে না কোনোভাবেই। তার মানে বিএনপি নেতৃবৃন্দও এক প্রকার মেনে নিয়েছে যে বেগম খালেদা জিয়া দোষী এবং আইনি প্রক্রিয়ায় জয়লাভ করা না গেলে তাকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। তারা নিঃসন্দেহে পাল্টা যুক্তি দেবেন যে সরকার পক্ষ বারবার বেগম খালেদা জিয়ার জামিন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং এটাও সত্য যে সরকারি কৌঁসুলিরা সেটা করছেন। কিন্তু সেটা তাদের কার্যপরিধির ভেতরে পড়ে। তাদের কেউ এখতিয়ারবহির্ভূত কোনও কাজের জন্য দোষারোপ করতে পারবেন না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গ্রেনেড হামলা করে নিশ্চিহ্ন করার চেয়ে আইনি মারপ্যাঁচে ঘায়েল করার কৌশলটি যে অধিকতর সভ্য ও বৈধ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সে বিষয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বও একমত এবং এজন্য তারা এতদিন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি বিষয়ে টুঁ-শব্দটি করেনি। আমি জানি যে বিএনপি বা তাদের সমর্থকদের কাছে এই যুক্তি ভালো লাগবে না, কিন্তু তারা যদি পাল্টা যুক্তি দেন আমি সেটা মেনে নিতে প্রস্তুত।

আমরা ধরেই নিচ্ছি যে বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাসকে সরকার দীর্ঘায়িত করতে চায়। না চাওয়ার কোনও কারণ নেই, কারণ বেগম খালেদা জিয়া সরকারি দল করেন না, সরকারের বন্ধু নয়, এমনকি সরকার-দল সমর্থক কোনও নেতা বা ব্যবসায়ীর বোন বা স্ত্রীও নন যে, আবেদন করলেই রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। তার মানে হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়াকে লড়তে হবে আইনি প্রক্রিয়ায় এবং আইনের তুখোড় মারপ্যাঁচের খেলা খেলেই কেবল বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তাকে মুক্ত করতে পারবেন। কিন্তু আমরা বারবারই দেখেছি  বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা নানা গাফিলতি দেখিয়েছেন এই আইনি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে। যদিও তারা সেটি স্বীকার না করে বারবার সরকারের ওপর দোষ চাপান যে সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে শাস্তি দিতে চায়, সরকারপক্ষ বারবার সময় প্রার্থনা করে এবং সরকার বিচারালয়কে ব্যবহার করে। বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন বলে যারা দাবি করেন তারা সেটি নিজ দায়িত্বে করবেন বলেই বিশ্বাস করি। কিন্তু তারপরও কি আইনের শাসন একেবারেই নেই এদেশে? এই প্রশ্নের উত্তরেও গোটা বাংলাদেশ না বলে চেঁচিয়ে উঠবে সেটিও বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। আইনি প্রক্রিয়ায় লড়ে এখনও এদেশে ন্যায় বিচার পাওয়া যায় এরকম উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া অনুসরণের ক্ষেত্রে যেমন বিএনপি’র ব্যর্থতা রয়েছে, একই সঙ্গে বিএনপি’র মতো একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের পক্ষেও বেগম খালেদা জিয়াকে নির্দোষ মেনে তার মুক্তির জন্য প্রবল জন-আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপি’র রাজনৈতিক ব্যর্থতা কোথায় সেটি খুঁজে বের করার দায়িত্ব তাদের। তবে আজকে যদি বিএনপি’র মূল নির্দেশনা এদেশে বসেই কেউ দিতো তাহলে হয়তো পরিস্থিতি বদলাতেও পারতো, কিন্তু সেটি হচ্ছে না, বিএনপি’র নির্দেশনা আসছে সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হয়ে এবং আসতে আসতেই সেটা অনেকটা হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। ফলে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে জোরালো কোনও প্রতিবাদ ঠিক জমছে না।

অপরদিকে নিজের মাকে কারাগারে রেখে কোনও সন্তানের পক্ষে সুষ্ঠু রাজনীতি করা সম্ভব নয়। কিন্তু বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত প্রধান তারেক জিয়া দিব্যি লন্ডনে বসে বিএনপি’র নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। মা’কে মুক্ত করার জন্য তার প্রত্যক্ষ কোনও ভূমিকা এখনও দেখা যায়নি। কিছু বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের চেষ্টা হয়তো তিনি করেছেন। কিন্তু এযাবৎ নিজের মায়ের মুক্তির জন্য বিদেশের কোনও গণমাধ্যম বা শক্তিশালী কারও সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে জানা যায় না। বেগম খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে, তিনি বাংলাদেশকে যা দেওয়ার দিয়েছেন, মানুষের আর কিছুই তার থেকে পাওয়ার নেই– এ রকমটি নাকি তার পরিবারের কেউ কেউ ভাবছেন, যদি ভাবেনও তাহলেও কি তাদেরকে দোষ দেওয়া যায়? তিনি দুর্নীতির দায়ে দোষী ও অসুস্থ। এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন চিকিৎসার। কিন্তু বিএনপি নেত্রী নিজেও যেমন তেমনই তার দলের বুদ্ধিমান মানুষরাও চান বেগম খালেদা জিয়াকে যেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যে জায়গাটি দেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোর প্রধান আবাসিক এলাকা এবং হোলি আর্টিজানের যে ভবন তার চেয়ে মাত্র কিছুটা দূরে অবস্থিত। ফলে সরকার কেন সে ঝুঁকি নেবে সে প্রশ্ন যেমন তুলতে হবে তেমনই এই প্রশ্নও তুলতে হবে যে দেশের জেল কোডে কি আছে কয়েদি যেখানে চাইবে সেখানেই তাকে নিয়ে গিয়ে দেখাতে হবে? এ বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ জানা নেই কিন্তু এটুকু নিশ্চয়ই বুঝি, যেকোনও কয়েদির ক্ষেত্রেই এটা মেনে নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে? একজন বিখ্যাত আইনজীবীর মতে, না বেগম খালেদা জিয়া কেন, যেকোনও দেশের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টও যদি দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হন তাহলেও তার জন্য আদালত চাইলেই বিশেষ কোনও ব্যবস্থা করতে পারেন না। যেমন আজকে একজন কয়েদি চাইছেন ইউনাইটেড হাসপাতালে যেতে, তাহলে আরেকজন কয়েদি যদি আরেকদিন নিজেকে সিঙ্গাপুর নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর দাবি তোলেন, তাহলে? সেটা কেউ মেনে নেবেন কি? কারাগারে যারা থাকেন তারা কয়েদি এবং কয়েদিদের জন্য রয়েছে বিশেষ আইনি কাঠামো। বেগম খালেদা জিয়া তার বাইরে গিয়ে যে সুবিধা চাইছেন তা দেওয়ার মতো কিনা এই প্রশ্ন কেউ তোলেনি বরং তারা বারবার তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে একথাটিই বলতে চাইছেন, সরকারের নির্দেশেই বেগম খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। ফলে সব দোষের ভাগীদার সরকারের ওপরে চাপিয়ে নিজেরা ভারতে যাচ্ছেন, থাইল্যান্ড যাচ্ছেন, যাচ্ছেন লন্ডনে। আর মা’কে কারাগারে রেখে পুত্র তো আগে থেকেই পলাতক!

রাজনীতি জটিল, কুটিল এবং রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। আজকে যে পরিস্থিতিতে বেগম খালেদা জিয়া আছেন সেই একই পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আর কারো হবে না একথা হলফ করে বলা যাবে না। রাজনৈতিক অসুয়া’র যদি প্রতিযোগিতা হতো তাহলে এদেশের কোনও রাজনৈতিক দলই কেউ কারো চেয়ে কম যেত বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। এখানে কনফুসিয়াসপন্থি শান্তিবাদী কোনও রাজনৈতিক দল নেই, সকলেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। আজকে হয়তো আওয়ামী লীগও সেই ক্ষমতার চর্চা করছে। কিন্তু আগেই বলেছি যে ১৫ আগস্ট ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিহত করা কিংবা ২১ আগস্টের মতো গ্রেনেড হামলা চালিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেয়ে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে, আপাতভাবে যুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার কৌশল নিশ্চিতভাবেই অধিক গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা। যদিও কোনও রাজনৈতিক কৌশলই অনৈতিক, আইনবিরোধী ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হওয়াটা যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। ফলে সরকার যদি এক পা এগুনোর চেষ্টা করে, বিএনপি’কে এগুতে হবে তিন বা ততধিক পা। কিন্তু কার্যত আমরা দেখতে পাচ্ছি উল্টো চিত্র, দলটি যেন পুরোপুরি ঝিমিয়ে পড়েছে, কোনোভাবেই যেন দলটি এঁটে উঠতে পারছে না। এখন তারা সবদিক বাদ দিয়ে ভারতের কাছে গিয়ে কোল পেতে দিচ্ছে যদি ভারত তাদের এ যাত্রায় তরিয়ে নেয়? রাজনৈতিকভাবে কতটা দেউলিয়া হলে একটি রাজনৈতিক দল চিরদিন ভারত-বিরোধিতা করে এসে শেষকালে নিজেদের আত্মা বিক্রির কৌশল নেয়, সেটা জেনারেল জিয়ার সেই বিখ্যাত ও বহুল ব্যবহৃত উক্তি দিয়েই কেবল ব্যাখ্যা করা সম্ভব যে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

বিএনপি নীতিনির্ধারকদের হয়তো মনে হতে পারে, কারাগারে বেগম খালেদা জিয়ার আরো খারাপ কিছু একটা হলে তারা সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেবে। কিন্তু সে পরিস্থিতি তো নাও হতে পারে। কারণ, গত চার মাসে দেশের মানুষ বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কতটা এগিয়েছে? এই মুহূর্তে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রয়োজন, সেটা ইউনাইটেডে হলো কি বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে হলো তাতে কী এসে যায়? রোগীর চিকিৎসা জরুরি নাকি রাজনীতি? এ প্রশ্নের উত্তর যেন কিছুতেই মিলছে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ