X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ হাজারের বাটখারায় নির্বাচন

জোবাইদা নাসরীন
০১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:১০আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:১৯

জোবাইদা নাসরীন সংবাদটি খুবই ছোট। জানি না বাংলাদেশর সব গণমাধ্যমে এটি প্রকাশিত হয়েছে কিনা। না হওয়ারই কথা। কারণ, এসব খবরের সামাজিক গুরুত্ব বা কাটতিমূল্য কোনোটিই নেই। যেখানে বর্তমানে একটি ছোটখাটো স্থানীয় নির্বাচনেই খরচ হচ্ছে কোটি টাকা, সেখানে জাতীয় নির্বাচনে বিশ হাজার টাকা জামানত দেওয়ার সঙ্গতি সব প্রার্থীর নেই। দুই-চারটি অনলাইন পত্রিকার বরাতে ফেসবুকের পাতায় ঘুরতে থাকা একটি খবরে চোখ আটকে যায়। সংসদ নির্বাচনের জন্যে নির্ধারিত ২০ হাজার টাকা জামানত জোগাড়সহ অন্যান্য জটিলতার কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) আট প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। এছাড়া বাম গণতান্ত্রিক জোটের আরও দুই নেতা অর্থ জটিলতায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেনি বলে আমি জানি। তবে আমরা জেনেছি যে বাংলাদেশেও এমন নেতা আছেন, যারা টাকার অংকে জীবনের সলতে খোঁজেন না,  বিশ হাজার টাকা আজও তাদের কাছে অনেক দূরের বিষয়।
অনেকের কাছে বিষয়টি হাস্যকর মনে হয়েছে। ভাবছেন বিশ হাজার এমন কী টাকা? আমরা তো এখন আর ‘দরিদ্র’ দেশের নাগরিক নই। আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৫২ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৬১০ ডলার। এ হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪২ ডলার। সেখানে বিশ হাজার টাকা ‘মাত্র’ এর তাচ্ছিল্যভরাই। এখন অনেক প্রার্থীই নমিনেশন জমা দেওয়ার দিনই শোডাউন করে, লোকজন জড়ো করতে এবং তার পক্ষে প্রচার করতে খরচ করেছেন টাকা। এই দশজন প্রার্থীর ভোটের মাঠে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ভোটের বাজারে নানা ইঙ্গিতও তৈরি করে। অনেকে আবার ভাবছেন যারা বিশ হাজার টাকাই জমা দিতে পারছেন না, তারা কীভাবে নির্বাচন করবেন? কেউ  আরেকটু এগিয়ে আরও ভাবছেন হয়তো তারা ধার নিয়ে জামানত জমা দিলো পাছে সেটি হারিয়ে আবার দেনা হয়ে যাবেন–এই ভেবেই নির্বাচন থেকে সরে গেছেন।

ভাবনাগুলো নিছক নয়। সবই হয়তো বর্তমান নির্বাচনের যে চলমান সাংস্কৃতিক অনুবাদ আমরা তৈরি করেছি তার সঙ্গে যায় না। হালে কোথায় যেন মিল খায় না। অন্তত নির্বাচন কেন্দ্রিক আমাদের এতদিনের বোঝাপড়ায় নির্বাচন আর বিশ হাজার টাকার হিসাবনিকাশ কেন জানি বড্ড সেকেলে মনে হয়। বিশ হাজার টাকাও যিনি জোগাড় করতে পারেন না তিনি কীভাবে নির্বাচন করার সাহস করেন? কারণ, আমরা সবাই জেনে গেছি এদেশে নির্বাচন করতে টাকা লাগে। শুধু টাকা লাগে বললে ভুল হবে, আসলে টাকার পাহাড় লাগে। নির্বাচন তো হয় না, আসলে হয় টাকার শোডাউন, অর্থের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষমতার শোডাউন। তাই প্রার্থীরাও জানে বিশ হাজার টাকার জামানতই শেষ অর্থের হিসাব নয়, তার পেছনে আসলে কমপক্ষে আরও তিনটি শূন্যের জোর থাকতে হবে। জনগণই ক্ষমতার মূলকাঠি -এটি গণতন্ত্রের স্লোগান হলেও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে খুব কম সময়ই জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার মূল্যায়ন ঘটে।

তবে প্রার্থীরা সবাই বলে, জনগণ চায় বলেই তারা নির্বাচন করেন, করতে চান। তারা জনগণের সেবা করতে চান। প্রথমে নমিনেশন জন্য দৌড়ঝাঁপ, তারপর ভোটভিক্ষা। এদেশে এখন নির্বাচন ব্যয় সরকারিভাবে যে হিসাব আছে সেটা কাগজে কলমে থাকলেও এই ব্যয় আসলে কোনও কোনও প্রার্থীর ক্ষেত্রে কত পর্যন্ত ঠেকে তা বলা আসলেই কঠিন। তবে এই হিসাব দিন দিন বেড়েই চলছে। কারণ, এখন যে অর্থেরই প্রতিযোগিতা, জনপ্রিয়তার নয়।

নির্বাচন এখন অনেক বেশি ওপর থেকে নিয়ন্ত্রিত। নিচ থেকে বা সোজা কথায় বলতে গেলে তৃণমূল থেকে নয়। যার কারণে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দুই প্রধান দলেই। প্রত্যেকটি প্রার্থীর সর্বোচ্চ সামর্থ্য থেকে মনোনয়ন দেয়, এবারও দিয়েছে। কয়েকটি জায়গায় বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। সেই মনোনয়নে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি গুরুত্ব পায় সেটি হলো অর্থের যোগ্যতা। কিন্তু বিষয়টি উল্টোই হওয়ার কথা ছিল। জনগণেরই নেতা নির্বাচনের কথা ছিল। জনগণই ভালো জানে কে তার পাশে আছে, কে তার সঙ্গে থাকবে? কিন্তু এখন আর সেই যুগ নেই। চল নেই। জনগণ এখন শুধু প্রার্থীদের নামের পাশে টিক দেবে। এমনকি কোনও প্রার্থীকেই যোগ্য মনে না করলেও আপত্তি জানানো বা না ভোটের উপায় নেই। এ এক ভোটবন্দি ব্যবস্থা। ভোট দেওয়া ছাড়া আর কোনও কিছুতেই জনগণের মতামত জানানোর সুযোগ নেই।

রাষ্ট্র ভোটের মতো একটি নাগরিক অধিকারের জায়গাটি কীভাবে শ্রেণিভিত্তিক হয়ে গেলো সেটি দেখার জায়গা। নির্বাচনের জামানতের টাকাওবা কীভাবে নির্ধারণ করা হয় তাও জনগণের কাছে কখনও খোলাসা করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন তাহলে ধারণাই করে শুধু ধনীরাই নির্বাচন করবে? কী কী কারণে এই অংকের পরিমাণ বিশ হাজার টাকা হলো? প্রার্থীদের অবলম্বন হওয়ার কথা জন সমর্থন। বরং আমি মনে করছি এই দশজন মানুষই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতিনিধি, যারা সাহস করছেন, টাকার ওপরে ভর করেননি, বরং মানুষের সমর্থন, সাহস আর ভালোবাসার ওপরের ভিত্তি স্থাপন করতে চেয়েছেন।

বরং নির্বাচন কমিশনের উচিত সাধারণ মানুষকে নির্বাচন করার পরিসর তৈরি করা। শ্রেণিভিত্তিক নির্বাচনকে অনুৎসাহিত করা। জনগণ সর্বস্ব নির্বাচনের মৌলিক পাটাতন তৈরি করা। কিন্তু সেটি হয়নি এদেশে। যারা বিশ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারে না জামানতের জন্য, তাদের নির্বাচনে প্রার্থী না হয়ে উঠলেও তারা কোথাও না কোথাও তাদের নৈতিক সাহসটুকু গেঁথে রাখে। তারা প্রশ্ন পাড়ে, প্রশ্ন তোলে নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার চর্চিত রূপটির দিকে।

অথচ যারা জীবনে মানুষের সঙ্গে জীবন মেলাতে কিংবা জীবনে আহামরি সচ্ছলতার সন্ধান করেননি, কতটা তারা জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত সে হিসাবের বাইরেও তারা যে একবাক্যে সাদামাটা জীবনমুখী সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। জীবনের নিজস্ব একটি ভঙ্গি তারা তৈরি করতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। সেই ভঙ্গিকে সম্মান জানানোর প্রয়োজন ছিল নির্বাচন কমিশনের। অংশীদারিত্বের যে নির্বাচনের ধারণা সেটি থেকে ক্রমশ সরে এসেছে রাষ্ট্র। এখন আওয়ামী লীগ আর বিএনপি নির্বাচনে এলেই সেটি হয়ে যায় অংশীদারিত্বের নির্বাচন। জনগণের অংশ থাকে শুধু ভোট প্রদান। কিন্তু আসলে পুরা ভোট ব্যবস্থাপনাতেই টাকা আর ক্ষমতার পরিবর্তে জনগণ থাকার কথা ছিল। কীভাবে অনুবাদগুলো পাল্টে দেওয়া হয়, পাল্টে যায়, সেই হিসাব আমরা কেউ রাখি না। আর এই দশজন আমাদের মনে করিয়ে দেয় নির্বাচনের চর্চিত সংস্কৃতি বাইরেও নির্বাচনকে দেখার নানা ভঙ্গি আছে, সেই বিষয়ে আমাদের মন ফেরানো এবং নির্বাচন কমিশনে অর্থ নয় জনমুখী নির্বাচনের বীজ পোঁতা জরুরি।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ