X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাপান-বাংলাদেশের বাণিজ্য ও সম্পর্ক

তানজীনা ইয়াসমিন
১১ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৩৮আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৬:০৭

তানজীনা ইয়াসমিন উন্নত বিশ্বের সঙ্গে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই ঢাকার হলি আর্টিজান নিয়ে এসেছিল এক অনভিপ্রেত হোঁচট। সেই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডে নিহত ২০ জনের তালিকায় ছিলেন আমাদের স্বাধীন দেশে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো অন্যতম দেশ জাপানের সাতজন নাগরিক।
দুঃখের বিষয় হলো, শুধু ব্যবসার জন্য নয়, জাপানি দাতা সংস্থা জাইকার অনুদান সংশ্লিষ্ট কাজের দায়িত্বে তারা বাংলাদেশে ছিলেন।
অত্যন্ত বিনয়ী জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেও সেদিন ক্ষোভে ফেটে গিয়ে বলেছিলেন, ‘I feel profound anger that so many innocent people have lost their lives in the cruel and nefarious terrorism’.
জাপান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ট্রাভেল এলার্ট দুই মাত্রার বিপজ্জনক তালিকাভুক্ত হয়ে যায় বাংলাদেশ। যার অর্থ অতি জরুরি কাজ ছাড়া সে দেশে ভ্রমণ নিষিদ্ধ এবং সফরকালীন কোনোরকম জনসমাবেশ এড়িয়ে চলার নির্দেশনা। এরপর ২০১৭ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে জাপান সফর করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির প্রসঙ্গটি জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জাপানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নবুও কিশিকে অনুরোধ জানান বাংলাদেশে সফরের সতর্কতা উঠিয়ে নেওয়ার। কিন্তু সেই আবেদন এখনও অপরিবর্তিত।

গত বছর (২০১৭) আগস্টে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BIDA) সিঙ্গাপুরে এক বি-টু-বি কনফারেন্স উপলক্ষে আগত জাপান এবং বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে আয়োজন করেছিল। ওই অনুষ্ঠানে সাবেক এমসিসিআই সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর সার্ক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জাপানের ASEAN বিনিয়োগে সর্বনিম্ন বিনিয়োগ পেয়েছে উল্লেখ করেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুধুমাত্র সস্তা শ্রম নয় বরং বিনিয়োগের জন্য অনেক বড় একটি ক্ষেত্র তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অবহিত করতে হবে।’

একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই জাপান আমাদের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং মালয়েশিয়ার পরেই বৈদেশিক বিনিয়োগের চতুর্থ বৃহত্তম উৎস। ২০১৫ সালের হিসাবে বাংলাদেশ সপ্তম বৃহত্তম রফতানিকারক বাজার।

বাংলাদেশ থেকে জাপানে নিয়মিত আমদানি হচ্ছে বস্ত্র, চামড়াজাত পণ্য ও চিংড়ি। যদিও বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য জাপানের মোট আমদানিকৃত পণ্যের কেবল ০.১৭ %।

জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের মে ২০১৭-এর তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত জাপানি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৫৩-তে পৌঁছে গেছে, যা ২০০৮ সালের তিনগুণ।

বাংলাদেশে পরিচালিত এই ২৫৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রধানত পোশাক ও চামড়া শিল্প, এরপর বায়িং হাউজ ও মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা, অতঃপর অন্যগুলো সাপ্লাই এবং প্রযুক্তি শিল্প। তবে চীন বা থাইল্যান্ডের তুলনায় জাপানি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাংলাদেশে এখনও অনেক কম হলেও তা দ্রুততর গতিতে বাড়ছে। কারণ, বাংলাদেশেই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ভেতর সর্বনিম্ন শ্রমখরচ। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের বৈদেশিক শাখা চীন থেকে বাংলাদেশে সরিয়ে আনার পরিকল্পনাও ব্যক্ত করেছে।

জাপানের জেটরো ওভারসিস রিসার্চ ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তা মারি তানাকা স্ট্রেইট টাইমসে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এই বিষয়ে জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘জাপান এবং অন্যান্য পূর্ব এশীয় দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমখরচ কম বলেই তরুণ শ্রমশক্তির অনেক বড় অংশকে কাজে লাগানো সম্ভব।

তার মতে, ২০০৮ সালে উৎপাদন আউটসোর্স করার সিদ্ধান্ত জাপানি বৈদেশিক বাণিজ্যের এক দারুণ সাফল্য ঘটলেও সাম্প্রতিককালে চীনের ক্রমবর্ধমান শ্রম খরচ এবং ২০১০ ও ২০১২ সালে চীন-জাপান বিঘ্নিত সম্পর্ক অন্য দেশগুলোতে জাপানের বাণিজ্যিক ক্ষেত্র তৈরিতে কাজ করছে।

আশার কথা হলো, চলতি বছরের সাত আগস্ট বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে সংক্ষিপ্ত সফরে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কনো ঢাকা সফরে এসেছিলেন। জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে আমরা জানতে পেরেছি– জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নে পূর্ণ সমর্থন দেবে এবং ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ‘নতুন শিল্পায়িত অর্থনীতির’ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৩৯তম ইয়েন ঋণ প্যাকেজ, ২০০.৪ বিলিয়ন ইয়েন প্রদান করবে।

এছাড়াও আসন্ন ২০২২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা হবে– এই আশ্বাসও পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত জাপানি জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষ অনুরোধও জানানো হয়।

যাইহোক, জাপানে তথ্যপ্রযুক্তি আউটসোর্সিং মার্কেটের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন পেশাদারিত্ব মনোভাব তৈরি করা, বৈদেশিক লেনদেনের প্রক্রিয়াকে আরও যুগোপযোগী করা। ইন্টানেটের গতি বৃদ্ধিও গুরুত্বপূর্ণ। এসব কিছুর আরও গতি পাবে যদি স্বাক্ষরতার হার আরও বৃদ্ধি করা যায়। এগুলোর উন্নতি করলেই জাপানের তথ্যপ্রযুক্তির বাজারে আউটসোর্সিং করে কর্মসংস্থানের শক্ত ঘাঁটি করতে পারবে বাংলাদেশের তরুণরা।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, জাপানে নিজ খরচে শিক্ষা ভিসা নিয়ে আসতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ভিসা পাওয়ার পরিমাণও খুব কমে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ যতটুকু জানা যায়, ভিসাপ্রার্থীরা ঠিক মতো কাগজপত্র দেখাতে পারেন না। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর গ্যারান্টারের তিন বছরের যে ব্যাংক হিসাব চাওয়া হয় তার সঙ্গে অনেক সময়ই নাকি ব্যাংক ব্যালেন্সের মিল পাওয়া যায় না। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার স্বাক্ষরে গরমিলের অভিযোগ তো আছেই। ফলে জাপানি ভাষা শিক্ষার স্কুল, যেসবের মাধ্যমেই এমন শিক্ষার্থীরা আসেন, সেখানে বিশ্বের পঞ্চাশের বেশি দেশের শিক্ষার্থীরা বছরের দুই সেমিস্টারে নিয়মিত এলেও আমাদের শিক্ষার্থীরা ভিসা পাচ্ছে খুবই কম। অথচ নেপাল থেকেও প্রচুর শিক্ষার্থী এসে স্থায়ী বাসস্থান গড়ে চলেছে। এজন্য আমি মনে করি, ভিসা প্রক্রিয়ায় সততা দেখানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। নিজের কাগজপত্র সঠিক রাখা, স্বচ্ছতা রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

অসততা থাকলে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিরূপ ধারণাও তৈরি হবে জাপানিদের মধ্যে। এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমরা যারা জাপানে বসবাস করি তারা সবাই জানি, ২০১৬ সালে ঘটে যাওয়া হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় কতটা ক্ষুব্ধ হয়েছিল এখানকার সাধারণ মানুষ। আমরা তো এখানে পূর্ণ নিরাপত্তা পাচ্ছি, তাহলে ওরা কেন আমাদের দেশে নিরাপত্তা পেলো না? এমন প্রশ্নও শুনতে হয়েছে আমাদের। তবু তারা আমাদের আপন করে নিচ্ছে। আমাদের উন্নতিতে, অর্থনীতিতে, তথ্যপ্রযুক্তিতে তারা সহায়তা করে আসছে।

তাই সম্পর্কের সুতোটা আরও পোক্ত করতে হবে সততা ও শ্রম দিয়েই। শেষে বলতে চাই, সামনে নির্বাচন। যারাই ক্ষমতায় আসুক বৈদেশিক বাণিজ্যে আরও বেশি কর্মতৎপরতা, পেশাদারিত্ব, নিরাপত্তার বলয় তৈরি করে বাংলাদেশের উন্নয়নকে আরও প্রসারিত করার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাক।

লেখক: জাপান প্রবাসী লেখক, গবেষক

 

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ