X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গারা কেন ফিরবে?

শান্তনু চৌধুরী
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:৪৯আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:৫২

শান্তনু চৌধুরী বিশ্বের সম্ভ্রান্ত অথচ মৃদুভাষী কূটনৈতিক হিসেবে পরিচিত কফি আনান, যিনি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব। তিনি যেদিন চিরবিদায় নিলেন, ১৮ আগস্ট, সেদিন বেশ করে মনে পড়ছিল রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তার ৮৮টি সুপারিশের কথা। যেটি গেলো বছরের ২৩ আগস্ট আনান কমিশন রিপোর্ট হিসেবে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি’র কাছে তিনি পেশ করেছিলেন মিয়ানমারে স্থায়ী শান্তি আনার লক্ষ্যে। কিন্তু এর দুদিন পরের রাতটাই হয়ে গেলো রোহিঙ্গাদের জন্য বিভীষিকাময় রাত। দলে দলে তারা পালিয়ে আসতে লাগলো বাংলাদেশে। দেখতে দেখতে তাদের সংখ্যা হয়ে গেলো সাত লাখ। একই সঙ্গে আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গা মিলিয়ে সেই সংখ্যা দাঁড়ালো ১০ লাখ বা মতান্তরে ১১ লাখে। অতিথিপরায়ণ হিসেবে খ্যাতি থাকা বাঙালিরা তাদের আশ্রয় দিয়েছিল পরম মমতায়। খাওয়া-পরার কোনও অভাবে রাখেনি।
এখন সবারই এক প্রশ্ন–রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কতদূর? সিরিয়ার যে মানবিক সংকট সে হিসেব ধরলে এক বছর হয়তো খুব বেশি সময় নয়। কিন্তু একথাও ঠিক যে এই সময়ে দৃশ্যত কোনও অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং মিয়ানমার তাদের দুঃসাহস দিন দিন বাড়িয়েই চলছে অথচ প্রত্যাশিত কোনও জবাব আমরা দিচ্ছি না। বরং রাখাইনে অভিযানকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হিসেবে মিয়ানমার তুলে ধরতে চাইছে। তবে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে মিয়ানমার। কিন্তু সেটির প্রত্যাশিত অগ্রগতি নেই। উল্টো মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ। কিন্তু আরাকানে মুসলিম শাসন ও বসতি তো আজকের বিষয় নয়। তিন-চারশ বছর ধরে সেখানে মুসলমানের বসবাস। ইতিহাসের সেই আরাকানই আজকের রাখাইন রাজ্য। এখনকার মুসলমান ও অল্পসংখ্যক হিন্দু তাদেরই বংশধর। ফলে কয়েক পুরুষের বসবাসের পর একটি জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব অস্বীকারের মানসিকতাকে স্বাভাবিক বা সুস্থ মানসিকতা বলা যাবে না।

রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখতে এই এক বছরে কক্সবাজারে গেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব, ভ্যাটিকানের পোপ, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা। রোহিঙ্গাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনে তাদের চোখ ভিজে উঠলেও মিয়ানমারের নোবেল জয়ী নেত্রী অং সান সু চি’র অবস্থানের খুব বেশি হেরফের হয়নি। কিছু দিন আগেও সু চি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে গুণগান গেয়েছেন। এর কিছুদিন আগে ১১ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে গিয়ে দুটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র ও ৩০ হাজার মানুষের ধারণ ক্ষমতার একটি ট্রানজিট ক্যাম্প পরিদর্শন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ‘ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের  মধ্যে’ বিপুলসংখ্যক মানুষের ভোগান্তি দেখার কথা জানায় সফররত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। কিন্তু ওই সফরের পরই মিয়ানমার থেকে দাবি করা হয় বাংলাদেশের কারণেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিল তিন বছরের কুর্দি বালক আয়লান। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের পাড়ে ভেসে উঠেছিল তার মৃতদেহ। সে ছবি দেখে পৃথিবীর মানুষের বিবেক ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিল। মিয়ানমারের শিশুদের ক্ষেত্রে নাফ নদী পেরোতে গিয়ে অনেকেই পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। এদেরই একজন ছিল ৪০ দিনের বালক আবদুল মাসুদ। মৃত সে বালকের ছবি ছাপা হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। কিন্তু তেমন কোনও সাড়া পড়েনি।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়টি সবচেয়ে জটিল। ২৫ আগস্ট বিভিন্ন টিভিতে এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দেখলাম রোহিঙ্গারা যে সুরে কথা বলছেন সেক্ষেত্রে তাদের যাওয়ার কোনও আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না। অনেকে এমন মতও প্রকাশ করেছেন, তারা কোনও ট্রানজিট ক্যাম্পে যেতে চান না। সবকিছুর মূলে তারা দিচ্ছেন নিরাপত্তার দোহাই। ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গেলো এক বছরে রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে ৬০ হাজার। বর্তমানে গর্ভবতীর সংখ্যা আরো ২০ হাজার। মিয়ানমার এদের তো অন্তত ফিরিয়ে নেবে বলে মনে হয় না। কারণ, এরা জন্মসূত্রেই বাংলাদেশের নাগরিক। ইতোমধ্যে ১০ বা ১১ লাখ রোহিঙ্গার চাপে দুর্ভোগে বাংলাদেশ। নতুন জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গারা এই সংকট আরও বাড়াবে বৈকি! এসব রোহিঙ্গা বন ধ্বংস করছে, অস্ত্র লুট, খুন, ধর্ষণ ও মাদক বেচাকেনা করছে, এইডস ছড়াচ্ছে আর আর গর্ভবতীর সংখ্যা বাড়াচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, এক সাংবাদিককে রোহিঙ্গা নারী বলছেন তার ছয়টি ছেলেমেয়ে কম হয়ে গেছে। তিনি শিগগিরই আরো একটি সন্তান নেবেন। অবশ্য নেওয়ারই কথা। এমন আরাম-আয়েশে থাকা-খাওয়া আর আয় রোজগারের চিন্তা না থাকলে সন্তান নিতে অসুবিধা কোথায়। কিন্তু এসবের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশি মানুষের, বিশেষ করে কক্সবাজার জেলার ওপর। এই প্রভাব পড়ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর। ওরা কম টাকায় কাজ করে বলে স্থানীয় লোকজন কাজও পাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে স্থানীয়রা সেখানে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের বেপরোয়া আচরণ এবং অপরাধ প্রবণতার কারণে এরা যদি দীর্ঘদিন থাকে তবে নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে দেশ। ২৫ আগস্ট এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দিনভর উত্তাল ছিল রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ১৬টি পয়েন্টে বড় ধরনের সমাবেশের পাশাপাশি মিছিলের মাধ্যমে ব্যাপক শোডাউন করে তারা। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানকে হুমকি হিসেবেই দেখছে। এই অবস্থায় আমাদের দ্রুত অথচ নির্ভরযোগ্য ও স্থায়ী সমাধানের দিকে এগুনোর সময় চলে আসছে বলে মনে করি। কূটনৈতিকভাবে আমরা সফল একথা মানতে হয়, কিন্তু কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগে আমরা ততটা সফল হতে পারিনি। জাতিসংঘ যদিও তাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের বিভক্তির কারণে তারা পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নিধনযজ্ঞের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি)বিচারের মুখোমুখি করতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচ দেশের ১৩২ জন আইন প্রণেতা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যদিও মিয়ানমারের বিপক্ষে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতার কথা বলছে, তবু আমাদের পক্ষ থেকে বারবার নমনীয় ভাবের কারণে মিয়ানমান পেয়ে বসেছে। নইলে তাদের পত্র-পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের নামে উদ্ভট গল্প ছাপার কোনও যথাযোগ্য জবাব আমরা দিতে পারছি না কেন। গত বছর রোহিঙ্গা ঢল শুরু হওয়ার পর ২৬ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর ১৭ বার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার। এরমধ্যে অ্যাটাক হেলিকপ্টারসহও এসেছে। এই উসকানিতে সাড়া দিলেই সংঘাত ছিল অনিবার্য। মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকটকে আড়াল করতে সীমান্তে সংঘাত চেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে ফাঁদে পা দেয়নি। কিন্তু আগামীতে বসে থাকা মনে হয় ঠিক হবে না। আমাদের একটা পলিসির জায়গায় যাওয়ার মনে হয় সময় এসেছে। মিয়ানমার বুলিং করেছে, আমরা বাকযুদ্ধ অন্তত করতে পারি। বাংলাদেশকে তারা উসকানি দিক, মিয়ানমার যতই উসকানি দিক তাদের ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে করি না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের শত্রু মিয়ানমারের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা বিভীষণরাও। এরাই নানাভাবে উসকানি দিচ্ছে যাতে রোহিঙ্গারা এদেশ ছেড়ে না যায়। তাদের কাছ থেকে শক্তি পাচ্ছে বলেই রোহিঙ্গারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এরমধ্যে রয়েছে নানা এনজিও। রোহিঙ্গারা থাকলে এদের সুবিধা। এদের ব্যবসা ভালো হবে, বিদেশ থেকে সাহায্য আসবে। নিজেদের উদরপূর্তির পাশাপাশি নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য থাকলেও সেটা চালিয়ে যেতে পারবে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ৯২টি এনজিওর কর্মকাণ্ড বন্ধ করা হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এরপর রয়েছে মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠী। এরা জানে রোহিঙ্গারা অশিক্ষিত। সেই সুযোগে এদের দলে ভিড়ানো যেমন সহজ তেমনি হেন কাজ নেই যা করিয়ে নেওয়া অসম্ভব নয়। সেখানে মানবতা বা সুশিক্ষার কোনও বালাই নেই, যা আছে তা হলো অন্ধ কুসংস্কার শিক্ষা।

এই রোহিঙ্গারা হুমকি হয়ে উঠবে কক্সবাজার তথা পুরো দেশের জন্য–এ কথা বহুবার বলা হয়েছে। আমরা এদের ভাসানচরে পুনর্বাসনের কথা বলছি। সেখানে হয়তো লাখ-দু’লাখের জায়গা হবে। বাকিরা তো থেকেই যাবে। আর সেখানে পুনর্বাসনও কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। তার মানে তারা আর মিয়ানমার ফিরছে না সেটি ধরেই নিতে হবে। মিয়ানমারে তাদের কোনও অধিকার ছিল না, নাগরিকত্ব ছিল না, ঠিকমতো খাওয়া পরার কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। আর এখানে বিনা পয়সার আরাম আয়েশের ব্যবস্থা। তাই তো ২৫ আগস্টে তাদের কথায় ফুটে উঠতে দেখলাম উল্টো সুর। নিজেদের দেশে ফেরার জন্য তারা জুড়ে দিচ্ছে নানা শর্ত। তারা বলছে, বাংলাদেশ মুসলিম দেশ। মরতে হলে এদেশে মরবে। ধীরে ধীরে এরা শেকড় গেড়ে বসছে। তাই এদের ফেরাতে চাইলে সরকারকে এখনই কঠোর অবস্থানের দিকে যেতে হবে। কূটনৈতিক চাপ জোরদার করার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের প্রতিও কঠোর মনোভাব পোষণ করতে হবে। বলছি না যে সাময়িক অভিযান চালিয়ে এদের তাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, এতে ত্বরিত সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদি সুফল আসবে না। কিন্তু সময় বোধহয় এসেছে মিয়ানমারের সঙ্গে একটু সুর গরম করার। যেহেতু তারা মিথ্যার বেসাতি খুলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ