X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

হায় শহীদ সন্তান!

জোবাইদা নাসরীন
১৯ জুন ২০১৮, ১৭:০২আপডেট : ১৯ জুন ২০১৮, ১৭:০৯





জোবাইদা নাসরীন অনলাইন পত্রিকা দেখতে গিয়ে সুমন ভাইয়ের ছবিটা হঠাৎ চোখে পড়লো। সুমন ভাইয়ের ছবি কেন? মনে এই প্রশ্ন নিয়েই ছবির নিচে গেছি। ভেবেছি সুমন ভাই হয়তো তার মাকে নিয়ে কিছু একটা লিখেছেন। সংবাদটা এর আগে চোখ পড়েনি। পরে ছবির নিচের খবরটি পড়তেই আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। খবরটি ছিল, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদের গলা কাটা লাশ উদ্ধার’। সুমন ভাইয়ের লাশ পাওয়া গেছে? সব কিছু কেমন যেন লাগলো? সুমন ভাইয়ের মৃত্যু দুর্ঘটনা নাকি ‘আত্মহত্যা’ সেটি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যদি এটি হত্যাকাণ্ড হয়, সেটি বড়ই কষ্টের। শহীদের সন্তানেরও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নেই এদেশে। সুমন ভাই এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন, যার মা এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। আর যদি এটি আত্মহত্যাও হয় তাহলে এই দায়ও আমাদের নিতে হবে। আমাদের মানতে হবে যে, এই দেশ, সমাজ একজন শহীদ সন্তানকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে।






সুমন ভাই এদেশের ঈর্ষণীয় একজন সংগ্রামী লড়াকু নারীর সন্তান, যে নারী বুদ্ধি, মেধা, মর্যাদার দাপটে একক অভিভাবকত্বেই সন্তানকে মানুষ করতে চেয়েছেলেন সেই ষাটের দশকে। যে নারী তুমুল সাহসীকতায় লিখেছিলেন পাকিস্তানি জান্তাদের বিরুদ্ধে। তাকে যখন চোখ বেঁধে নিয়ে গেছে পাকিস্তানিদের দোসর আলবদর বাহিনী সেদিনও তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। অন্য কিছু নয় তার একমাত্র চিন্তা ছিল ছোট্ট সুমনকে নিয়ে। রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে ফেরত আসা সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী দেলোয়ার হোসেনের বর্ণনায় আমরা জেনেছিলোম, সেলিনা পারভীন ঘাতকদের কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন একটি কারণে, আর সেটি ছিল সন্তান সুমন।
সেই সুমন ভাইয়ের মৃত্যর খবর পড়তে গিয়ে বন্ধ চোখেই আমি দেখছিলাম সাত বছর বয়সী সুমন ভাইকে। সুমন ভাই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের সেই ভয়াল দিনটির কথা বহুবার বর্ণনা করেছেন। বলেছিলেন সেদিন ছোট্ট সুমনকে তার উজির মামার কাছে ভাত খেয়ে নিতে বলেছিলেন মা সেলিনা পারভীন। আরও বলেছিলেন, তিনি ফিরে আসছেন। আলবদর বাহিনীর সদসরা চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন তার মগবাজারের সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে। ১৬ ডিসেম্বরে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে সেই উজির মামার সঙ্গে গিয়েই সাদা মোজা পায়ে পচা ডোবায় চোখবাঁধা অবস্থায় সুমন খুঁজে পেয়েছিলেন মা শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের লাশ। সেলিনা পারভীনের সেই উত্তরাধিকার সুমন জাহিদ।
সেই ১৯৭১। ছেলের কাছ থেকে মাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে আলবদর বাহিনী। সেই থেকে ছোট্ট সুমনের কাছে জীবন বেশ কঠিনই ছিল। আমি সেই ছোট্ট সুমনের কঠিন সময় দেখিনি। যখন দেখা, আমি কলেজ পড়ুয়া কৈশোরের শেষ ধাপে। তখন তিনি ধ্বনিচিত্রে কিছুটা থিতু। আমার শিক্ষক ড. মেঘনাগুহ ঠাকুরতার মাধ্যমে পরিচয়ের প্রথম দিনেই সুমন ভাইকে মনোযোগ দিয়ে দেখি। তার মধ্য দিয়েই সেলিনা পারভীনকে দেখার চেষ্টা করি। আর বোঝার চেষ্টা করি আমার এতদিনের পড়া সেই ছোট্ট সাত বছরের সুমন কীভাবে মাকে ছাড়া এতগুলো সময় পার করেছে। তারপর বহুবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। বহু কথা হয়েছে। আমাকে নিয়েও গিয়েছিলেন মগবাজার সার্কুলার রোডের সেই বাড়ির কাছে, যে বাড়ি থেকে আল বদর বাহিনীর সদস্যরা হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিল তার মা সেলিনা পারভীনকে। কয়েকবার নিজেই ছোট ছেলেকে মোটর বাইকে চাপিয়ে আমার মগবাজারের বাসায় এসেছেন। পাঠিয়েছেন তার মা সেলিনা পারভীনের বহু ছবি। আমি সেই আত্মপ্রত্যয়ী সেলিনা পারভীনের ছবি দেখে সুমন ভাইয়ের কথা ভাবতাম। সুমন ভাই বলতেন, ’৭১-এর কথা মন হলেই তার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়, তিনি কিছু ভাবতে পারেন না আর।‘
শহীদ মায়ের রক্তের বিনিময়ে এদেশ থেকে সুমন ভাই কিছুই চাননি, শুধু চেয়েছেন মা সেলিনা পারভীনের কথা মানুষ মনে রাখুক। সেলিনা পারভীনের স্মৃতি নিয়েই তিনি বেঁচে ছিলেন আজীবন। শহীদ মায়ের স্মৃতি জাগিয়ে রাখার জন্যই তিনি সংগ্রাম করেছেন। মগবাজারের সার্কুলার রোডটি সেলিনা পারভীনের নামে করা হোক—এই ছিল আমার দেখা সুমন ভাইয়ের একমাত্র চাওয়া। মা হারানোর ব্যথা নিয়ে সুমন ভাই মানসিকভাবে বেশ কিছুটা খুঁড়িয়েই চলেছেন এই দেশে। চাকরি করেছেন বিভিন্ন জায়গায়। একা একা লিফলেট বিলি করেছেন। পত্রিকায় দফায় দফায় চিঠি পাঠিয়েছেন। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। সুমন ভাইয়ের লাগাতার প্রচারণায় মগবাজারের একপাশে সেলিনা পারভীন সড়ক হিসেবে পরিচিতি পেলেও অন্যদিকে সার্কুলার রোড লেখা আছে। কিন্তু সরকারিভাবে কোনও ঘোষণা আসেনি। অথচ এদেশে কত জীবিত রাজনীতিবিদের নামে সড়ক হয়েছে। কিন্তু সেলিনা পারভীনের নামে হয়নি। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে তার দুই ছেলেকে মোটরসাইকেলে বসিয়ে পতাকা বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সেই ধরনের অসংখ্য ছবি ফেসবুকে দেখতাম। ছেলেদের তিনি অসম্ভব গর্ব নিয়ে বলতেন যে, ‘তাদের এদেশে সবচেয়ে বড় গর্ব হলো তাদের দাদি শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন, যে ধরনের গর্ব এদেশের সবাই করতে পারে না ও পারবে না।’
সুমন ভাইয়ের উত্তর শাহজাহানপুরের বাসায়ও আমি গিয়েছি। সেই বাসাটি ভাবি পেয়েছিলেন তার বাবার সম্পত্তির অংশ হিসেবে। সুমন ভাই তার মায়ের নামে ফেনীতে লাইব্রেরি করেছেন, সেই খবরও দিয়েছেন। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে নক করে আমার ফোন নম্বরও চেয়েছিলেন নিজেরটাও দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন কোনও কাজ করছি কিনা, সেই খবর নিয়েছেন।

আমি শুধু বিশ্বাস করতে চাই, সেলিনা পারভীনের সন্তান আত্মহত্যা করতে পারে না। আর যদি প্রমাণিত হয় তিনি সত্যিই আত্মহত্যা করেছিলেন, তাহলে এটি সুমন জাহিদের আত্মহত্যা নয়; মনে করতে হবে এটি রাষ্ট্রেরই আত্মহত্যা। শহীদ সন্তানকে যদি এদেশে আত্মহত্যা করতে হয়, তাহলে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বিষয়টি সত্যিই আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। আর যদি এটি হত্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে সেটির বিচারও খুব দ্রুতই করতে হবে। কেন তাকে বাঁচতে দেওয়া হলো না? এদেশে তারই বেঁচে থাকার অধিকার বেশি। কারণ এই দেশটির জন্মের জন্যই যে তিনি একমাত্র অবলম্বন মাকে হারিয়েছেন।
লেখক : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]

/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন খাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন খাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পরিদর্শনে বিজিবির মহাপরিচালক
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পরিদর্শনে বিজিবির মহাপরিচালক
‘সামরিক বাহিনীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইন কর্মকর্তাদের পেশাগত মানোন্নয়ন জরুরি’
সামরিক বিচার ব্যবস্থা নিয়ে সেমিনারে বিমান বাহিনী প্রধান‘সামরিক বাহিনীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইন কর্মকর্তাদের পেশাগত মানোন্নয়ন জরুরি’
ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা, ২৮ কর্মীকে বহিষ্কার করলো গুগল
ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা, ২৮ কর্মীকে বহিষ্কার করলো গুগল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ