X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মেননও ভোটে নির্বাচিত হননি?

শান্তনু চৌধুরী
২১ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:৫৩আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:১৩

শান্তনু চৌধুরী এমনিতে ক্যাসিনোকাণ্ড, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রদলের সম্মেলন, যুবলীগ নেতাদের ধরপাকড়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রাজনীতির মাঠ সরগরম। এর বাইরে প্রতিদিন নয়াপল্টনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর প্রেস ব্রিফিং তো রয়েছেই। রয়েছে দোষারোপের রাজনীতিও। প্রায় অর্ধমৃত বিএনপি এখনও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তৃতাবাণ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। কিছু ঘটলেই উদাহরণ হিসেবে আসছে, ‘বিএনপির আমলে এটা হয়েছিল বা এটা তারা করেনি।’ বিস্মৃতপ্রবণ বাংলাদেশিরা হয়তো ভুলেই গেছেন বিএনপি কবে কোথায় কখন কী করেছিল। যেমনটি অনেকেই হয়তো ভুলেই গেছেন শেষ কবে নেচে নেচে ভোট দিতে গিয়েছেন।
গেলো ১৪ অক্টোবর আমার উপজেলা সাতকানিয়ার নির্বাচনেও দেখেছি, ভোট দেওয়া নিয়ে তেমন কারও উৎসাহ নেই। ওই সময় সুযোগ হলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আসা, নয়তো কেউ একজন দিয়ে দিলেই হলো। ভোট কাকে দিতে হবে জানা কথা! এসব যখন আলোচনায়, তখন ভোট আর নির্বাচন নিয়ে যেন বোমা ফাটালেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এই ‘মেনন’ আজ  থেকে এক যুগ আগের ‘মেনন’ হলেও হয়তো বক্তব্যটি এতটা বিস্ফোরক হতো না। কিন্তু ২০০৮ সালের পর সময় যত গড়িয়েছে, মেননের অবস্থাও ততটাই বদলেছে। সেবারের নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হন। ওই সময় তিনি সংসদে কার্য উপদেষ্টা কমিটির সদস্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া, সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত বিশেষ কমিটিরও সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মহাজোট সরকারের পক্ষ থেকে রাশেদ খান মেননকে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি পার্টির সিদ্ধান্তে তা গ্রহণ করেননি। ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাশেদ খান মেনন সর্বদলীয় সরকারের ডাক ও  টেলিযোগাযোগমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০১৪ সালে মহাজোট সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার পরিচয়টা এই কারণে দেওয়া বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের শরিক হয়ে তিনি যখন বরিশালের অশ্বীনি কুমার টাউন হলের মধ্যে দাঁড়িয়ে শনিবার নাটকের ভঙ্গিতে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে ওঠেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ভোট দিতে পারেনি পরের নির্বাচনগুলোতেও।’ তার এমন বক্তব্যে সাধারণভাবে নড়েচড়ে বসেন শরিক দল তো বটেই বিরোধীদলের রাজনীতিকরাও। ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’।
বিএনপি যে কথাটি প্রায় প্রতিটি বক্তব্যে স্লোগানের মতো করে বলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, জনগণ শুনুক আর না শুনুক, সরকার পাত্তা দিক আর না দিক, প্রতিদিন নিয়ম করেই বলে যাচ্ছিল বিএনপি। এবার বুঝি মওকা মিললো! কারণ সেই কথাটিই যখন একাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য বলেন, তখন তো সোনায় সোহাগা। হয়েছেও তাই। পরদিন রবিবার বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী থেকে শুরু করে সিনিয়র অনেকেই বলেছেন, এই তো সত্যটা বেরিয়ে আসছে মহাজোটের শরিকদের কাছ থেকে। তাদের আশা, আরও যারা আছেন তারাও বিএনপির ভাষায় সত্যটা বলবেন! দেরিতে হলেও সত্যটা বলার জন্য মেননকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন।  
কিন্তু মহাজোটের অন্য শরিকরা ছেড়ে কথা বলবেন কেন? তারা যে মেননের প্রতি খ্যাপা, সেটা বোঝা গেলো বক্তব্যে।  রবিবার আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মেননের বক্তব্যের জন্য প্রশ্ন তুলে বলেছেন, মেনন মন্ত্রী হলে কি এমন কথা বলতেন? ১৪ দলের মুখপাত্র মো. নাসিম জানিয়েছেন, মেননকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এবারের মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু তো সরাসরি বলেছেন, ‘রাশেদ খান মেনন রাজনৈতিক সুবিধাবাদী’। আর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান মনে করেন, মেননের এই বক্তব্যের পর তার রিজাইন করা উচিত। তিনি আরও বলেছেন, কেউ যখন বড় পদ-পদবি পেয়ে সেটা হারিয়ে ফেলেন, তার পক্ষে এমন বক্তব্য দেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফারুক খানের এই বক্তব্যটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর শরিক দলের পক্ষ থেকে মন্ত্রিত্ব না পাওয়ায় যে লোকটি সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, তিনি রাশেদ খান মেনন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে মন্ত্রিসভা গঠনের পর ইনু আড়ালে থাকলেও সংবাদমাধ্যমগুলোকে ওই সময় মেনন বলেছিলেন, ‘জোটের কেউ মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়ায় আমি অবাক হয়েছি, বিষয়টি ১৪ দলের বৈঠকে তোলা হবে।’ শেষ পর্যন্ত তিনি আশা ছাড়েননি। কিন্তু যখন দেখা গেলো শেখ হাসিনার সরকার স্থান দিলো না মন্ত্রিসভায়, তখন শুরু করলেন সরকারের সমালোচনা। সরকারের সমালোচনা দোষের কিছু নয় বা রাষ্ট্রদ্রোহও নয়। কিন্তু তিনি অনেক সময় সাংঘর্ষিক কথা বলে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায়ও ফেলেছেন। এর কারণ এমন হতে পারে, এর আগেও সংসদে আওয়ামী লীগের অনেক বাঘা বাঘা নেতা সমালোচনা করে পরে মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন। রাশেদ খান মেনন হয়তো সেই পথে এগোতে চাচ্ছেন। কারণ মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়ার পরও খুব একটা খারাপ অবস্থানে ছিলেন না তিনি।
তবে, সম্প্রতি ক্যাসিনোকাণ্ডে যুবলীগ নেতাদের গ্রেফতারের পর বিভিন্নভাবে তার নামটি  এসেছে। ৭৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদের তাই বিধ্বস্ত থাকাটাই স্বাভাবিক। একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে ঢাকা মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া বলেছেন, বড় বড় টেন্ডারে ভাগ বসাতেন রাশেদ খান মেনন। টেন্ডারপ্রতি ৫ পার্সেন্ট কমিশন দিতে হতো তাকে। তিনি প্রতিমাসে সম্রাটের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা নিতেন। এমনকি নিয়মিত মাসোহারা না পেলে তিনি যুবলীগের নেতাদের গালিগালাজ করতেন। এছাড়া, সন্ত্রাসী থেকে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে যুবলীগের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন রাশেদ খান মেনন। 
এসব বক্তব্য কতটুকু সঠিক তা একমাত্র লেনদেনকারীরাই বলতে পারবেন, তবে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, ক্যাসিনোকাণ্ডে  জড়িত থাকার  অভিযোগ ওঠায় রাশেদ খান মেননকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। এসব বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফের বিবৃতি আসে রাশেদ খান মেননের কাছ থেকে। সেখানে তিনি বলেন, গণমাধ্যমে তার বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচারিত হয়েছে। যেমনটা প্রত্যেক  রাজনীতিবিদ বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় হলে বলে থাকেন। দৃশ্যমান মাধ্যমে সময়স্বল্পতা রয়েছে, আর কাগুজে বা অনলাইনে তার বক্তব্য যতটা প্রচার পেয়েছে, তাতে জোট আর নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা স্পষ্ট। কিন্তু তিনি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বক্তৃতায় আমি বলেছি, স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে এ যাবৎ জিয়া-এরশাদ-বিএনপি-জামায়াত আমলের ধারাবাহিক অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটেছে। বিভিন্ন সময় আমি প্রার্থী হিসেবে এসব ঘটনার সাক্ষী। আমি বলেছি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মিলে ভোটাধিকার ও ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে আমরা যে লড়াই করেছি, তা যেন বৃথা না যায়, সেজন্য নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে।’ 
মেননের এই ডিগবাজি খাওয়া কোন ধরনের রাজনীতির অংশ, বোঝা মুশকিল। জল কোন দিকে গড়ায়, দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুটা সময়। কারণ কে না জানে, রাজনীতিবিদরাই বেশি ‘পলিটিক্স’ করে থাকেন। তবে রাশেদ খান মেননের বক্তব্য উদ্ধৃত না করলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কমিশনার মাহবুব তালুকদার রবিবার (২০ অক্টোবর) কমিশনে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বেশ গুরুত্ববহ । তিনি বলেছেন, ‘দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া দুর্নীতির আওতামুক্ত নয়। যেসব জনপ্রতিনিধি অবৈধ উপায়ে বা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হন, তাদের নির্বাচনের কোনও  বৈধতা থাকে না। জনগণের প্রতি অবৈধ জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি থাকে না।’ 
মেননের বক্তব্য ঠিক হলে তার সংসদ নির্বাচিত হওয়াও ঠিক নয়। সে হিসেবে তিনিও অবৈধ জনপ্রতিনিধি। যার দায়বদ্ধতা সাধারণ মানুষের প্রতি নেই। তাই হয়তো এই বয়সে তিনি ক্যাসিনোর টাকা দিয়ে বাসনাবিলাসে মত্ত থাকেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।  

/এমএমজে/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ