X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

তিনি পাঁচ বছর পর আবির্ভূত হলেন

শাহেদ শফিক
০৯ মার্চ ২০১৯, ১৪:০৮আপডেট : ১০ মার্চ ২০১৯, ১৫:৪৭

মো. গোলাম ছরোয়ার দুর্নীতির অভিযোগে পাঁচ বছর আত্মগোপনে থাকার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পরিবহন বিভাগের এক কর্মচারীর হঠাৎ আবির্ভাব ঘটেছে। বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত এই কর্মচারীর নাম মো. গোলাম ছরোয়ার। তিনি সর্বশেষ ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে তিনি সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী ব্যবস্থাপক ছিলেন।
অসুস্থতার কারণে এর আগে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যক্তিগত শুনানিতে উপস্থিত হতে পারেননি বলে গত বছরের ৬ আগস্ট ও ৯ সেপ্টেম্বর মেয়র বরাবর পৃথক দু’টি আবেদন করেন তিনি। তার আবেদনের বিষয়ে তদন্ত করার জন্য ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামানকে নিযুক্ত করে ডিএসসিসি। পরে গত ৩ মার্চ ওই কর্মচারী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উপস্থিত হন।
অনিয়মের দায়ে তার বিরুদ্ধে তিনটি বিভাগীয় মামলা চলছে। তিন মামলায়ই তাকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এর পাঁচ বছর পর তার আবির্ভাব ঘটে। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষও এখন তার বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে। কিন্তু গোলাম ছরোয়ার চাকরি অবস্থায় থাকলেও এ দীর্ঘ সময় করপোরেশনকে তার অসুস্থতার বিষয়টি জানাননি। করপোরেশনের লোকজন তার স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানায় গিয়েও তাকে পায়নি।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সংস্থার স্বার্থ রক্ষা না করে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে করপোরেশনের হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির ক্ষতি করেছেন। সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র গায়েব করে রেখেছেন। ব্যক্তিস্বার্থের জন্য রাজস্ব আদায়ে গাফিলতি করেছেন। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি বিভাগীয় মামলা হয়। মামলার তদন্তেও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য একাধিকবার তলব করা হলেও তিনি ব্যক্তিগত শুনানিতে হাজির হননি।
এ অবস্থায় চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, তার চাকরি থাকার কথা নয়। গত পাঁচ বছর ধরে ওই কর্মকর্তাকে বহুবার তলব করার পরেও খুঁজে পায়নি ডিএসসিসি। এভাবে দীর্ঘদিন কেটে যাওয়ার পর ওই কর্মচারী হঠাৎ করে মেয়র বরাবর আবেদন করে নিজের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। নগর কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে আবারও তদন্ত শুরু করেছেন।
ডিএসসিসি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে এই কর্মচারীর নামে তিনটি বিভাগীয় মামলা চলছে। মামলাগুলো হচ্ছে, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ক্যান্টিনের ভাড়া আদায় না করা, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের মূল নকশা মামলার প্রয়োজনে সঠিক সময়ে সরবরাহ না করা এবং আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে করপোরেশনের ক্ষতি করা। করপোরেশনের রাজস্ব তছরুপ, রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা এবং ব্যক্তিস্বার্থে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের বিভিন্ন কাউন্টার বিভিন্ন পরিবহনের নামে অবৈধভাবে বরাদ্দ দেওয়া। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে রাজস্ব আদায় করে সংস্থার তহবিলে জমা না দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
ডিএসসিসি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এই কর্মচারী ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় ওই টার্মিনালের আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের ১ নং ক্যান্টিনটি ভাড়ায় পরিচালনা জন্য মো. আলমগীর হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ক্যান্টিন পরিচালক দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্টিন ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেননি। করপোরেশন তার কাছ থেকে দুই লাখ দুই হাজার ৩৬৬ টাকা পাওনা ছিল।
ওই কর্মকর্তা তার দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল আদায়ের ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেননি বলে মামলায় উল্লখ করা হয়। এছাড়া ক্যান্টিন বিষয়ে ২০০৭ সালে একটি মামলা রয়েছে। কিন্তু ওই মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য তৎকালীন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত নথিটির বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষ বরাবর উপস্থাপন না করায় করপোরেশনের ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ এই কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়।
মামলাটি তদন্তের জন্য ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর তৎকালীন অঞ্চল-১ এর নির্বাহী কর্মকর্তা বেগম শাহিনা খাতুনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তার তদন্ত প্রতিবেদন ‘অস্পষ্ট’ উল্লেখ করে বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি একই অঞ্চলের নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সানাউল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সানাউল হক অভিযুক্ত গোলাম ছরোয়ারকে ব্যক্তিগত শুনানির জন্য একাধিকবার তলব করলেও তিনি সাড়া দেননি। এ অবস্থায় অভিযোগনামায় বর্ণিত অভিযোগগুলো সত্য বলে তিনি প্রতিবেদন দাখিল করেন।
অপরদিকে অভিযোগ রয়েছে, একই টার্মিনালের দায়িত্ব পালনকালে সায়েদাবাদ টার্মিনালের মূল নকশা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগ্রহ করেন গোলাম ছরোয়ার। কিন্তু নকশাটি তিনি মামলার প্রয়োজনে যথাযথ সময়ে কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ না করে গায়েব করে ফেলেন। এছাড়া ওই বাস টার্মিনাল সংক্রান্ত অপর একটি রিট পিটিশন মামলায় সিটি করপোরেশন যাতে জিততে না পারে সে জন্য তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ অবস্থায় তাকে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলেও তিনি যে জবাব দেন তা ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে প্রত্যাখ্যান করে ডিএসসিসি। পরে ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় দ্বিতীয় মামলাটি হয়।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় সংস্থার তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরীকে। মামলাটি তদন্ত করার জন্য অভিযুক্ত গোলাম ছরোয়ারের ঠিকানায় সাধারণ ডাকের পাশাপাশি রেজিস্ট্রি ডাকে অভিযোগনামা পাঠানো হলেও তিনি গ্রহণ করেনি। ব্যক্তিগত শুনানির জন্য চারবার দিন ও সময় ঠিক করে চিঠি দেওয়া হলেও তিনি গ্রহণ করেননি। শুনানিতে তিনি হাজির না হওয়ায় ঢাকা পৌর করপোরেশন কর্মচারী চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
সায়েদাবাদ টার্মিনালের টোল আদায়ের জন্য রাজস্ব আদায় সহকারী নিয়োগ করে সিটি করপোরেশন। কিন্তু তখন আব্দুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তিকে নিয়োগ করে কর্তৃপক্ষ। পরে তার কাছ থেকে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৮০০ টাকা অনাদায়ী থাকায় তাকে বরখাস্ত করে খলিলুর রহমান নামে আরেক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু গোলাম ছরোয়ার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালনকালে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া খলিলুর রহমানকে বরখাস্ত করে পুনরায় আব্দুর রাজ্জাককে রাজস্ব আদায়কারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। এই ব্যক্তি থেকেও ২০ লাখ ৮৮ হাজার ৫৫ টাকা আনাদায়ী থেকে যায়।
এসব টাকা আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় কর্তৃপক্ষ গোলাম ছরোয়ারকে সাময়িক বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে। একপর্যায়ে তারসহ অন্যান্য খাতের টাকা পরবর্তী ২০ দিনের মধ্যে আদায় করে দেবেন- লিখিত এই অঙ্গীকার করলে কর্তৃপক্ষ তাকে পদে পুনর্বহাল করে। কিন্তু পরবর্তী দুই বছর পার হলেও তিনি অঙ্গীকার পালন করেননি। এ অবস্থায় তার এমন আচরণ দায়িত্বে অবহেলা, অসদাচরণ, প্রতারণার সামিল এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে তিনটি প্রতিবেদনেই মতামত দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ডিএসসিসি সচিব মোস্তফা কামাল মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গোলাম ছরোয়ারের বিরুদ্ধে আগেও তদন্ত হয়েছে। নতুন করে কর্তৃপক্ষ যেহেতু আবার তদন্ত শুরু করছে তাই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো হবে। তবে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।’
এদিকে তার আবেদনের বিষয়ে তদন্ত করার জন্য ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামানকে নিযুক্ত করে ডিএসসিসি। গত ৩ মার্চ ওই কর্মচারী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উপস্থিত হন। বিষয়টি সম্পর্কে সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামানের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি তদন্তাধীন বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি।
এদিকে এ বিষয়ে বারবার চেষ্টা করেও অভিযুক্ত গোলাম ছরোয়ারের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। গত কয়েকদিন তার ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।

/ওআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জন্ম আর মৃত্যুর সুরেলা মেলবন্ধনের প্রতিধ্বনি
৩৫তম জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসবজন্ম আর মৃত্যুর সুরেলা মেলবন্ধনের প্রতিধ্বনি
দারুণ সেঞ্চুরিতেও রাব্বির কাছে ম্লান সাকিব
দারুণ সেঞ্চুরিতেও রাব্বির কাছে ম্লান সাকিব
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: স্টেশন মাস্টারসহ ৩ জন বরখাস্ত
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: স্টেশন মাস্টারসহ ৩ জন বরখাস্ত
খিলগাঁওয়ে ছাদ থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু
খিলগাঁওয়ে ছাদ থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ