X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘরের বাইরে কাজ মানেই কি নারীর উন্নয়ন?

তানজীনা ইয়াসমিন
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:১৪আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৬:১৯

তানজীনা ইয়াসমিন নারীশিক্ষা ও শিক্ষিত নারীর ঘরের বাইরের কাজে অংশগ্রহণ বর্তমানে প্রায় উন্নয়নের সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে মূলত আশির দশক থেকে নারীশিক্ষার হার বাড়ানো ও নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। এশিয়ার উন্নত দেশ জাপানেও নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের উদ্যোগ-আয়োজনের শুরু বলা যায় প্রায় একই সময়ে। এই দুই রক্ষণশীল সমাজে নারীর কর্মসংস্থান কীভাবে ঘটেছে এবং তাতে দীর্ঘমেয়াদে নারী, তথা সমাজের কতটা কল্যাণ হচ্ছে–এই লেখাকে সেই বিস্তৃত আলোচনার সূত্রপাত বলা যেতে পারে।
প্রথমেই দুই দেশের তথ্য-উপাত্তের একটু তুলনা করা যেতে পারে। দেখা যাচ্ছে, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল প্রায় ২০ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৯ শতাংশে। আর জাপানে এই হার ১৯৯০ সালের ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৭ সালে হয়েছে মাত্র ৪৩.২ শতাংশ। এই ৪০ শতাংশ জাপানি নারী মূলত গৃহকেন্দ্রিক কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং বাইরে গেলে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খণ্ডকালীন কাজকেই বেছে নিতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জাপানি নারীদের বাড়ির বাইরে কাজে অংশগ্রহণ প্রায় ছিলই না। বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে জাপানি নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর নব্বই দশকে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং পরবর্তী সময়ে মন্দা মোকাবিলায় এই উদ্যোগের আরও সম্প্রসারণ ঘটানো হয়।

৭০ ও ৮০’র দশকেও নারীর ক্ষমতায়নকে জাপানে সাধারণত মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হতো। কিন্তু নব্বই দশকের পর এই আলোচনা নতুন রূপ নেয়। এর একটা কারণ জাপানের জনসংখ্যা বৃদ্ধির নেতিবাচক হার এবং সংকুচিত শ্রমশক্তি। কিন্তু আজ  প্রায় ৩ দশক পরে এসেও দেখা যাচ্ছে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশ।

এর কারণ মূলত সন্তান ও তাদের পরিচর্যা এবং মায়ের অনুপস্থিতি সময়ের বিকল্পায়ন হিসেবে চাইল্ড কেয়ার হোমের অপ্রতুলতা। এ থেকেই একটা সমাজের মানুষের মানসিক কাঠামো এবং নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা বোঝা যায়।

২০১৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি জাপানে ডে কেয়ার সেন্টারের অপ্রতুলতা বিষয়ে এক মায়ের লেখা নিয়ে নারীরা পথে নেমে আসেন, অনলাইনে পিটিশন জমা দিতে থাকেন। যা শেষাবধি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। মায়েদের এই ক্ষোভের শুরু আরও আগে। মন্দার সময়েই ২০১১ সালে জাপানে ভয়াবহ সুনামি আঘাত হানে এবং অর্থনীতি আরও বিপর্যস্ত হয়। সে সময়েই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে শিনজো আবে অর্থনীতি চাঙ্গার জন্য যেসব পদক্ষেপ নিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল জেন্ডার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, নারীর কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ। তিনি ৩ বছরের মাতৃত্বকালীন ছুটি ও প্রত্যেক কোম্পানিতে অন্তত একজন নারী এক্সিকিউটিভ নিয়োগের জন্য  অনুরোধ জানান। কিন্তু এভাবে সংকুচিত শ্রমশক্তির পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নকে জাপানের ব্যবসায়ী নেতারা করপোরেট গ্রোথের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, ৯০ দশক থেকেই জাপানের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ক্রমক্ষীয়মাণ এবং বর্তমানে বেশ কিছু বছর ধরে এটা নেতিবাচক।

কিন্তু আবে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তাতে ছিল নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আবশ্যকীয় দুটো শর্ত। এরপরও জাপানে কর্মজীবী নারীর অধিকাংশই মূলত খণ্ডকালীন বা স্বল্পমেয়াদি বা স্বল্প কর্মঘণ্টার শ্রমে নিযুক্ত থাকতে পছন্দ করেন। তাদের কাজের ধরনও হয় মূলত সেবামূলক, সেক্রেটারিয়াল বা সেলসের মতো ক্ষেত্রে। তাই বর্তমানে জাপানে মোট শ্রমশক্তির ৪৩ শতাংশ নারী হলেও এর ৩ শতাংশ মাত্র এক্সিকিউটিভ। আর ব্যবস্থাপক বা পরিচালক অতি নগণ্য।

তবে, আবে সরকারের এসব উদ্যোগের ফলে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন গ্রহণের হার বেড়ে গেছে। ২০১৫ সালে নারী কর্মীদের ৪০ শতাংশই ছিলেন গ্রাজুয়েশনধারী। এর আগে মেয়েরা হাইস্কুল পাসের পর পড়াশোনায় নিরুৎসাহিত হতো। কারণ, একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ব্যয়বহুল, অন্যদিকে পাস করার পর যে চাকরি মেলে, তাতে হাইস্কুলের ডিগ্রিই যথেষ্ট। ২০০০ সালের আগে মেয়েদের হাইস্কুল পাসের পর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হার ছিল ২০ শতাংশ, যা ২০১১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে।

নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে অনিবার্য  হয়ে দাঁড়ালো ডে কেয়ার সেন্টার। কারণ, ঘরের কাজ এবং সন্তান প্রতিপালনের কাজে সংকট সৃষ্টি হলো। ফলে ব্যাপকভাবে ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হলো। কিন্তু তার পরও দেখা যাচ্ছে, বিগত পাঁচ বছরে ডে কেয়ারের সংকট খুব একটা কমেনি। ২০১৫ সালে অপেক্ষমাণ তালিকায় শিশুর সংখ্যা সরকারি হিসেবে ছিল ২৩ হাজার ১৬৭। আবে সরকার এসেই ২ লাখ শিশুর জন্য ডে কেয়ারের ব্যবস্থা করলেও পাঁচ বছরে তা অপ্রতুল হয়ে গিয়েছিল। ফলে সরকারকে নতুন করে ১১২ মিলিয়ন ডলারের বাজেট প্রস্তাব করতে হয়েছে।

সংকটের আরেক দিক হচ্ছে ডে-কেয়ারের তুলনায় প্রশিক্ষিত স্টাফের অপ্রতুলতা। অতিরিক্ত শিশু কোনও সেন্টারে রাখা যাবে না। এতে উভয় পক্ষেরই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে। এর সমাধান হিসেবে কিছু স্কুলেও ডে-কেয়ার রাখা হচ্ছে। তবে মায়েদের বাইরের কাজ যেন সংসারে এবং অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে, এটা খেয়াল রাখা হচ্ছে। সেজন্য ডে-কেয়ার নিশ্চিত করার সময়ে তাদের চাকরির বেতন এবং কিন্ডারগার্টেন ও ডে-কেয়ারের ফি ইত্যাদির তুলনা করা হয়।

এবারে বাংলাদেশের দিকে তাকানো যাক। আমাদের উন্নয়ন আলোচনায় একেবারেই অনুপস্থিত থাকে শিশু প্রতিপালনের বিষয়টি। সে কারণে মায়েরা যখন বাইরে কাজ করছে, তখন শিশু প্রতিপালন বা ডে-কেয়ার সেন্টারের বিষয়টি আলোচনার কোনও পর্যায়েই আসে না। এ বিষয়ে কোনও তথ্য-উপাত্তও নেই। অথচ যেকোনও উন্নয়নের লক্ষ্যই হচ্ছে আজ ও আগামী প্রজন্মের সুখ ও সমৃদ্ধি। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বিষয়টাকে চরমভাবে উপেক্ষা করেছে। বর্তমানে হাতেগোনা দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের নারী-কর্মীদের সন্তানের জন্য কিছু ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা এত কম যে, সেগুলো কোনও শতাংশের হিসাবেই আসে না।

সম্প্রতি প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত বিমানবালার আড়াই বছরের কন্যাসন্তান গৃহকর্মীর দ্বারা অপহৃত হওয়ার ঘটনাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। একজন সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণির কর্মজীবী মাও বাংলাদেশে কতটা অসহায় তার উদাহরণ এটা। এদেশে প্রায় অধিকাংশ মাকেই এমন একজন অশিক্ষিত, অপ্রশিক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের কাছে তার দুধের সন্তান রেখে বাইরে যেতে হয়, যা ভাবা যায় না। এমন চাপ নিয়ে একজন মা যখন কাজে বের হন তার কাজে এর প্রভাব পড়ে, তার পেশা-ক্যারিয়ারের উন্নতি হুমকিগ্রস্ত হয়, সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে সবসময়।

বাংলাদেশে মা-বাবা-পরিজনবিহীন পরিবেশে ভয়াবহ এক টানাপড়েন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ও নিম্নমানের প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে বর্তমান প্রজন্ম। জাপানের মতো বাংলাদেশেও শিশুপ্রতিপালনে বাবারা তেমন ভূমিকা রাখেন না। জাপানেও দেখা যাবে মাত্র ২ শতাংশ বাবা পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে থাকেন। আগে যেহেতু আমাদের মায়েরা বাসায় এবং বাবারা বাইরে থাকতেন, ফলে আমাদের বেড়ে ওঠা, আচার-ব্যবহার, মূল্যবোধ গড়ে উঠতো মূলত মায়ের হাতে। আজ  সেই হাত বদল হয়েছে অশিক্ষিত ও অতি নিম্নবিত্ত পরিবারের নারী-গৃহকর্মীর দ্বারা। প্রজন্ম গৃহকর্মীর মূল্যবোধেই দিনের সিংহভাগ জেগে থাকা সময় পার করছে। কাজেই প্রজন্মের গ্রুমিং হচ্ছে ক্রমনিম্নগামী।

এর সমাধান অবশ্যই মায়েদের ঘরে ফেরা বা গৃহকেন্দ্রিক পেশা গ্রহণ নয়। এর সমাধান পর্যাপ্ত ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা এবং তা দক্ষ প্রশিক্ষিত কর্মীদের মাধ্যমে পরিচালনা নিশ্চিত করা। অকার্যকর ইউনিভার্সিটির বদলে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, ডে-কেয়ার সেন্টার ইত্যাদি তৈরি করা। এতে শিক্ষার্থীরা কম খরচে, কম সময়ে শিক্ষা শেষ করবে এবং চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও দক্ষ কর্মী পাবে। আর আমাদের বাচ্চাগুলো উপযুক্ত গ্রুমিং পাবে, শিক্ষা পাবে এবং মায়েরাও অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে নিজের সন্তান ও নিজের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ রেখেই। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে মায়েদের বাইরের কাজে অংশ নেওয়াই একটা দেশের উন্নতির সূচক নয়, যতক্ষণ না প্রজন্মকে নিরাপদ ও তার বিকাশকে ঝুঁকিমুক্ত করা যাচ্ছে। এটা না হলে কোনও উন্নয়নই শেষাবধি উন্নয়ন নয়, নারীর তো নয়ই।

লেখক: জাপান প্রবাসী লেখক, গবেষক

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ