X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

রশীদ হায়দারের ‘অন্ধ কথামালা’, ডিসেম্বর, বাংলাদেশ

দাউদ হায়দার
১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:৩৫আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:২৪





দাউদ হায়দার বছরের তিন মাসে তুমুল আলোড়িত হই। তিনটি মাসই বাংলাদেশের একান্ত, নিজস্ব। ইতিহাসের পরতে-পরতে জড়িয়ে। ফেব্রুয়ারি। মার্চ। ডিসেম্বর। তিনটি মাস রাজনীতির সঙ্গেও ওতপ্রোত। অবিচ্ছিন্ন। এবং যারা বাংলা ভাষার বিরোধী, স্বাধীনতার বিরোধী, বাংলাদেশের বিরোধী, তাদের কাছে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। কেন, সব পাঠকই জানেন।
শুনেছি, বাংলা নববর্ষ উদযাপন, পয়লা বৈশাখে, মৌলবাদীদের চক্ষুশূল। নানা ফতোয়া, জিগিরে মুখরিত।
পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ নিয়ে যে স্মৃতি (স্মৃতি সতত সুখের), আজকের প্রজন্মের কাছে বিস্ময় লাগবে হয়তো।
১৯৬৭ সালে, রমনা পার্কে, ছায়ানটের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আয়োজন। মূল আয়োজক সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক। সকাল সাতটায় অনুষ্ঠান। সাকুল্যে কুড়িজনও হাজির নন। হাফপ্যান্ট পরে গিয়েছিলুম। কারোর পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি দেখিনি। অনুষ্ঠানে মাত্র তিনজন মহিলা। মিনু আপা (সনজীদা খাতুন)। লীনু আপা (ফাহমিদা খাতুন)। রেশমা (রেশমার কথা হয়তো অনেকেরই মনে নেই। রেশমা একসময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বহু ছবিতে নায়িকা ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছবিতেও)। অনুষ্ঠানে চাঁদভাই (অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা), রেশমা কবিতা পড়েছিলেন। লীনু আপার গান। ব্যস, অনুষ্ঠান শেষ। ১৯৬৮ সালে, রমনার নববর্ষের অনুষ্ঠানে, মিনু আপার নির্দেশে, স্বরচিত পদ্য পড়ি (কানে লেগে আছে, মিনু আপা ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “ছোট কবিতা পড়বি”)।
১৯৭০ পর্যন্ত, রমনার নববর্ষ উদযাপনে, ছায়ানট আয়োজিত, মিনু আপাই মূলে, দেড়শ’ মানুষেরও ভিড় হয়নি। না হলেও, আমরা, তরুণ-প্রবীণ, হৈচৈ করতুম। দৃশ্য এখন আমূল পাল্টেছে। রীতিমতন কার্নিভাল। এক অর্থে ফেব্রুয়ারি মাসও। অবশ্য, এই কার্নিভালের চেহারাচরিত্র একেবারেই ভিন্ন। শোকের মাস নয়। পুরোপুরি উৎসবের। সাহিত্যের উৎসব। বইয়ের উৎসব। পৃথিবীর নানা দেশের বইমেলায় যোগ দিয়েছি। দিই। কিন্তু কোনও দেশে এক মাসব্যাপী বইমেলা হয় না। অনেক কিছুতেই বাংলাদেশ ব্যতিক্রম, বইমেলার ক্ষেত্রেও। শুনেছি, ফেব্রুয়ারি মাসে দুই হাজারের বেশি বই প্রকাশিত। বিস্তর নতুন লেখকের আত্মপ্রকাশ।
জন্মেছিলুম ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে (তৎকালীন পাকিস্তানি আদমশুমারে উল্লেখিত, ‘২১/০২/১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে দেড় হাজারের অধিক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিয়াছে’)।
বলছিলুম ডিসেম্বরের (১৯৭১) কথা। আসলে স্মৃতিচারণ। বেশি স্মৃতি কচলালে সাতখণ্ড রামায়ণ না হলেও অর্ধেকের অর্ধেক হয়ে যাবে। সংক্ষিপ্ত এই, মার্চের শেষে ঢাকা থেকে পলাতক। পাবনায়। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যোগ দিতে পারলেও দেশের ভিতরেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। নানাভাবে। পাক সেনাদের গুলি থেকে দুইবার মরতে-মরতে বেঁচেছি।
সেপ্টেম্বরের গোড়ায় অগ্রজ রশীদ হায়দার পাবনার দোহারপাড়ায় গিয়েছেন। বাড়িতে স্ত্রী ঝরা। কন্যা হেমা (আট মাস বয়স)। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে ঢাকায় এলেন। সঙ্গে এসেছি। ঝরা ভাবির (পুরো নাম আনিমা আখতার। পরে আনিমা হায়দার) বড়ো বোন বেগম (আমরা বলতুম ‘বেগমবু’)। তাঁর আস্তানায় ঠাঁই। আস্তানা বলতে বিশাল বাড়ি। তিনতলা। বাড়ির ঠিকানা ৩২ ধানমন্ডি রোডের পয়লা বাড়ি। চার/পাঁচ বাড়ির পরেই কবি সুফিয়া কামালের বাড়ি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। বেগমবুর বড়ো মেয়ে শিরিন, ওঁরই সমবয়স্ক লুলু আপা (সুলতানা কামাল), হাসু আপা (শেখ হাসিনা)। ওঁরা বন্ধু। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে ছাত্রী। তিন বন্ধুরই এঁর-ওঁর বাড়িতে যাতায়াত। যা হয়। ১৯৬৭ সালে (কোন তারিখ-মাস মনে নেই।) প্রথম দেখি লুলু আপা, হাসু আপা একসঙ্গে এসেছেন শিরিনের বাড়িতে। ওঁরা শিরিনের ঘরে ঢুকলেন। ঘণ্টা দেড়-দুই আড্ডাও দিলেন। পরে বারকয়েক দেখেছি, বেগমবুর বাড়িতেই। সম্বোধন করি লুলুআপা, হাসুআপা।
বেগমবুর একমাত্র ভাই, ডাকনাম বারি, এসেছেন পাবনা থেকে। তাঁরও অস্থায়ী নিবাস বেগমবুর বাড়ি। তাঁর দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে। রণাঙ্গনে। বারি ভাইয়ের নির্দেশেই আমরা বেগমবুর বাড়ির বাগানে ট্রেঞ্চ খুঁড়লুম, রাতের আঁধারে। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে। ৬ তারিখ থেকে পাক-ভারত যুদ্ধ। ঢাকার শহরজুড়ে পাক বিমানের ওড়াউড়ি। বারি ভাইয়ের কথা, “শেখ মুজিবের (তখনো ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধন চালু হয়নি) বাড়ির আশপাশে পাক বা ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধবিমান বোমা ফেলবে না। তবু সাবধানে থাকা ভালো।”
অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে লক্ষ করি, রশীদ হায়দায় তাঁর ঘরের টেবিলে বসে বাঁধানো খাতায় কী-সব লেখালেখি করছেন। ওই লেখা উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশে প্রথম উপন্যাস, ‘অন্ধ কথামালা’। এই উপন্যাস ঢাকা-কলকাতা থেকে প্রকাশিত।
-মার্জনাপ্রার্থী, চটজলদি মারাত্মক ভুল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম উপন্যাসের লেখক আনোয়ার পাশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক (প্রাবন্ধিক। কবি।)। উপন্যাসের নাম ‘রোটি আউর আওরাত’।
১৭ ডিসেম্বর শুনলুম, রায়ের বাজারের খালে বহু মৃতদেহ ছড়ানো-ছিটানো। দেখতে গেলুম। গিয়ে শুনলুম, মৃতেরা আমাদের বুদ্ধিজীবী-কবি-সাহিত্যিক-অধ্যাপক। মুনীর চৌধুরী থেকে রাশিদুল হাসান (ইংরেজির অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), আনোয়ার পাশা। প্রায়ই যেতুম ওঁদের ফ্ল্যাটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাটে।
ওঁদের স্নেহাশিস এখনো জাগ্রত।
-ভাগ্যের কী পরিহাস!! রাশিদুল হাসান, আনোয়ার পাশা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান-মুর্শিদাবাদের। ভারত ভাগের অনিশ্চয়তায় ভাগ্যের সন্ধানে দুজনেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, মূলত উদ্বাস্তু। পূর্ব পাকিস্তানকেই ‘স্বদেশ’ করেন। কিন্তু পাকিস্তানে অবিশ্বাসী, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতায়, বাংলাদেশই স্বপ্ন। কেন পাকবাহিনীর রাজাকার, আলবদর বাঁচিয়ে রাখবে? এখনো রাখতে চায় কী?
-না। না- রাখার দোসর আছে, মদতদাতা দুই-তিনটি রাজনৈতিক দল। এই দলগুলোর নাম বলার দরকার নেই, পাঠক ওয়াকিবহাল, জানেন।
১৬ ডিসেম্বরেও অজানা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের খবর, আমরা সকাল থেকে (১৬ ডিসেম্বর) ছাদে উঠে, বসে, ভারত ও পাকের বিমানযুদ্ধ দেখার অপেক্ষায়। এও বাহুল্য। পাকবাহিনীর সাঁজোয়া কনভয়ও নেই রাস্তায়। সকাল ন’টা গড়ায়। উৎকণ্ঠায় দম বন্ধ-প্রায়।
দশটার কিছু পরে দেখি পাকবাহিনীর সাঁজোয়া কনভয়, কোনও আমার্ড-গাড়িতে সঙ্গীন উঁচিয়ে নেই, ট্যাঙ্কের নলও নামানো। আকাশে ভারত-পাকের কোনও বোমারু বিমানও নেই। গোটা অঞ্চলে, চারদিকে ঘন-নিস্তব্ধতা। মৃত্যু আসন্ন বোধ হয়। সাড়ে দশটার আগে বা পরে, ঘড়ি দেখিনি, জাতিসংঘের (ইউনাইটেড নেশনস) একটি সাদা জিপ রাস্তায়, গাড়িতে মাইক। মহিলার কণ্ঠ, ইংরেজি ভাষায়,‘বেঙ্গলাদেশ ফ্রি, বেঙ্গলাদেশ ফ্রি’।
এই ঘোষণায়, মুহূর্তেই জনগণ রাস্তায়। হাতে বাংলাদেশের পতাকা। কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল এই পতাকা?
-এরকম ভাবনার আগেই লাফিয়ে পড়ি দোতলা থেকে। পা ভাঙে। যন্ত্রণায় দিশেহারা। বাংলাদেশ স্বাধীন। যুদ্ধ-স্বাধীনতা-জীবন নিয়েই রশীদ হায়দারের উপন্যাস ‘অন্ধ কথামালা’। আমাদের সংগ্রাম-স্বাধীনতা-বাংলাদেশ নিয়ে উপন্যাস। দলিল ও ইতিহাসও।
-উনিশ শ একাত্তরের ডিসেম্বর সর্বদাই মনমননে উদ্ভাসিত, আমি আপনি আজ কেন বাংলাদেশের, কেন বাংলাদেশি, গর্বিত, ভাবুন।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

/এমওএফ/ আপ-আইএ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অ্যাটলেটিকোকে বিদায় করে ১১ বছর পর সেমিফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগঅ্যাটলেটিকোকে বিদায় করে ১১ বছর পর সেমিফাইনালে ডর্টমুন্ড
অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
চ্যাম্পিয়নস লিগঅবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ