X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভিন দেশে চিকিৎসা অভিজ্ঞতা

মো. সামসুল ইসলাম
১৮ জুলাই ২০১৮, ১৬:২৬আপডেট : ১৮ জুলাই ২০১৮, ১৬:২৮

মো. সামসুল ইসলাম পত্রপত্রিকায়, ফেসবুকে দেশে ডাক্তারদের সেবা প্রদানের  মান নিয়ে বিতর্ক বেশ জমে উঠেছে। চিকিৎসকদের অবহেলায় চট্টগ্রামে শিশু রাইফার মৃত্যু দেশের অগণিত মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছে এবং লেখালেখি, বিক্ষোভ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন উপায়ে তারা তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। ডাক্তাররাও প্রথমে ধর্মঘট ডেকে এবং পরবর্তীতে লেখালেখির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের জবাব দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
আমি আপাতত এ বিতর্কে ঢুকতে চাচ্ছি না। আমি শুধু আমাদের অতি কাছের একটি দেশ থাইল্যান্ডে আমার অবস্থানকালীন সেখানকার চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু অভিজ্ঞতার কথা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে ২০১০ থেকে শুরু করে পরবর্তী পাঁচ বছর সময়ের এক উল্লেখযোগ্য অংশ আমি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ছিলাম। সেখানে অবস্থানকালে সে দেশের মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি আমার গভীরভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়। তবে আমাকে সেখানে সবচেয়ে চমৎকৃত করেছে আমার ও পরিবারের চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু অভিজ্ঞতা। সেখানে চিকিৎসার অভিজ্ঞতা আমাদের দেশের অনেকেরই আছে। সেজন্যই বোধহয় আমাদের দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সে দেশের অভিজ্ঞতার পার্থক্য আমাদের অনেকের মধ্যে বিস্তর ক্ষোভের জন্ম দেয়। 

সবাই জানেন মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে থাইল্যান্ড এক আকর্ষণীয় স্থান। পুরো পৃথিবীর ৪০ ভাগ মেডিক্যাল ট্যুরিস্টদের গন্তব্যস্থল থাইল্যান্ড। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে সেখানকার ২৫৬টি প্রাইভেট মেডিক্যাল হাসপাতালের বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। চিকিৎসাসেবা অত্যাধুনিক, অতিদ্রুত ও তুলনামূলক বেশ সস্তা। ইউরোপের সমমানের চিকিৎসা অথচ খরচ ৪০ থেকে ৬০ ভাগ কম। ডাক্তার, নার্সদের ব্যবহার অস্বাভাবিক ভালো। তাই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকজন ছুটছেন থাইল্যান্ডে চিকিৎসা নিতে।

এবার আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২০১২ সালের শেষের দিকের কথা। ব্যাংককে একরাতে আমি বেশ বিপদেই পড়লাম। আমার স্ত্রী অনেক আগে থেকেই মাথাব্যথায় ভুগে আসছিল। দেশে ডাক্তাররা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধপত্র দিয়েছেন কিন্তু খুব একটা কাজ হয়নি। তবে যে রাতের কথা বলছি সেই রাতে সে মাথার ভয়ানক ব্যথায় একপর্যায়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সাথে বমি। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না এই গভীর রাতে আমি কী করব! সাথে আবার দুই বাচ্চা। যাহোক, কোনোরকমে রাত পার করে সকালেই সবাইকে নিয়ে বাসার কাছাকাছি ভেজথানি হাসপাতাল নামে এক প্রাইভেট হাসপাতালে ছুটলাম। বামরুনগ্রাদের মতো অত নামিদামি না হলেও ভেজথানি বেশ মানসম্মত আন্তর্জাতিক হাসপাতাল হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত।

যাওয়ার পর রিসিপশনে সমস্যা বলার পর তারা আমাদের হাসপাতালের নিউরোসায়েন্স সেন্টারে পাঠিয়ে দিলো। নার্স সামান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এক এমডি নিউরোলজিস্টের রুমে আমাদের নিয়ে গেলো। মহিলা রোগীদের ক্ষেত্রে তাদের বেশ সতর্কই মনে হচ্ছিল। ডাক্তার বেশ তরুণ এবং খুব হাসিখুশি। অনেক সময় নিয়ে সমস্যা শুনলেন। অনেক প্রশ্ন করলেন। আমি তো ডাক্তার না, অত বুঝিও না। যতটুকু মনে পড়ে নিজেই রিফ্লেক্স জাতীয় দুই একটা টেস্ট করলেন। এরপর নার্সকে তখনই আমাদের নিয়ে থাইওরেড ও ক্রিয়েটিনিনের দুটো রক্ত পরীক্ষা করে আনতে বললেন। আমি অবাক হলাম। ভাবছিলাম সিটিস্ক্যানসহ না জানি কত টেস্ট করতে দেয়!

এরপর রক্ত দেওয়ার পর নার্স আমাদের ওয়েটিংরুমে বসতে বলল। রোগী এবং তাদের স্বজনদের জন্য বিশাল রুম। চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা! সবচেয়ে বিস্ময়কর যে প্রচুর খাবারদাবার এবং তা সবার জন্যই ফ্রি। টেস্টের রেজাল্টের জন্য আমাদের ঘণ্টাদুয়েক অপেক্ষা করতে হলো এবং এরমধ্যে সেখানে অবস্থানকারী মহিলারা আমাদের বেশ যত্ন নিলেন। বারবার চা, কফি বানিয়ে দিলেন, সেই সাথে ইচ্ছেমত স্যান্ডউইচ, জুস, বিস্কিট, মিনারেল ওয়াটার ইত্যাদি তো আছেই।

খাবারদাবার শেষ করে আমরা নিউরোসেন্টারে ফেরত আসলাম। ইতোমধ্যে রক্তের রিপোর্ট চলে এসেছে। নার্স আমাদের নিয়ে আবার ডাক্তারের রুমে ঢুকলো। আগেই বলেছি অসম্ভব হাসিখুশি, সেই সাথে বিনয়ী ডাক্তার। রিপোর্ট দেখার সময় আমি হাসতে হাসতে বললাম বেশি ব্যয়বহুল চিকিৎসা কিন্তু আমাদের জন্য কঠিন হবে। ডাক্তার আশ্বস্ত করে আমার স্ত্রীকে বললেন, সব ঠিক আছে তবে তুমি মাইগ্রেনে ভুগছো। এরপর তিনি কয়েক ধরনের বিকল্প ওষুধ এবং তাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বললেন। কোনোটিতে মুখে ব্রন উঠবে, কোনোটিতে ওজন বাড়বে, কোনোটিতে ঘুম আসবে ইত্যাদি। জিজ্ঞেস করে যখন জানলেন সে সেখানে একটি স্কুলে পড়ায় তখন তিনি নিজেই একটা বিকল্প বাদ দিলেন। কারণ, তাতে তার কথা বলতে একটু সমস্যা হবে। আমি তার এত সতর্কতা দেখে বিস্মিত হচ্ছিলাম।

তারপর ডাক্তার ওষুধ দিলেন। একটি মাত্র ওষুধ। ছয় মাস একনাগাড়ে খেতে বললেন। এরপর আর তেমন ব্যথা থাকবে না জানালেন। ব্যথা হলে মাঝে মাঝে কিছুদিন করে খেতে বললেন। তবে আমি সত্যিকার অর্থেই হতভম্ব হলাম ওষুধের নাম দেখে। নরট্রিপ্টাইলিন ১০ মিলিগ্রাম। খুবই লোডোজের এন্টিডিপ্রেসেন্ট। খুবই সস্তা, সেখানে ওভার দ্য কাউন্টার ড্রাগ অর্থাৎ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই কেনা যেত। বাংলাদেশেও রাস্তাঘাটে পাওয়া যায়। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না এতে সে সুস্থ হবে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আমার স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠলো। মাথাব্যথার মাত্রা বেশ কমে গেলো। এখন মাঝে মধ্যে অল্পস্বল্প ব্যথা উঠলে কিছুদিন খায়। আর সব মিলিয়ে হাসপাতালের খরচ ছিল খুবই সহনীয় মাত্রায়। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমরা যে খাওয়াদাওয়া করলাম, এরপর হাসপাতালের কী লাভ থাকে। বাচ্চারাও বেজায় খুশি, ফাইভ স্টার হোটেলের মতো এক পরিবেশে বেড়িয়ে নিয়ে আসার জন্য।

এরকম বেশ কিছু অভিজ্ঞতা আমার আছে। একবার মনে হচ্ছিল আমি চোখে বোধহয় একটু কম দেখছি। চোখ দিয়ে পানি পড়ত। বেশ কিছু দিন এরকম চলার পর বাসার পাশের মার্কেটে এক চক্ষু ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলাম। খুবই দ্রুততার সাথে যন্ত্রপাতি দিয়ে আমার চোখ পরীক্ষা করে ডাক্তার জানালন আমার পাওয়ার ঠিক আছে, ৬/৬, চোখে সমস্যা নেই। যেহেতু সমস্যা নেই সেজন্য কোনও টাকা পয়সা বা ফি নিলো না। ফ্রিতে চক্ষু পরীক্ষা করিয়ে আমি তো মহা আনন্দিত!

থাইল্যান্ডের চিকিৎসা পদ্ধতির আরেকটি দিক আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছে। তা হলো ফার্মেসির ফার্মাসিস্টদের ওষুধ সম্পর্কে বিস্ময়কর জ্ঞান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি তাদের সাথে কথা বলেই সাধারণ রোগের ওষুধপত্র কিনতাম। ডাক্তারদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিবিড় এবং মানুষের প্রতি তাদের ভালোবাসা অতুলনীয়।

একবার এক ফার্মেসিতে গিয়ে আমি আমার এক সমস্যার কথা বলছিলাম। আমার পিঠের নিচের দিকে ইঞ্চিখানেক জায়গা সামান্য স্ফীত হয়ে আছে আজ অনেক বছর হলো। আমি এটা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি, মাঝে মাঝে যদিও ভয় পেতাম আবার ক্যান্সার হয় কিনা। আমি যখন ফার্মাসিস্টকে আমার এ সমস্যার কথা বলছি তখন দেখলাম পাশ থেকে শর্টস আর কেডস পরা এক অভিজাত থাই ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। বললেন, দেখি তোমার কি হয়েছে! নিজেই হাত দিয়ে দেখে বললেন এটা কিছু নয়, তোমার কোনও ক্ষতি হবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার, তুমি ডাক্তার নাকি! ভদ্রলোক হেসে এক বিখ্যাত হাসপাতালের নাম বলে জানালেন। তিনি সেখানকার একজন অনকোলজিস্ট বা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ। এবার তো আমার হতভম্ব হওয়ার অবস্থা। ডাক্তাররা কি এরকম হয়? বিনা কারণে বিনা পয়সায় মানুষকে যেচে উপদেশ দেয়!

এসব কারণেই থাইল্যান্ডের চিকিৎসা ব্যবস্থার খ্যাতি আজ বিশ্বজোড়া। থাই সরকার শুধু মেডিক্যাল সেবা নয়, মেডিক্যাল প্রযুক্তি, ওষুধ, বিকল্প চিকিৎসা, বায়োটেকনোলজি ইত্যাদির উন্নয়নের মাধ্যমে থাইল্যান্ডকে এশিয়ার মেডিক্যাল হাব বানাতে চাইছে। এজন্য ২০১৬ সালে ১০ বছর মেয়াদি তারা এক কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে। 

তাই আমাদের দেশে ডাক্তারদের অবহেলাই বলুন আর অপচিকিৎসাই বলুন, সরকারসহ সবার আন্তরিক উদ্যোগ আর সদিচ্ছা ছাড়া এ থেকে জাতি সহজে মুক্তি পাবে না। এর ওপর স্বাস্থ্যখাতে এ বছরের বাজেটে সরকারি বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় কমেছে। ৫.৩৯ শতাংশ থেকে কমে ৫.০৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাজেটে প্রায় ১৪ শতাংশ, যা আসিয়ানের অন্য সব দেশ থেকে বেশি। উন্নয়নশীল দেশ হলেও তারা স্বাস্থ্যখাতের উন্নতির মাধ্যমে দেশের আয় বাড়াতে চাইছে।

আমরা সবক্ষেত্রে শুধুমাত্র ডাক্তারদের দায়ী করছি। কিন্তু বুঝতে হবে তারা একটি সিস্টেমের অংশমাত্র, অনেক ক্ষেত্রে তাদেরও করণীয় কিছু থাকে না। বাংলাদেশেও অনেক চমৎকার হৃদয়ের ডাক্তার আছেন, আবার অনেকেই একপর্যায়ে জিম্মি হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে সব পেশায় এরকম ঘটছে। অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজের কর্মক্ষেত্র ফেলে সারা দিন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে থাকেন। সেটা নিয়ে সমালোচনা নেই। আবার সরকারি ডাক্তাররা যখন বিকেলে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন তখন হন সমালোচনার শিকার। দুর্নীতির উচ্ছেদ চাইলে শুধু চিকিৎসা কেন, সব পেশারই শুদ্ধিকরণ দরকার।

ব্যাংককে বিশ্বখ্যাত বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল থেকে মাত্র কয়েকগজ দূরে আমি এক অ্যাপার্টমেন্টে কিছুদিন ছিলাম। হাসপাতালের ভেতর দিয়েই আমাকে যাতায়াত করতে হতো। মাঝে মাঝে নিচে হাসপাতালের লবিতে বসতাম। শত শত বাংলাদেশি রোগী প্রতিদিন ঢুকছেন আর বের হচ্ছেন। বাঙালি হোটেল, দোকানসহ বামরুনগ্রাদের আশপাশের জায়গাটি এক মিনি বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। একদিকে অসুস্থ স্বদেশিদের মুখে যন্ত্রণার ছাপ আর অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার এই অপচয় দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম আর ভাবতাম, আমরা কি দেশে এরকম চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি না! ইউরোপ বা আমেরিকার কথা বাদই দিলাম, থাইল্যান্ড পারলে আমরা পারি না কেন? অন্তত কিছুটা হলেও তো আমাদের তাদের মতো স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। আর এর দায় শুধু ডাক্তারদের নয়, সরকারের, ব্যবসায়ীদের, আমার আপনার সকলের।  

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]                                                              

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অ্যাটলেটিকোকে বিদায় করে ১১ বছর পর সেমিফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগঅ্যাটলেটিকোকে বিদায় করে ১১ বছর পর সেমিফাইনালে ডর্টমুন্ড
অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
চ্যাম্পিয়নস লিগঅবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ