X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

অরুণপ্রাতের তরুণদলে আলোকিত রাজপথ

জিনাত হাসিবা
০৩ আগস্ট ২০১৮, ১৯:১৭আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৬:৫১

জিনাত হাসিবা স্কুল-কলেজ ইউনিফর্মে পথে নামা শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল আন্দোলন আমাদের আশাবাদী করছে। আমরা স্বপ্নে ভাসছি বহুকাল পর। এতকাল হরতালে টিভিতে ‘জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন’ শব্দটা হাস্যরস হয়েই ছিল।  এই প্রথম কষ্ট সয়েও নগররবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের নিদর্শন দৃশ্যমান।  নিজেদের অপারগতা মেনে নিয়ে উৎসাহ জোগাচ্ছেন আগের প্রজন্ম। কিন্তু স্কুল-কলেজগামী এই শিশু-কিশোর-তরুণদের অপরপক্ষে যে আরেকদল বঞ্চিত শিশু-কিশোর-তরুণদের অবস্থান, তারা ‘ড্রাইভার/হেল্পার’ পরিচয়ের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে, সেটা কি দেখছি? তাদের অবস্থানটা কেমন দাঁড়িয়েছে? চোখের আড়ালে শ্রেণিবৈষম্য আর বিদ্বেষ দানা বাঁধছে নাতো সুনিপূণভাবে?   

এ ক’দিনে একটা বিষয় বারবার উঠে এসেছে- অদক্ষ আর কম বয়সী চালক, যারা কিনা পাল্লা দিয়ে রেষারেষি করে রাস্তায়।  যে শিক্ষার্থী দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে তার ড্রাইভার খুঁজতে গিয়ে যদি দেখি এই পাল্লা দেওয়া বাসের ড্রাইভিং সিটে বসে আছে একজন শিশু, তখন আমাদের প্রতিক্রিয়া কি শুধুই তার অদক্ষতা আর অযোগ্যতায় সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি থাকা উচিত? নগরের দারিদ্র্যে থাকা এই শিশু-কিশোর-তরুণদলের প্রতিনিধি সে, যার শিক্ষার অধিকার ছিল কিন্তু ১০ বছর বয়সেই তাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। যার শিক্ষায় আগ্রহ নাই কারণ শিক্ষায় যে সময়টা সে দেবে তার চেয়ে এখনই ড্রাইভিংয়ে ঢুকে গেলে সে দ্রুত নিজের এবং পরিবারের রুটি রুজির ব্যবস্থা করতে পারবে। যার পক্ষে স্কুলে যাওয়া সম্ভব না কারণ স্কুলে গেলে তার পরিবারের মানুষগুলোকে না খেয়ে থাকতে হবে। যে স্কুলের প্রতি আগ্রহই বোধ করে না কারণ সেখানে তার মন ভালো করার মতো কিছু নাই, পেট ভরার মতো কিছু নেই। যে জীবন সে যাপন করে সেইখানে নৈতিকতার জায়গা নেই। জানের মায়ার কোনও ব্যাপার নাই। ওর জীবন-মরণ ওর হাতের মুঠোয়। স্টিয়ারিংয়ে তারই প্রতিফলন মাত্র।  ও জানে ‘স্টিয়ারিং ধরসি মানে হয় আমি মরুম, নয় পাবলিক মরবো’ (গতকাল ফেইসবুকে কোনও এক শিশু ড্রাইভারের ইন্টারভিউয়ে পড়লাম)। এখন এই ড্রাইভারকে নরপিশাচ বলে আমাদের তাৎক্ষণিক ক্ষোভ মিটতে পারে৷ কিন্তু তাতে ওর কী এসে যায় আর সমাধানটাই বা কী করে আসে?   

কেউ কেউ ড্রাইভিংয়ে থাকা শিশুদের ভিডিও আপলোড দিয়েছেন বীরদর্পে। আঙুলটা পরিবহন খাতের দিকে তুলেননি, শিশুটিকে অপদস্থ আর পদানত করেই সুখ।  আপনি যখন ড্রাইভারের সিটে বসা শিশুটিকে তাচ্ছিল্য করেন এবং উপহাস করেন ‘এইটুকু বাচ্চার হাতে বাস চলতেসে’ বলে, যখন সে আপনার গাড়িতে মেরে দিলো বলে তার গায়ে হাত তুলেন আর সেই মার কেউ ‘বাচ্চারে মারবেন না’ বল ঠেকিয়ে দিলে ‘বাচ্চা তো ড্রাইভিং করে ক্যান?’ উত্তরে অকাট্য যুক্তি দেন, আপনার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেন।  সে একদম অকারণ কিছু না পেয়ে কী আচরণ করছে আর আপনি কতকিছু পেয়ে কী আচরণ করছেন।   

যে অন্যায়ের বীজ বুনে ফসল আমরা পাচ্ছি তার বিচার চাইতে পারেন। কিন্তু কার বিচার চাইবেন? কার কার বিচার চাইবেন? আইন করে কড়াকড়ি করতে পারেন, মানুষগুলো যে কারণে বেপরোয়া হয়ে উঠলো তার সমাধান কী হবে? পরিবহন খাতের শ্রমিকরা যে কারণে শিশুদের ব্যবহারের পথ তৈরি করেছে সেই কারণটা খতিয়ে দেখা চাই। এই শিশু যে আসছে ড্রাইভিংয়ে, কিভাবে আসে? মামা-চাচা-ভাইয়ের হাতে পায়ে ধরে শিক্ষানবিশ মতো হয়।  শ্রমের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ পায় যেন কিছুদিন পর নিজের ঘাড়ে দায়িত্ব নিতে পারে৷ আগে আসতো না এমন করে ঢাকায়।  বাবার সঙ্গে কাজে চলে যেতো মাছ ধরতে বা জমিতে। এখন আসে কারণ বাবার কৃষি বা জেলে পেশাই হুমকির মুখে- সন্তানকে সেই পেশায় নেবে কী? এই মামা-চাচা-ভাইয়েরা কেন এই ছোটো মানুষটাকে এই কাজে সুযোগ দেয়? তাদের বিশ্রামের সুযোগ নাই, শ্রমের যে মূল্য তারা পায় তাতে বিশ্রাম মানে বিলাসিতা।  ফাঁকে ফোকরে এভাবে কারো শ্রমের বিনিময়ে সে বিশ্রাম কেনে। কিংবা বাড়তি আয়ের সুযোগ খুঁজে। কারো হয়তো মায়াও কাজ করে। আবার এই শিশুটা যে জীবনে প্রবেশ করলো তাতে নেশাগ্রস্ত হওয়ার পথ তার জন্য অবারিত।  সে আয় করছে, নিজের বিনোদন আর স্বস্তি তো সে আর দশজন পূর্ণবয়স্কদের মতই করবে- পূর্ণবয়স্কদের মতো কাজ করার দায়ভার সে নেবে, তাদের বিনোদন আর আনন্দের অংশটুকু সে নেবে না? কী করে ঠেকাবেন?

এখন এই শিশুর ড্রাইভিংয়ে আসার পথটা বন্ধ করতে হলে তার জন্য ঝুঁকিবিহীন কাজের মাধ্যমে আয়ের পথ রাখতে হবে কারণ আমাদের সমাজ বৈষম্যে টইটুম্বুর। তার পড়ালেখায় আগ্রহ আর সুযোগ রাখতে তার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবহন খাতের শ্রমিকরা যে কারণে শিশুদের ব্যবহারের পথ তৈরি করেছে সেই কারণটা খতিয়ে দেখতে হবে। মাফিয়া চক্রের কথা হচ্ছে, মন্ত্রীর পদের সঙ্গে সাংগঠনিক পদের সাংঘর্ষিক অবস্থানের কথা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা হচ্ছে, দিনশেষে পরিবহন শ্রমিক  ও গণপরিবহন যাত্রী উভয়পক্ষেরই ক্ষতির কথা হচ্ছে, শিক্ষিত বেকারদের পরিবহনখাতে নিয়োগের কথা হচ্ছে। সব কথাই হতে হবে এবং দুর্নীতিতে ভরপুর পুরো কাঠামোটায় ভেঙে আবার গড়তে হবে।  ‘ড্রাইভার হবো’ স্বপ্ন দেখে পরিবহনখাতের অন্ধকূপে  অবগাহন করা এই বঞ্চিত আর প্রান্তিক শিশুগুলোর কথা নজর আন্দাজ করে গেলে চলবে না।

চোখ ধাঁধানো এই আন্দোলনে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নটা সবার হোক।

লেখক: উন্নয়ন কর্মী

 

 

/ওএমএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ