X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বকাপের ‘ম্যাজিক’

শুভ কিবরিয়া
১৩ জুলাই ২০১৮, ১৩:৩৮আপডেট : ১৩ জুলাই ২০১৮, ১৪:০৪

শুভ কিবরিয়া বলা হয়েছিল এবারের বিশ্বকাপ হবে তিন তারকার। মেসি, রোনালদো, নেইমার-এই তিন তারকার ওপর ভর করে জমে উঠবে রাশিয়ার বিশ্বকাপ। সেই ভবিষ্যদ্বাণী ফলেনি। তিন তারকার বিদায় দিয়েই এবারের বিশ্বকাপ নতুন মাত্রা এনেছে। ‘ম্যাজিক স্টার’দের ওপর ভরসা করে এই বিশ্বকাপের ফুটবল এগোয়নি। এগিয়েছে দলগত ফুটবলের ওপর গতি আর দমের নিশানা চাপিয়ে। শুরুতেই এই বিশ্বকাপ নানান চমক দিয়ে যাত্রা শুরু করে। চমকের বড় উদাহরণ হচ্ছে ইতালি।
‘ইতালি’ ঠাঁই পায়নি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত রাউন্ডে। পথ হারিয়েছে ডাচ ফুটবলও। বিশ্ব ফুটবলের দুই নামকরা দল ‘ইতালি’, ‘হল্যান্ড’কে ছাড়াই শুরু হয়েছে বিশ্বকাপ ২০১৮। এই দুই দেশ বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে যোগ দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। খেলার প্রথম পর্বেই রাশিয়া ছাড়তে বাধ্য হয় ফুটবল পরাশক্তির অন্যতম প্রতিনিধি জার্মানিও। বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম পর্ব শেষে রাশিয়া ছাড়া হয়েছে আফ্রিকার দলগুলোও।
এবারও অনেক বড় বড় ‘তারকা’ এসেছে। ‘তারকা’রা অনেকেই এমন শক্তিধর যে, গোটা দল তার খেলার ওঠানামার তালেই উঠেছে, পড়েছে। ‘মেসি’-নির্ভর আর্জেন্টাইন দলকেও তাই বিদায় নিতে হয়েছে নকআউট পর্বের প্রথম ম্যাচেই।
অন্যদিকে আরেক মহাতারকা ‘ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো’ এবং তার দল পর্তুগালও বিদায় নিয়েছে বিশ্বকাপ থেকে। নেইমারের ব্রাজিলের ভাগ্যেও ঘটেছে একই পরিণতি।
২.
এবারের বিশ্বকাপে ভিন্নরকম উত্তেজনা ছড়ায় আইসল্যান্ড। খুব কম জনসংখ্যার এই দেশ ফুটবল জায়ান্ট আর্জেন্টিনাকে থমকে দেয় গ্রুপ পর্বের খেলায়। একই রকম ধাক্কা আনে ইউরোপের ফুটবল খেলুড়ে দেশ সুইজারল্যান্ড। সুইজারল্যান্ডের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নিতে ব্যর্থ হয় ল্যাটিন ফুটবলের অন্যতম দিকপাল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল।
শক্তিমত্তায় এগিয়ে থাকা ক্রোয়েশিয়ার কাছে গ্রুপ পর্বে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। তারপর দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় তারা। কিন্তু ফ্রান্সের দমকা হাওয়া আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। কোয়ার্টার ফাইনালে এক অলআউট ম্যাচে উরুগুয়ের বিশ্বকাপ যাত্রা থামিয়ে দেয় ফ্রান্স। ল্যাটিন দল ব্রাজিলের স্বপ্নযাত্রার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বেলজিয়াম। বেলজিয়াম ঝড়ে উপড়ে যায় ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন,কোয়ার্টার ফাইনালেই।
৩.
অন্যান্য বিশ্বকাপের চাইতে এই বিশ্বকাপ তাই খেলার গুণে, উত্তেজনায়, তারকা পতনে,তারকা উত্থানে ‘অন্যরকম বিশ্বকাপ’ হয়ে উঠেছে। নতুন নতুন ম্যাজিকের জৌলুসে জমজমাট আর ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে এবারের বিশ্বকাপ। প্রথমত, আয়োজক দেশ হিসেবে রাশিয়া এবার বাজিমাত করেছে। বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হওয়ার লড়াইয়ে তাকে পার হতে হয়েছে ফুটবল রাজনীতির এক দুরূহ পর্ব। বিশ্ব রাজনীতির পরাশক্তিরা অনেকেই চায়নি রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হোক এই বিশ্বকাপ। রাজনীতির সেই কূটচাল উৎরেই ক্ষমতাধর রাশিয়া এবং তার রাষ্ট্রনায়ক, লৌহমানব ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮-এর আয়োজক দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এবং সাফল্যের সঙ্গে এই আয়োজন চালিয়ে নিয়েছে। রাশিয়ার এই আয়োজন অন্যরকম বিশ্বকাপের স্বাদ দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, খেলার শুরু থেকে বড় বড় তারকা সমৃদ্ধ, সমর্থকনন্দিত দলগুলো দ্রুতই বিশ্বকাপ থেকে ঝরে যায়। তৃতীয়ত, ক্লাব ফুটবলের ‘মহাতারকা’ যারা তারাও বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর থেকে দ্রুত দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয়। অনন্য মেসি, অসাধারণ রোনালদো, আলোচিত মোহাম্মদ সালাহ’ তার প্রমাণ। চতুর্থত, অনেক সম্ভাবনাময় তারকার উত্থান ঘটছে। গ্রিজম্যান, এমবাপে, মডরিচ, হ্যারিকেনের মতো খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপের আসর থেকেই আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
৪.
এবারের বিশ্বকাপে শেষ পর্যন্ত যা ঘটলো তাকে কি আমরা অঘটন বলবো, না এটাই আসলে বাস্তবতা। যেটাই বলি না কেন আমরা দেখছি বিশ্ব ফুটবলের সাম্প্রতিক প্রভুত্ব অর্জনে ইউরোপ শক্তিমান হয়ে উঠছে। ইতিপূর্বে বিশ্বকাপ জিতেছে এমন দলগুলোর মধ্যে একমাত্র ফ্রান্সই গেছে এবারের আসরের সেমিফাইনালে। ল্যাটিন আমেরিকার কোনও দলই বিশ্বকাপ ২০১৮-তে সেমিফাইনালে যেতে পারেনি।
ইউরোপের ফুটবলের এই সাফল্যের কারণ কী? একটা কারণ হতে পারে, জমজমাট ক্লাব ফুটবলের বড় বড় আসর আয়োজন করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ফুটবলে ইউরোপ প্রচুর অর্থলগ্নি করে। সেটা তাদের রেজাল্ট অরিয়েন্টেড ফুটবলের দিকে মনোযোগী করেছে। সারা বছর তারা ফুটবল নিয়েই মাতোয়ারা থাকে। এক ধরনের ফুটবল মগ্নতার ফলাফলকেন্দ্রিক ফুটবল দর্শন হয়তো ইউরোপকে এই লড়াইয়ে এগিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবল বহু স্টারের জন্ম দিলেও তারা গোলকেন্দ্রিক আধুনিক ফুটবলকে ততটা এগিয়ে নিতে পারেনি। স্টার নির্ভরতার কারণে দলের চেয়ে স্টার বড় হয়েছে বটে কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার দলগুলো সমন্বিত দল হয়ে উঠতে পারেনি। আবার দলের মধ্যে প্রচুর নতুন কমবয়সী খেলোয়াড়ের সমাবেশও ঘটেনি। ইউরোপ এক্ষেত্রে এগিয়ে থেকেছে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড তার উদাহরণ।
গতিময় ফলাফলকেন্দ্রিক ফুটবলের অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের একটা মিশেল এবার বিশ্বকাপে ইউরোপের দলগুলোকে এগিয়ে রেখেছে।
অন্যদিকে স্টার খেলোয়াড়রা ক্লাব ফুটবলে সতীর্থ হিসেবে পান নামিদামি গুণী সব খেলোয়াড়কে। সেটা তাদের স্টারত্ব বজায় রাখতে সহায়ক হয়। মেসি বা রোনালদো কিংবা নেইমার ক্লাব ফুটবলে যাদের সঙ্গে খেলেন জাতীয় দলের মধ্যে সবসময় সেই মানের সতীর্থ পাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বাড়তি চাপ নিতে হয় তাদের জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময়। সেটাও তাদের খেলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে দলগত ফুটবলের হাত ধরে একদল নতুন তারকা আরও বিকশিত হয়েছে এবারের বিশ্বকাপে। ক্রোয়েশিয়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড দলে এর প্রমাণ মেলে।
এবারের বিশ্বকাপ দুটো নতুন প্রবণতার দিকে আলো ফেলেছে। প্রথমত, আফ্রিকার ফুটবলে অনেক শক্তিমান, সম্ভাবনাময় তারকা থাকলেও সেখানে লগ্নি দরকার। আফ্রিকার ফুটবল ফিফার মনোযোগ পেলে অনেক বড় বড় স্টারের সাপ্লাই দেবে। দ্বিতীয়ত, এবারের বিশ্বকাপে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার খেলা সবার মনোযোগ কেড়েছে। ফুটবলে লগ্নি বাড়লে, এশিয়ার ফুটবল সামনের দিনে জায়ান্ট হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে।
৫.
এই বিশ্বকাপের বড় অর্জন স্টারের চেয়ে ফুটবলের সৌকর্য। বড় বড় স্টার-নির্ভর দলের চেয়ে এখানে কার্যকর ফল পেয়েছে দলগত ফুটবল। স্টার নির্ভরতায় যারা ভেবেছিল চূড়ান্ত ফল লাভ হবে, তাদের এই দর্শন কাজে লাগেনি। যেদিন বড় তারকারা ফ্লপ করেছে কিংবা বিপক্ষ দলের বাধায় সামর্থ্য মতো খেলা দেখাতে পারেনি সেদিনই থমকে যেতে হয়েছে ‘স্টার-নির্ভর’ দলগুলোকে। অন্যদিকে আকাশছোঁয়া স্টার খেলোয়াড় না থাকলেও সমমানের একঝাঁক খেলোয়াড় যাদের আছে, ডাগ আউটে মানসম্পন্ন বিকল্প খেলোয়াড়ের কমতি নেই যাদের, তারাই শেষ হাসিটা হাসতে পেরেছে। এবারের বিশ্বকাপের বড় ম্যাজিক হচ্ছে খেলার ধরন। শুধু রক্ষণাত্মক বা শুধু আক্রমণাত্মক ঘরানার ফুটবলের বদলে যারা এই দুই ঘরানার সমন্বয় ঘটাতে পেরেছে তারাই মোক্ষম ফল লাভ করেছে। দলে যাদের অভিজ্ঞ এবং বয়সী খেলোয়াড় বেশি তাদের চাইতে তারুণ্য এবং অভিজ্ঞতার মিশেল আছে এমন খেলোয়াড় সমৃদ্ধ দল ভালো ফল পেয়েছে। ফ্রান্স তার বড় উদাহরণ। অন্যদিকে স্পেন বা জার্মানি বয়সী স্টার খেলোয়াড়ের ভারে কাটলেও ধারে কাটতে পারেনি। সেটাও এবারের বিশ্বকাপের এক অনন্য স্বরূপ।
৬.
এবারের বিশ্বকাপে প্রযুক্তির ব্যবহার খেলায় গুণগত পরিবর্তন এনেছে। ভিডিও অ্যাসিটেন্ট রেফারি প্রচলন ‘হ্যান্ড অব গড’-এর জন্ম আটকে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পেনাল্টি সীমানায় ঢুকে ফাউল করে রেফারির চোখ এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ এবার দেখা যায়নি বললেই চলে। ফলে প্রচুর পেনাল্টি কিক দেখা গেছে। প্রযুক্তির নিখুঁত চোখের ভয়ে রাফ ফুটবল এবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এবারের গোলগুলো হয়েছে অসাধারণ। বিশেষত হেডে ও ফ্রিকিকে যেসব গোলের দেখা মিলেছে তা এবারের বিশ্বকাপকে অন্যমাত্রায় মেলে ধরেছে।
ফুটবলের এই বড় আসরকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য চলে দুনিয়ার সর্বত্র। মিডিয়া এক ধরনের আওয়াজ তুলে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করে। মিডিয়াবাজির আওয়াজে ব্রাজিল,আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ফাইনালিস্ট বনে যায়। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপের সাফল্য এবং সৌন্দর্য হচ্ছে এই মিডিয়াবাজিকে মিথ্যা প্রমাণ করে ভালো ফুটবল যারা খেলেছে প্রকৃতই তারা সামনে এসেছে। মিডিয়ার বানানো স্টারের বদলে মাঠে পারফর্ম করা প্রকৃত স্টাররাই বাজিমাত করেছে।
তাই এবারের বিশ্বকাপকে নিয়ে প্রচারণার যে ঢং আর বাস্তবে যা ঘটলো তার মধ্যে ফারাক অনেক, তবে সেটাকে অঘটন না বলে বিশ্বকাপের ম্যাজিক বলাই শ্রেয়। দলগত,আক্রমণাত্মক, ফলাফলকেন্দ্রিক, গতিময়, সৌন্দর্যমণ্ডিত ফিনিশিং দেওয়া ফুটবলের জয় হয়েছে এবারের বিশ্বকাপে। এই বিশ্বকাপকে প্রকৃত ফুটবলপ্রেমীরা মনে রাখবে অনেক দিন।


লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

/ওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ