X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নারীর কাজ, পুরুষের সাহায্য

বীথি সপ্তর্ষি
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩৩আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩৫

বীথি সপ্তর্ষি ঘরের কাজ নারীর দায়িত্ব, একান্ত নারীর। পুরুষ কাজ করলে সেটা বরং কাজ না, ‘সাহায্য’। পুরুষ এই ভেবে আত্মশ্লাঘায় ভোগে, যাক আমি টিপিক্যাল/প্র্যাগম্যাটিক ধ্যান-ধারণার বাইরে আসতে পেরেছি। রান্নাঘরে ঢুকে দুটো থালা জায়গামতো রেখে, তেলের ফোড়নটা ছ্যান ছ্যান করে দু’বার নেড়ে বলেন ‘সাহায্য’ তো করেছি। কেউ কেউ ভেবে থাকেন আমি নিজে সংসারের কাজ না করলে কী হয়েছে, পুরুষও নারীর সঙ্গে একসঙ্গে ঘরের কাজ করবে সেটা তো সমর্থন করিই। আমার ও আমাদের সমর্থনে এবার নারী-পুরুষ একসঙ্গে এগিয়ে যাবে। ‘এনারা’ সবাই শুধু সমর্থনই করেন কিন্তু নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসে, সাহায্য করার ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ‘সংসার দুজনের যৌথ প্রযোজনার প্রতিষ্ঠান’ ভাবতে পারেন না। ‘তুমি একটা তরকারি, আমি একটা তরকারি রাঁধি’ পর্যায়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট সাহস ও আত্মবিশ্বাস লাভ করতে পারেন না। নারীর মগজে কি রান্না-সংসারভিত্তিক ভিন্ন কোনও টিস্যু থাকে যে নারীরা ১০ বছর বয়সে যা করতে পারে পুরুষ ২০/৩০ বছর বয়সেও সে একই দক্ষতা অর্জন করতে পারেন না!

প্রায়ই দেশ-সমাজ-রাজনীতি, নারী অধিকার বিষয়ে আড্ডার সময় দেখা যায় পুরুষলোকেরা পরিষ্কার কাপড়চোপড় পরে, চাদরের আভিজাত্য বুকের তলা দিয়ে পেঁচিয়ে ঘরের স্ত্রীলোকদের রান্নাঘরে (এমনকি সমমনা (!) সঙ্গীটিকেও) রেখে আড্ডা দেন। টেবিলে খাবার দিলে ‘ভাবি, আপনিও বসেন’ বললে, বেচারা ভাবি কাচুমাচু হয়ে রান্নাঘরে দৌড়ান পানির জগ আনতে। অনেকেই নারীবাদীদের প্রেম/বিয়ের সময় ‘প্রেমে/সংসারে’ কোন ‘বাদ’ চলে না শীর্ষক মহামূল্যবান উপদেশ দিয়ে থাকেন। আবার বিবাহিত বন্ধুদের সঙ্গে হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে গেলে ‘কিরে ভাবির রান্না তো এখনো খাওয়ালি না’ বলে অধিকার প্রদর্শনপূর্বক অসংবেদনশীল পুরুষতান্ত্রিক রসিকতাটুকু করতে ছাড়েন না। ভাবখানা এমন যে, বিয়ে করে কর্তাব্যক্তিটি আজীবনের জন্য যে রান্না খাওয়ার সুযোগ-সুবিধা অর্জন করলেন সে সম্পর্কে চারপাশের বন্ধু-ভ্রাতাদের ওয়াকিবহাল রাখা অত্যন্ত জরুরি। ‘অমুকের বৌয়ের হাতের রান্না দারুণ’ বলে অন্য কোনও দাওয়াতেও কিছু মতামত রাখা যায় তাতে। আধুনিক স্বামীদেরও অফিস, সেমিনার শেষে কাছের সহকর্মী/বন্ধুস্থানীয়দের কাছে গলার রগ ফুলিয়ে ‘আপনার ভাবি দুর্দান্ত রান্না করে, একদিন আসেন’ বলে তৃপ্তি পান। এমতাবস্থায় আমি কিঞ্চিত রসিকতা করার সুযোগ হেলায় হারাতে চাই না বলে জিজ্ঞেস করে বসি, দাওয়াত দিচ্ছেন আপনি আর রান্না খাবো ভাবির তা হবে না। আপনি কী ভালো রাঁধেন সেটা বলেন।

রান্নাবান্না পারেন কিনা প্রশ্নের উত্তরে গর্বভরে পুরুষলোকেরা ‘পারি তো- ম্যাগি নুডলস, ডিম ভাজি, খিচুড়ি রান্না’  বলে ঝকমকে চোখে তাকিয়ে থাকেন। তখন উল্টো প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, সারা জীবন ডিম ভাজি-খিচুড়ি খেয়ে কাটাতে পারবেন তো? কেউ কেউ আরেকটু বাড়িয়ে রান্নাবান্নার চেষ্টা করেন এবং যা হয় তাতে সঙ্গীনীর পাতে তুলে দেওয়া গেলেও অতিথি এলে সঙ্গীনী পুরুষ লোকটিকে রান্নাবান্নার দায়িত্ব দিতে চান না। দেবেনইবা কী করে! খাবারের স্বাদ খারাপ হলে দোষ তো নারীরই, আর রান্না পুরুষ লোকটি করেছেন জানলে তো পরিচিত প্রগতিশীল সমাজেও ঢিঢি পড়ে যাবে। সব মিলিয়ে শাঁখের করাত আর কী।

অনেকেই ইউটিউব, রান্নার বিভিন্ন রেসিপি দেখে রান্নাটা মন দিয়ে চেষ্টা করলেও তারা ঠিক রান্নাঘরটা নিজের মনে করতে পারেন না। তাদের রান্নাবান্না শেষ হলে রান্নাঘর আর ডাস্টবিনের বৈসাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তারা যা-ই করেন, যা-ই ধরেন তার সবই আলগা একটা ভাব লেগে থাকে। ব্যতিক্রমও নিশ্চয়ই আছে, তারা এখানে আপাতত আলোচ্য নন।

সুতরাং, নারী গৃহিণী হলেও পুরুষ ঠিক গৃহী হন না। তারা গৃহে আসেন শাসন-শোষণ করে নিজের উপযোগিতা ও অপরিহার্য উপস্থিতির দাগ টানতে। পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে ‘সংসার নারীর সবচেয়ে বড় ধর্ম’ প্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত ‘দুজনের সংসার’ প্রতিষ্ঠা করেন না। সেই ইচ্ছে বা আগ্রহ কোনোটাই তাদের হয় না। প্রেমে পড়ে দুদিন দুটো রান্না করে বৌ/প্রেমিকাকে খাওয়ালেও দীর্ঘমেয়াদে কর্মজীবী নারীর সাংসারিক কাজকর্ম ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়ার চেয়ে ‘সাহায্য’ করাই তাদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য। নিজের কাজ নিজে করি বলাটা হাজার হলেও পুরুষের পৌরুষ্যের অপমান বলে কথা।

তাছাড়া পরিবারের অন্যান্য পুরুষতান্ত্রিক সদস্যরাও (নারী ও পুরুষ উভয়ই) সঙ্গীনীর সঙ্গে সাংসারিক কাজে হাত লাগাতে দেখলে ‘স্ত্রৈণ’ বলতে কিছুমাত্র দেরি করেন না। ‘বৌয়ের কথায় ওঠাবসা’ বলেও নারীর প্রতি অবমাননাকর বহুল প্রচলিত একটি শব্দ বাংলায় প্রচলিত আছে। বরের কথায় ওঠাবসা যেসব নারী করেন (করেন না এমন নারী নাই বললেই চলে অবশ্য) তাদের জন্য জেন্ডার ইনসেনসিটিভ বিশেষ কোনও শব্দ নেই বলেই জানি। কারণ, নারীজন্ম মাত্রই ‘বাধ্য’, আলাদা করে তাই কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করার প্রয়োজন তাকে হয় না। যদিও বিগত কয়েক বছরে সময় বদলেছে। নারী-পুরুষের সমতার লড়াইটাও অনেকখানি স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত চর্চার জায়গায় একইরকম অচলাবস্থা চলছে। কাগজে-কলমে, সেমিনারে আর এনজিও কার্যক্রম ছাড়া ব্যক্তিগত  স্ফেয়ারে নারী-পুরুষকে সমান ট্রিটমেন্ট দেওয়া এখন অবধি অধরা। পেছনের কারণ হিসেবে অচলায়তনে নারী-পুরুষের প্রায় সমান অবদান।

বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এগিয়ে যাচ্ছে, প্রবন্ধের বইয়ের বিক্রি বেড়েছে। প্রশ্ন আসে, প্রগতি কি নারীকে এড়িয়ে। জলে-হাওয়ায় উড়ে উড়ে কবি-সাহিত্যিকরা ইতিহাস তৈরি করবেন আর নারীরা পাতিলে-পাতিলে কবিতার হাড়গোড় রেঁধে টেবিলে তুলে রাখবেন। পুরুষের প্রতিভার বিঘ্ন ঘটবে বলে তাকে বোহেমিয়ান হওয়ার সুযোগ দিলে নারীর প্রতিভার সমস্তই কেন সংসারের নিশ্ছিদ্র জালে আটকে থাকবে? নারীকেও গৃহিণীর ধ্রুবত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে বোহেমিয়ান জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়া হোক। ঘরের বাইরে কাজ করে পুরুষকে নারীর সাহায্য করা ও ঘরের কাজে নারীকে পুরুষের সাহায্য করার দুই মানসিকতাই পরিত্যজ্য হোক।

সর্বোপরি, সাহায্য যা অন্যের বাড়িতে বা অন্যের কাজে করা হয়। নিজের কাজ নিজেই করার নাম কখনোই সাহায্য করা নয়।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
ট্যুর অপারেশনে ব্যাংকে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা
ট্যুর অপারেশনে ব্যাংকে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ